

এইচ এম আবু বকর : সহকারী বার্তা সম্পাদক, পাবলিক ভয়েস
আজকের এই দিনে নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছিলেন উপমহাদেশের গণমানুষের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক রাহবার ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন অধুনা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ আল্লামা সৈয়দ ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই রহ. (১৯৩৫ – ২০০৬ ঈসায়ী)। আজকের নিবন্ধে ওনাকে নিয়ে নিজস্ব মতামত নয় বরং বিশেষজ্ঞ রাজনৈতিক-শিক্ষাবিদদের মূল্যায়ন ও স্তুতিবাক্য উল্লেখ করতে চাই।
২০১৭ ঈসায়ীতে আমীরুল মুজাহিদীন আল্লামা সৈয়দ ফজলুল করীম রহ.জীবনী শীর্ষক আলোচনা সভায় বিশিষ্টজনদের মূল্যবান মন্তব্য নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো।
সেমিনারের বিশেষ আলোচক প্রফেসর ড. মাঈমুল আহসান খান (অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) তার আলোচনায় শায়খের রহ. স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শায়খের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাতের মজাদার ঘটনা উল্লেখ করে বলেন,
‘‘একবার ধানমন্ডি ঈদগাহ মাঠে মাহফিল শেষে সবাই হুজুরের সঙ্গে দেখা করছে। আমি একপাশে দাঁড়িয়ে আছি। দেখা করবো সেই সাহসটা পাচ্ছিলাম না। একটু অগ্রসর হই আবার পিছিয়ে যাই। একপর্যায়ে সবার সাক্ষাৎ শেষ হলে হুজুর আমাকে চমকে দিয়ে বললেন, ‘কি ভাই! আপনি কি আমার সঙ্গে দেখা করবেন না?’ আমি বললাম, হুজুর আমার কাছে তো টাকা নাই- কেমনে দেখা করবো! হুজুর তখন বলে ওঠলেন, ‘ভাই, আমি কি সাক্ষাতের সময় কারো কাছে টাকা চেয়েছি?’ বললাম, না, তাতো চাননি। তিনি বললেন, ‘যারা কিছু হাদিয়া দিয়েছে, তারা কি খুশি হয়েছে?’ বললাম, জ্বী, তারাতো খুশিই হয়েছে। তিনি বললেন, ‘যদি তাদের হাদিয়া গ্রহন না করতাম তাহলে? আমি বললাম, তবে তো অখুশি হতো।
এর পরে অগ্রসর হলাম। লক্ষ্য করেছিলাম হুজুর হাদিয়ার টাকা দুই পকেটে রাখছেন। কৌতুহল থেকে বেয়াদবের মতই প্রশ্ন করে বসলাম, হুজুর, দুই পকেটে কেন টাকা রাখছেন?
বললেন, ‘ভাই, একপকেটের টাকা মাদ্রাসার জন্য অপর পকেটের টাকা আম (সাধারন) মেহমানদারীর জন্য’। এরপর থেকে আমার সঙ্গে হুজুরের ঘনিষ্টতা বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। সাক্ষাৎ হয়েছে জীবনে বহুবার।
হযরত পীর সাহেব রহ. দুইটা ব্যপারে আমার কাছে সাংঘাতিক উদ্বেগ প্রকাশ করতেন। আশ্চর্যজনক ভাবে সেটা রাজনৈতিক বিষয়ে না। সে বিষয় দুটি ছিলো ১. বিচার ব্যবস্থা। ২. শিক্ষা ব্যবস্থা। ইমাম আবু হানিফা যেই বিচার ব্যবস্থার জন্য জীবন দিয়েছেন। পরে তারই শিষ্য আবু ইউসুফ তা গ্রহন করে ন্যায় ও সততার দৃষ্টান্ত কায়েম করেছেন।
হুজুরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো অত্যন্ত দূরদর্শী। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, গ্লোবালাইজেশন এখন সারাবিশ্বে সক্রিয়। প্যালেস্টাইন, ইরাক, মায়ানমার, বাংলাদেশ সমস্ত যায়গায় একই চিত্র। এসব অঞ্চলের জোয়ার ভাটা একই সূত্রে গাঁথা।
একারনেই পীর সাহেব রহ.বলতেন, রাজনৈতিক সংঘাত সংঘর্ষ সবযুগে সবখানে থাকবে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও মুসলমানদের মুসলমানিত্ব বজায় রাখবার জন্য এই দুটি জিনিস তথা শিক্ষা ও আইন বিভাগ সঠিক এবং অনমনীয় রাখবার বিকল্প নাই।
প্রফেসর ড. মাঈমুল ইসলাম খান আরো বলেন, আমি তার মধ্যে একই সঙ্গে সাহস এবং মেজাজ কন্ট্রোল করবার অদ্ভূত ক্ষমতা দেখে অভিভূত হতাম। তাকে কখনো নিজের পান্ডিত্য জাহির করবার ব্যপারে হাপিত্যেশ করতে দেখিনি। বরং আমার মত জেনারেল শিক্ষিত মানুষের কাছে অনেক বিষয় জানতে চাইতেন। অথচ তিনিই ছিলেন একজন প্রথিতযশা পন্ডিত আলেম। বড়ই আশ্চর্য তার এই গুন।’’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সহকারী মহাসচিব অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান তার আলোচনায় বলেন, পীর সাহেব চরমোনাই রহ. দীনী প্রোগ্রামের ব্যপারে সন্তানদের মায়াকেও জলাঞ্জলি দিয়েছেন।
তিনি একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, বর্তমান আমীরুল মুজাহিদীন এবং নায়েবে আমীরুল মু্জাহিদীনসহ তার ৫ সন্তান জেলখানায়। তখন চরমোনাই থেকে মাদারিপুরে প্রোগ্রামে যাবার পথে আমরা বললাম, হুজুর যদি একটু জেলখানায় গিয়ে তাদের অবস্থাটা দেখে যেতেন!
তিনি বললেন, ‘নাহ! অনেক দূর যাওয়া লাগবে। ওখানে সময় নষ্ট না করে দাওয়াতি কাজ করা কি ভালো না? ওদের ব্যবস্থা আল্লাহ করবেন’।
কোনোদিন তিনি অসুস্থতা বা অন্য ওজরে দীনী প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করেন নাই। এটা তার অনেক বড় দৃঢ়তা এবং কারামত।
প্রাজ্ঞ রাজনীতিক, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব হাফেজ মাওলানা এটিএম হেমায়েত উদ্দিন সাহেব রহ. তার আলোচনায় বলেছিলেন, আল্লামা সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. ছিলেন নীতির প্রশ্নে অটল এবং বৃহত্তর ঐক্যের ব্যপারে উদগ্রীব।
তিনি গতানুগতিক রাষ্ট্রনীতি ও অর্থনৈতিক প্রবাহের বাইরে একটা ভারসাম্য নীতির প্রবক্তা এবং সংগঠক। ভাতৃত্ব সৌহার্দ সম্প্রীতিময় রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্নদ্রষ্টা। যেখানে মানুষেরা সুখে শান্তিতে গলাগলি করে বসবাস করবে। খুন, গুম, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিমুক্ত ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের ব্যপারে সচেষ্ট নেতা ছিলেন।
তিনি এদেশের মানুষকে সচেতন করেছেন ইসলামী রাজনীতির ব্যপারে। তিনি না হলে ইসলামের রাজনৈতিক অধ্যায়টার সঙ্গে গণ মানুষের পরিচয় ঘটতো না।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও ইসলামী শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন তার বক্তব্যে বলেন, পীর সাহেবের রহ. সঙ্গে তার সাহচর্যের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার দাবী নিয়ে বলেন, ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ হযরত পীর সাহেব চরমোনাই রহ. শুধু উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুযূর্গ এবং ইসলামী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতাই নন, তিনি ছিলেন একজন যোগ্য নায়েবে রাসুল।
তিনি মজার একটি ঘটনাও শোনালেন, ২০০১ সালে এরশাদ সাহেবের সঙ্গে জোটের লিয়াজু চলাকালে তিনি আমাকে বললেন, ‘পীর সাহেব হুজুরের কী কারামাত আছে?’ যেহেতু এরশাদ সাহেব ইতোপূর্বে আটরশীর পীরের ভক্ত ছিলেন। তাই প্রশ্ন করলেন, ‘তিনি কি জ্বীন হাসিল করতে পারেন?’ আমি বললাম, তিনি এযুগের বড় আলেম এবং বুযূর্গ। তিনি বললেন, কেমনে? বললাম, ‘ইসলামের রাজনৈতিক সুন্নাত তিনি জিন্দা করেছেন। অসুস্থ রাজনীতিকে সুস্থ করেছেন। তিনি দীনের ব্যপারে আপোসহীন এবং অবিচল। এটাই তাঁর কারামাত।
অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন আরো বলেন, তিনি ছিলেন রাজনীতি এবং পীর মুরিদীর মহান সংস্কারক। তিনি ছিলেন উদার হৃদয়ের অধিকারী। সর্বশ্রেণীর রাজনীতিক, পেশাজীবি এবং শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। সবাইকে দীনের দাওয়াত দিয়েছেন।
ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের আমীর ড. ঈসা শাহেদী তার আলোচনায় বলেন, ‘‘বাংলাদেশের মানুষ যখন ‘রুহবান ফিল লাইল ফুরসান ফিন নাহার’ তথা রাতের ইবাদাত গুজার এবং দিনের বেলায় সংগ্রামী একজন সিপাহসালার- এর জন্য অধীর আগ্রহী হয়ে ওঠলো, পীর সাহেব চরমোনাইকে রহ. মানুষ তখন সর্বাগ্রে স্থান দিলো। তিনি একজন খানকার পীর হয়েও মুরীদ ছুটে যাওয়ার আশঙ্কায় রাজনীতিতে পিছপা হননি।
বর্তমান পীর সাহেবও তার শ্রদ্ধেয় পিতার রেখে যাওয়া মিশনগুলো সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষানীতির ব্যপারে সোহরাওয়ার্দীর দুইটি সমাবেশ, মূর্তির হটাবার ব্যপারে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং রোহিঙ্গাদের স্বার্থে নিরবিচ্ছিন্ন কর্মযজ্ঞে এটাই প্রমান করেছেন’’।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুহতারাম মহাসচিব হাফেজ অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুস আহমদ। তিনি পীর সাহেবের রহ. স্মৃতিচারণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্না জড়িত কন্ঠে তার সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বলেন, ‘‘পীর সাহেব চরমোনাই রহ. নিজের কাজ নিজে করতেন। নিজ হাতে রান্না করে আপনজনদের খাইয়েছেন।
নিজের পকেটে হাদিয়ার কোনো টাকা রাখতেন না। তার প্রতি চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রের প্রতিদান হিসেবে আল্লাহ কয়েকটা নেয়ামত দিয়ে থাকেন তন্মধ্যে নেক সন্তান অন্যতম’’।
উক্ত প্রোগ্রামে সর্বশেষ আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিখ্যাত দাঈ আল্লামা মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম দা.বা.। সেদিনের সেমিনারে শায়খের রহ. পরিবারের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্যটা তিনিই রেখেছিলেন।
তিনি তার আলোচনায় বলেন, ‘‘আমি পীর সাহেব চরমোনাইর রহ. সন্তান হিসেবে নয় বরং বাস্তবতার তাগিদেই বলতে হচ্ছে, শায়খ রহ. ছিলেন একজন মুজাদ্দীদ এবং আল্লাহ তাআলার অলী। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নেয়ামত ‘ফুরকান’ প্রাপ্ত ছিলেন। আমরা তার মত মহান মানুষের সন্তান হতে পেরে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ।
মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম বলেন, শায়খ রহ. রাজনীতির এই কন্টকময় পিচ্ছিল পথে এসে কী করে যে নিজেকে অক্ষত এবং কাঁদামুক্ত রেখেছেন। এটা নিয়ে আমি খুব চিন্তা করতাম। নীতি বিসর্জিত কোনো ধরনের জোট, ঐক্য তথা বিকিকিনির অপবাদ তাকে বইতে হয়নি। পাহাড়সম বিপদের প্রতিকূলে তিনি পর্বতপ্রমান সাহস ও তাওয়াক্কুল নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। তবুও নীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন অবিচল। কী করে তিনি এমনটা করতে সাহস পেয়েছেন? কোন শক্তির প্রশ্রয়ে?’।
একসময় অধ্যায়ন করতে করতে আল্লামা মনজুর নোমানীর রহ. এর ‘কুরআন আপ ছে কিয়া ক্যাহতা হায়?’ গ্রন্থটিতে এর সমাধান খুঁজে পেলাম। তা হচ্ছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, (তরজমা) ‘হে বিশ্বাসীগন! তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ফুরকান দান করবেন’।
এই ফুরকান এর ব্যাখ্যায় আল্লামা মনজুর নোমানী (রহ.) বলেন, ‘এটি হচ্ছে বিশেষ ধরনের ক্ষমতা বা আলো যার মাধ্যমে বান্দাহ তার জন্য কী করা উচিত আর কী অনুচিত তা নির্নয় করে অগ্রসর হতে পারে’।
তো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শায়খকে রহ. এই ফুরকান নামক বিশেষ নেয়ামতে ভূষিত করেছিলেন। একারনেই তিনি কোনো ধরনের ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হননি।
কার সঙ্গে জোট করা যাবে? কার সঙ্গে যাবে না? কীভাবে অগ্রসর হতে হবে? কিভাবে কর্মসূচি প্রনয়ণ করতে হবে? এসব ক্ষেত্রে খুবই সচেতনতার সাথে সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত গ্রহন করতেন। যে কারনে পিছপা হতে হয়নি। আল্লাহর শোকর!
মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম বলেন, সত্যিই শায়খ রহ. ছিলেন যুগের নকীব! কিংবদন্তী সাধক!
/এসএস