
উবায়দুর রহমান খান নদভী
লেখক-সম্পাদক, দার্শনিক আলেম,
বহুভাষা, ইতিহাস, রাষ্ট্র ও সমাজতত্ত্ববিদ।
দ্বিতীয় পর্বের পর…
উইলিয়াম হান্টারের ভাষায়- আরাকান থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত প্রলম্বিত শের শাহ সূরি সড়কের দুই পাশে এমন কোনো বড় গাছ ছিল না যাতে আমরা ইংরেজরা কোনো-না-কোনো বিপ্লবীকে ফাঁসি না দিয়েছি।
ইউপির হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী, মাওলানা কাসেম নানুতবী, রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী ও তাঁদের সাথিরা এ সময় যুদ্ধে পরাজিত হন। রহমতুল্লাহ কিরানভী ও হাজী সাহেব মক্কায় চলে যান। বাংলা, বিহার ও ভারতীয় অন্যান্য রাজ্যে সংগ্রামী আলেমদের হত্যার পাশাপাশি অনেককে দেশান্তরের সাজা দেওয়া হয়। আন্দামান, নিকোবারসহ সুদূর মাল্টা পর্যন্ত উলামায়ে কেরামকে কালাপানির সাজা দেওয়া হয়। দেওবন্দের প্রথম সন্তান শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান, তাঁর শিষ্য হুসাইন আহমদ মাদানী, মাওলানা ফজলে হক খায়রাবাদী এসবের ভুক্তভোগী।
মাওলানা খায়রাবাদী তার ঐতিহাসিক কিতাব আছছাওরাহ আল-হিন্দিয়া ১৮৫৭-তে এর কিছু ইতিহাস সংরক্ষণ করেছেন। মাওলানা জাফর থানেশ্বরী কিছু লিখে গেছেন। মাওলানা মুহাম্মদ মিঁয়া সাহেব তার ঐতিহাসিক কিতাব উলামায়ে হিন্দ কা শান্দার মাযীতে এসবের বর্ণনাই দিয়েছেন। তার কিতাবের শেষ পাতায় তিনি এ ধরনের একটি মূল্যায়ন দিয়েই কিতাবটি শেষ করেছেন—
১৯০ বছরের ইংরেজ শাসক মুসলমানদের এ ভূখণ্ডে ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার এতবড় ক্ষতি করে গেছে, যার দৃষ্টান্ত পাওয়া কঠিন। সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দানকারী সুলতান, উজির, সেনাপতি, মুফতী, কাজী ও মুন্সি এবং তাদের তাত্ত্বিক পথপ্রদর্শক উলামায়ে কেরাম এমন মানসিক অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছেন যে, পূর্ণ দীনি প্রতিষ্ঠান, যেখানে কোরআন ও সুন্নাহর সামগ্রিক চর্চা হয়, সেখানে আলেমগণ ইচ্ছাকৃতভাবে এ কথাটি লিখে দিয়ে থাকেন যে, এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই অথবা অরাজনৈতিক দীনি প্রতিষ্ঠান। যে আশাটি ইংরেজরা করেছিল।
আজ ইংরেজ বিদায় হওয়ার প্রায় ৭০ বছর পরও তাদের দোসররা উলামায়ে কেরামের কাছে এমন আচরণই প্রত্যাশা করছে। প্রকৃত শিক্ষিত ও বিজ্ঞ আলেমরা যদি দীর্ঘ সিয়াসত পুনরায় জিন্দা করেন, তা হলে দীর্ঘদিন পরে হলেও এ দেশের নাগরিকদের ভুল ভাঙবে। পশ্চিমা রাজনীতির শয়তানি পদ্ধতি থেকে এ জাতি মুক্তি লাভ করবে। রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থান মূল মালিক আল্লাহ ও রাসূলের খলীফা আমীর বা ইমামের মাধ্যমে কোরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামী ব্যবস্থা জারি হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জন্য নিজস্ব জনপদে এ পদ্ধতির বাইরে থাকার সুযোগ নেই।
এ বাস্তব চিত্রটি চিন্তায় রেখে সবচেয়ে যোগ্য মুহাদ্দিস ও ফকীহগণ, মুফাসসির ও মুফতীগণ, মুফাক্কির ও মুজাহিদগণ যদি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে ৯২ ভাগ মানুষকে সবদিক দিয়ে প্রস্তুত করেন, তা হলেই পূর্ণাঙ্গ দীনি পরিবেশ ও ব্যবস্থা কায়েম করা সহজ হবে। বিচ্ছিন্ন দলবদ্ধতা, অনৈক্য ও বিক্ষিপ্ত মন-মানসিকতা ধীরে ধীরে আমীর ও জামাত-কেন্দ্রিক হয়ে গড়ে উঠবে। উলামায়ে কেরামের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে তারা যেমন পরীক্ষিত ও সফল, বিশেষ করে ইমামতে সুগরার ক্ষেত্রে, নিঃসন্দেহে তারা ধীরে ধীরে একসময় জাতির সর্ববৃহৎ কর্মক্ষেত্র রাষ্ট্র ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় ইমামতে কুবরার আসনটিও লাভ করবেন।
প্রথম পর্ব: ইসলামের বিজয় কোন পথে? একটি ঐতিহাসিক মূল্যায়ন
দ্বিতীয় পর্ব: ইসলামের বিজয় কোন পথে? একটি ঐতিহাসিক মূল্যায়ন