

প্রথমেই এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ মরহুম সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. (পীর সাহেব চরমোনাই) এর ব্যাপারে বর্তমান বাংলাদেশের সর্বজণবিদিত ধর্মীয় মুরুব্বী, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি, আল্লামা শাহ আহমদ শফী সাহেব দাঃবাঃ হযরতের একটি সুন্দরতম মূল্যায়ন লিখে শুরু করি।
দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি, আল্লামা শাহ আহমদ শফী সাহেব দাঃবাঃ
চরমোনাইর স্থপতি পুরুষ উজানীর ক্বারী ইব্রাহীম সাহেবের খলিফা হযরত মাওলানা সৈয়দ এছহাক সাহেব রহ. এর সুযোগ্য সাহেবজাদা আলহাজ্ব হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম সাহেব রহ. আমাদের মাঝে নেই। অগনিত ভক্ত, ওলামা-মাশায়েখ, রাজনৈতিক কর্মী ও দেশবাসীকে কাঁদিয়ে তিনি আজ মাওলা পাকের সান্নিধ্যে।
কোনো হক্কানী আলিম ইন্তিকাল করলে দুনিয়ার মানুষ অনেক কিছু থেকে মাহরূম হয়ে যায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাগুতী শক্তির মোকাবেলায় যে সমস্ত গুণীজন অনেক ভূমিকা রেখেছেন চরমোনাইর পীর হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম রহ. তাদের মধ্যে অন্যতম ব্যাক্তিত্ব ছিলেন। তিনি কওম মিল্লাতের খিদমতে যে সোপানে পা রেখেছিলেন তা বিরল ও বিস্ময়কর।
বাংলাদেশের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতিতে তার মত যোগ্য ও সাহসী আকাবিরে দেওবন্দের উত্তরসূরী আপোষহীন ও আদর্শ ব্যাক্তিত্বের খুবই প্রয়োজন ছিলো। তার ইন্তিকালে আমরা একজন কর্মঠ, নিষ্ঠাবান ও বলিষ্ঠ আলিমে দীনকে হারিয়েছি। পিতার যোগ্য সন্তান হিসেবে তিনি ছিলছিলার যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন এবং বাতিলের বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপ রেখেছেন তা সত্যিই বিরলতম।
বাস্তব জীবনে দ্বীনের বহুমূখী খিদমতের মাধ্যমে তিনি যে প্রমান রেখে গেছেন, উদার মত নিয়ে সমস্ত হক্কানী দেওবন্দী ওলামায়ে কেরামের সাথে শ্রদ্বার সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন তা অনেকের মধ্যেই পাওয়া দুস্কর। আমি চরমোনাই মাহফিলে গিয়েছি। সমকালীন সময়ে এ ধরনের মাহফিলের সংখ্যা খুবই বিরল।
আমার স্নেহধন্য খলীফা মুফতী ওমর ফারুক সন্দ্বীপীর মাধ্যমে চরমোনাইর দীনী খেদমতের ব্যাপকতা সম্পর্কে অবগত হই। দোয়া করি আল্লাহ তায়ালা এ ছিলছিলাতে বরকত দান করুন।
অগণিত মুরীদানের পথ প্রদর্শক এ মহান মানুষটির জন্য আমি দোয়া করি। আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসের আ’লা মাকাম নসীব করুন। তার রেখে যাওয়া দ্বীনের কাজগুলোকে পরিপূর্নতা দান করুন। তার স্থলাভিষিক্তকে পূর্ন যোগ্যতা ও মাকবূলিয়াত দান করুন। তার জীবনী গ্রন্থ বের হচ্ছে শুনে আমি খুবই আনন্দিত। এটি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আসলাফের ইয়াদগার হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ।
এটা ছিলো চরমোনাইর মরহুম পীর সাহেব হুজুরকে নিয়ে আল্লামা শফী সাহেব হযরতের মূল্যায়ন।
চরমোনাইর মরহুম পীর সাহেব হযরতের রেখে যাওয়া সবচেয়ে অনবদ্য অবদান বাংলার আনাচে কানাচে থেকে অসংখ্য মানুষের মিলনস্থল চরমোনাইর বাত্সরিক দুই মাহফিলের প্রথম মাহফিল শুরু হচ্ছে আগামী কাল ২৬ নভেম্বর। শেষ হবে ২৯ নভেম্বর সকালে আখেরী মুনাজাতের মাধ্যমে। এই মাহফিল অসংখ্য মানুষের জীবনের ধারা পরিবর্তন করে দিয়েছে। সুন্নাতে জিন্দেগীর এক প্রলয়ংকারী পরিবর্তন এসেছে মানুষের জীবনে। তাই এই মাহফিলের সর্বাঙ্গীন সফলতা কামনা করছি।
চরমোনাইর মরহুম পীর সাহেব হুজুরের আর একটা বৈপ্লবিক অবদান ছিলো এদেশে ইসলামী রাজনীতির অঙ্গনে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন.. যে পরিবর্তন এক বিপ্লবের পুর্ভাবাস দেয় অসংখ্য তারুণ্য হৃদয়ে।
টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রূপসা থেকে পাটুরিয়া ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশের সকল বিভাগ, জেলা, উপজেলা, থানা এমনকি বেশিরভাগ ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায়েও রয়েছে যাদের সক্রিয় কমিটি। যার ধারাবাহিকতায় সংগঠনের ব্যাপ্তি এবং অঙ্গসংগঠনের বৃদ্ধি হয়েছে উত্তরোত্তর।
আজ সারা বাংলাদেশে রয়েছে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ইসলামী যুব আন্দোলন। ইসলামী শ্রমিক আন্দোলন। ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন। ইসলামী আইনজীবী পরিষদ সহ সকল অঙ্গসংগঠনের পুর্নাঙ্গ কমিটি। যার সাথে সংশ্লিষ্ট এদেশের বৃহত একটি জনগোষ্ঠি ইসলামের মৌলিকত্ব সম্পূর্নরূপে ঠিক রেখে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জনগনের অধিকার আদায় সহ ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে।
ভোটের রাজনীতিতে এই দলটি এখনও বড় কোন বিপ্লব দেখাতে না পারলেও জনসম্পৃক্ত সংগঠন হিসেবে যে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে এটা এখন দিনের আলোর মত পরিস্কার বিষয়। তাই ভোটের রাজনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে এ সংগঠনটি হয়ে উঠুক এদেশে ষোলকোটি জনগনের একান্ত ভরসাস্থল সে কামনাই করছি হৃদয়ের গহীণ থেকে।
হযরত পীর সাহেব চরমোনাই রহ. মুসলমানদেরকে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ করার দাওয়াত দিতেন। তিনি গণ-মানুষের সামনে দীনের পূর্ণাঙ্গ ধারণা প্রকাশ করতেন। দরদী হৃদয় নিয়ে পূর্ণাঙ্গ দীনের সাধনাই করেছেন আজীবন। দীন এবং দুনিয়াকে আলাদা করার সুবিধাবাদী প্রবণতাকে তিনি বরদাশত করতে পারতেন না। দীন এবং দুনিয়াকে আলাদা করার প্রবণতা থেকেই আজ ইসলামকে রাষ্ট্র থেকে, সমাজ থেকে, অর্থনীতি থেকে, সংস্কৃতি থেকে বিদায় করার চেষ্টা চলছে। অথচ এসব কিছুই দীন তথা ইসলামের বিষয়বস্তুর বাইরে নয়।
কিছু উপাসনা এবং আরাধনার মধ্যেই শুধু যারা ইসলামকে গণ্ডিবদ্ধ মনে করতেন হযরত পীর সাহেব চরমোনাই রহ.। তিনি তাদের ভুল ধারণা শুধরাতে আজীবন চেষ্টা করে গেছেন। তরিকতের লাইনে একজন প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক হয়েও তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে ইসলামের আলোয় গড়ে তুলতে। তিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন জীবনের সকল পর্যায়ে এবং এ সংগ্রামকে তিনি উত্তম এবাদত মনে করেছেন।
মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ ফজলুল করীম রহ. ছিলেন একজন নীতিনিষ্ঠ রাজনীতিক। পূর্বসূরী আউলিয়ায়ে কেরামের মতো তিনিও প্রচলিত ধারার শুধু ক্ষমতা বদলের রাজনীতি পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন- ‘প্রচলিত পদ্ধতিতে কেয়ামত পর্যন্তও যদি ক্ষমতার হাত বদল হয়, তবুও জনতার মুক্তি আসবে না’। তিনি নীতি ও সাংবিধানিক কাঠামোর পরিবর্তন চেয়েছেন। তিনি রাজনীতি ও প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতির গুণগত পরিবর্তন চেয়েছেন। তিনি বলতেন, ‘শুধুমাত্র নেতা নয়, কাঙ্খিত মুক্তির জনী নীতিরও পরিবর্তন চাই। কেননা শুধু নেতার পরিবর্তন আর ক্ষমতার হাত বদল হলেই যে শান্তি আসতে পারে না, বিগত দিনে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকেই আমরা বহুবার তার প্রমাণ পেয়েছি‘।
তিনি বারবার বলেছেন, ‘আকাশ জমিনের মালিক যেমন আল্লাহ, জীবন-মৃত্যুর মালিক যেমন আল্লাহ, ক্ষমতা-রাজত্ব আর সম্পদের মালিকও তেমনি আল্লাহ, শান্তির মালিকও আল্লাহ। অতএব শান্তি পেতে হলে মানুষের গড়া দুর্বল নীতি বাদ দিয়ে আল্লাহর ইনসাফপূর্ণ নীতিতে দেশ চালাতে হবে’। তিনি আরও বলতেন, ‘একমাত্র ইসলামই মানুষের মুক্তির গ্যারান্টি। আওয়ামী লীগ, বিএনপিও যদি ইসলামের ইনসাফপূর্ণ বিধানের আলোকে দেশ চালায়- আমি তাদের খাদেম হয়ে থাকবো। আমি ক্ষমতা চাই না, আমি চাই মানুষের শান্তি’।
পীর সাহেব চরমোনাই রহ.-এর পদ্ধতি ও নীতির পরিবর্তনের জোড়ালো আহবান অষ্টাদশ শতকের দার্শনিক শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবির রহ. সমাজ কাঠামো পরিবর্তনের বিপ্লবী আওয়াজেরই প্রতিধ্বনি ছিল। পীর সাহেব রহ.-এর রাজনৈতিক দর্শন-চিন্তা ছিল সুদূরপ্রসারী। সাময়িক স্বার্থ চিন্তায় তিনি কখনো তাড়িত হতেন না। চমক এবং হুজুগের রাজনীতি, আবেগ এবং হঠকারী রাজনীতি তিনি পছন্দ করতেন না।
তিনি ইসলামি রাজনীতির স্বতন্ত্রধারা বজায় রাখতে চেয়েছেন। তিনি জাতীয় রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের কথা ভাবতেন। এ লক্ষ্যেই তিনি শেষ জীবনে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। জাতীয় নিরাপত্তা ও সংহতির স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মৌলিক ইস্যুতে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রতি তিনি গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তিনি জাতীয় সমস্যা ও ধর্মীয় বিষয়াদী নিয়ে দেশের সচেতন সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করতেন। তাদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতেন। তিনি সবসময় স্পষ্ট কথা বলতেন। কোনো বিষয়ে এড়িয়ে যাওয়ার বা পাশ কাটানোর প্রবণতা তার মধ্যে ছিল না।
তিনি মুক্তিযোদ্ধা, শ্রমজীবী, পেশাজীবী, ওলামা, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-শিক্ষকসহ সকল শ্রেণি-পেশার গণমানুষকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়েছেন। জাতীয় জীবনের এক দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে ১৯৮৭ সালের ১৩ মার্চ গণমানুষকে মুক্তি ও আলোর পথ দেখাতে তিনি কায়েম করেছিলেন ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন’ নামের একটি গণ-সংগঠন। সংগঠনের নামের মধ্য দিয়েই তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, দেশে রাজনৈতিক সংকটের মূলে রয়েছে শাসনতান্ত্রিক সংকট।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে। এরপরও মানুষ মানুষের গোলামি থেকে মুক্ত হতে পারেনি। উপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা বহাল রেখে গোলামির হাত বদল হয়েছে মাত্র। পীর সাহেব চরমোনাই রহ. মানুষকে মানুষের গোলামি থেকে মুক্ত হয়ে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের গোলামি করার আহবান জানিয়ে ছিলেন। এটাই ছিল পীর সাহেব চরমোনাই রহ.-এর এবাদতের রাজনীতির মূলমন্ত্র।
তিনি মানুষের ভেতরের প্রকৃত মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলতে নিরলস চেষ্টা চালিয়েছেন। সমাজের প্রতিটি মানুষ যাতে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নিজেকে সংশোধন করে একজন আল্লাহপ্রেমিক মানবতাবাদী ইনসানে কামেল-পূর্ণ মানুষে পরিণত হতে পারে- সেটাই ছিল এই সাধক পুরুষের সবচেয়ে বড় মিশন। তার রেখে যাওয়া সে মিশন এখনও চালু আছে। আত্মশুদ্ধি ও ব্যক্তিশুদ্ধির এই প্রচেষ্টার ফলে সমাজের বহুসংখ্যক অপরাধী অপরাধের পথ পরিহার করে এখন ন্যায়ের পথে চলছেন। অনেকেই তান আহ্বানে সমাজবিরোধী, রাষ্ট্র ও আইনবিরোধী, ধর্ম ও নৈতিকতাবিরোধী পথ পরিহার করে শান্তির আলোকিত পথে হাঁটছেন।
একটি ভালো রাষ্ট্র ও ভালো সমাজ গড়ে তুলতে হলে ভাল মানুষের প্রয়োজন। পীর সাহেব চরমোনাই রহ. সেই ভাল মানুষ তৈরির জন্য সবচেয়ে বেশি পেরেশান ছিলেন। এমন একজন মানবতাবাদী দরদী আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক নেতা পাওয়াটা ছিল আমাদের জন্য এক বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। মানুষের মাঝে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, ‘আধ্যাত্মিক সাধনার ফলে মানুষ সমাজবিমুখ ও সংসারবৈরাগী হয়ে যায়’।
মহান আধ্যাত্মিক সাধক ও দার্শনিক পীর সাহেব চরমোনাই রহ. তার সময়োপযোগী দর্শন-চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা নতুন করে ভুল প্রমাণ করেছেন। তিনি তার বৈচিত্রময় কীর্তির মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন, আল্লাহকে পাওয়ার সাধনা মানুষকে আরও সমাজমুখী এবং জীবন-জগত সম্পর্কে আরও দায়িত্বসচেতন করে তোলে। সন্যাস-প্রবণতা ও বৈরাগ্যতা দূরের কথা, বরং নিজের মাঝে রাষ্ট্রচিন্তা ও বিশ্বচিন্তার উন্মেষ ঘটে। বিশ্বশান্তি ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেতনা বিকাশ হয়।
ইসলামী শিক্ষার সূতিকাগার খ্যাত দারুল উলূম দেওবন্দের সাথে এই সংগঠনের সম্পর্ক বর্তমানে সর্বোচ্চ রকমের লক্ষণীয়। দারুল উলূম দেওবন্দের নায়েবে মুহতামিম সাহেব এসেছেন চরমোনাইর মাহফিলে। দারুল উলূম দেওবন্দের প্রধান মুফতী মুফতী হাবিবুর রহমান খায়রাবাদী সাহেব দাঃবাঃ হযরতও এসেছেন। খেলাফত দিয়ে গেছেন চরমোনাইর বর্তমান পীর সাহেব হুজুরকে। এমনকি এই ধারা অব্যাহত আছে এখনও।
চরমোনাই মরহুম পীর সাহেব এই কালজয়ী মহাপুরুষ ২৫ নভেম্বর ২০০৬ সাল মোতাবেক, ১১ অগ্রহায়ন পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে পরপারে পাড়ি জমান। মৃত্যু পূর্ববর্তী এই আল্লাহর প্রিয় বান্দার একটি কাজ অনেকের মনেই দাগ কেঁটেছিলো, অনেকে ব্যাপারটাকে কাকাতালীয় বললেও বৃহত একটি অংশই ব্যাপারটাকে হযরতের কারামত হিসেবে দেখেন।
সুদির্ঘ ৭০ বছর ধরে চরমোনাইর অগ্রহায়নের মাহফিলের তারিখ ছিলো ১, ২, ৩ অগ্রহায়ন। কিন্তু হযরতের মৃত্যু পুর্ববর্তি বছর ২০০৫ সালের ফাল্গুনের মাহফিলে হযরত হঠাৎই ঘোষণা দিলেন আগামী বছর থেকে চরমোনাইর অগ্রহায়নের মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে ১২, ১৩, ১৪ অগ্রহায়ন! এবং সে বছরই ১১ অগ্রহায়ন তারিখে তিনি ইন্তিকাল করেন।
সেদিন বৃষ্টি হয়েছিলো প্রকৃতির নিয়ম ভেঙ্গেই! কেঁদেছিলো এদেশের বৃহত একটি ইসলামপ্রেমী জনগোষ্ঠি। কেঁদছিলাম ছোট্ট আমিও। ভাঙ্গা মন আর ব্যাথাতুর হৃদয় নিয়ে হাজির হয়েছিলাম এই মহাপুরুষের নামাজে জানাযাতে। এই মহান মানুষটির সাথে ব্যাক্তিগতভাবে আমার রয়েছে মজার দুটি স্মৃতি।
বয়স তখন পাঁচ বছর আমার বাড়ির সামনে একটা কেরাতুল কুরআন মাদরাসায় পড়ি। মাদরাসাটি মুজাহিদ কমিটি পরিচালিত। সে মাদ্রাসায়ই হুজুর এলেন। আব্বু তখন সে মাদরাসার পরিচালক। আমাকে সোজা নিয়ে হুজুরের কোলে বসিয়ে দিলেন। হুজুর তখন খেজুর খাচ্ছিলেন। মুখ থেকে হালকা পান মাখানো সেই খেজুর বের করে সোজা আমার মুখে পুরে দিলেন তিনি! বেশ কাছ থেকে অবুজ সে সময়টাতেই দেখেছিলাম মানুষটিকে।
এরপর ২০০৫ সালের শেষের দিকে আমি চরমোনাই মাদরাসায় পড়ি। একদিন আসরের পর মানুষটি চরমোনাইর ঐতিহাসিক পুকুরে মাছ ধরছিলেন। দুরে দাড়িয়ে আমি তা দেখছিলাম। সাইজ হিসেবে আমি একটু উপরের ক্লাশেই পড়তাম তাই মাদরাসায় একটা আলাদা পরিচিতি ছিলো আমার। সে সুবাদেই কেউ একজন হুজুরের কাছে আমাকে পরিচিত করে দিলো। বেশ কাছে ডেকে নিয়ে সেদিন অনেক মজার মজার কথা বলেছিলেন তিনি। আব্বু-চাচুর পরিচয় দেয়ার পর হুজুর আরো নির্বিঘ্নে কথা বার্তা বলতে বলতে হাত ধরে হুজুরের রুমে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিনও হুজুর আমাকে খেজুর খাইয়েছিলেন!
আজ থেকে দশ বছর আগের সেই সময়গুলো এখনও স্মৃতিপটে স্পষ্ট আমার। ২০০৬ সালে চরমোনাই প্রাঙ্গণের নদীর পাড়ে মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীম সাহেব দাঃবাঃ সাহেবের সাথে ভোরের দিকে লঞ্চে করে আসা অসুস্থ মানুষটাকে রিসিভ করে নিয়ে আসার সেই মুহুর্তগুলো আজও স্পষ্ট হৃদয়পটে। হাত ধরে মানুষটিকে লঞ্চ থেকে নামানোর সেই দৃশ্য আজও মনে পড়ে মনটাকে ব্যাথাতুর করে তোলে।
কালজয়ী এই মহাপুরুষের অন্তর্ধান এদেশের ইসলামী অঙ্গন, প্রতিবাদী প্রাঙ্গন, রাজনৈতিক ময়দান এসব যায়গায় অনেক বড় শুণ্যতা তৈরি করেছিলো। ধিয়ে ধিরে তার রেখে যাওয়া এই বৃহত কর্মপন্থা যুগের পরিক্রমায় বিপ্লবের এক ধারা তৈরি করবে সে আশায় দিন গুনছি ক্ষন প্রতিক্ষণে।
লেখক: হাছিব আর রহমান
নির্বাহী সম্পাদক পাবলিক ভয়েস