

এইচ এম আবু বকর
কলকল রবে বয়ে চলা কীর্তনখোলা অববাহিকার কোলে সুজলা শ্যামলা উর্বরা ভূমিতে সুরম্য প্রাসাদাকৃতির কয়েকটি ভবনের সমষ্টিই চরমোনাই জামেয়া রশিদীয়া ইসলামিয়া। যা চরমোনাই মাদরাসা নামে পরিচিত। এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের একটি প্রাচীন সুপ্রসিদ্ধ ও বৃহত্তম দ্বীনি এদারা।
নিঃসন্দেহে চরমোনাই জামেয়া বিশ্বের তাবৎ দ্বীনি এদারা থেকে বিশেষ স্বকীয়তা মণ্ডিত। একটি জামেয়ার কোলে আত্মশুদ্ধির এত বড় অবগাহন এখানকারই গৌরব। এই জামেয়া দেশব্যাপী দ্বীনি একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী তাযকিয়ারও মিশনারি করে। এখানেই একমাত্র সম্ভব হয়েছে একই জামেয়ার অধিনে কওমিয়া ও আলিয়া নেসাবের দৃশ্যমান দুটো ভিন্ন ধারার সম্মিলন। আমল ও আখলাকে বাহ্যত এই দুই ধারাকে সম্পূর্ণ অভিন্ন আখলাকের চাদরে শামিল করার এই উদারতা ও সফলতা অন্য কোথাও লক্ষণীয় নয়।
চরমোনাইর পূণ্য ভূমিতে প্রথম একাডেমিক ভাবে মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় আল্লামা সৈয়দ ইসহাকের রহ. হাতে ১৯২৪ সালে। অবশ্য এর আগে এখানে আল্লামা সৈয়দ ফজলুল করীমের রহ. মাতামহ বুযূর্গ মনীষী সৈয়দ আহসানুল্লাহ কাসেমী রহ. তাযকিয়া ও তালীমের মেহনত শুরু করেছিলেন। চরমোনাই দরবারের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ হিসেবে স্বীকৃত আল্লামা সৈয়দ ইসহাক রহ. চরমোনাইতে প্রথমে কওমী নেসাবের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করলেও পরবর্তীতে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী আলিয়া নেসাবের মাদরাসা চালু করেছিলেন।
তবে ততকালীন সময়ে ব্যাপকভাবে আলিয়া এবং কওমী নেসাবের সিলেবাস ও আমল আখলাকের দূরত্বও খুব বেশি ছিলনা। পরবর্তীতে এখানে চরমোনাই দরবারের সম্প্রসারক ও পীর আল্লামা সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. কওমী নেসাবের মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত করেন এবং দুই ধারার শিক্ষাব্যবস্থার বৃহৎ দুটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে জামেয়া কায়েম করেন এবং আমৃত্যু রঈসুল জামেয়ার মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে যান।
তার ইন্তেকালের পরে বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির (বামুক) তত্বাবধানে পরিচালিত এই জামেয়ার রঈস হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন আমীরুল মুজাহিদীন মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম (হাফিযাহুল্লাহ) এবং নায়েবে আমীরুল মুজাহিদীন মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম (হাফিযাহুল্লাহ) নাযেমে আলা’র দায়িত্ব পালন করছেন।
আলিয়া শাখার প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ পেয়ে সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন আইএবি-র প্রেসিডিয়াম সদস্য মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল -মাদানী। বর্তমানে চরমোনাই জামেয়ার শিক্ষাক্রমে কিরাআতুল কুরআন আম (উন্মুক্ত), কিরাআতুল কুরআন খাছ (বিশেষায়িত), হিফজুল কুরআন, কওমী নেসাবে দাওরায়ে হাদীস এবং উচ্চতর তাখাছছুসাতে আদাবুল আরাবি (আরবী সাহিত্য), ইফতা (ইসলামী আইন অনুষদ) এবং তাফসীর বিভাগ চালু রয়েছে।
আলিয়া নেসাবে কামীল (টাইটেল) ফিকহ্ ও তাফসীর পর্যন্ত চালু রয়েছে। এছাড়া বিজ্ঞান বিভাগও রয়েছে। মহিলা শাখায় হিফজ, কিরাত এবং দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত চলমান আছে। জামেয়ার আলিয়া ও কওমী শাখা যথাক্রমে কামীল হাদীস ও দাওরায়ে হাদীস মানে উত্তীর্ণ হয় ১৯৭০ ও ১৯৯৮ সালে।
ছাত্র সংখ্যা আলিয়া শাখায় প্রায় ২৫০০ এবং কওমী শাখায় ২৭০০ এর বেশি আছে এবং মহিলা শাখায় ছয় শতাধিক ছাত্রী সহ প্রায় ছয় হাজার শিক্ষার্থী নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষা গ্রহণ করছে।
জামেয়ার শিক্ষার গুণগত মান ও মেধাতালিকায় কওমী শাখার অবস্থান বেফাকুল মাদারিসীল আরাবিয়ার অধিনে শীর্ষ ১০ এর মধ্যে আছে। এবং আলিয়া শাখার সর্বশেষ পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী ১০০% পাসের হার সহ একাধিক বার সরকারিভাবে দেশসেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুরস্কার পাবার গৌরব অর্জন করেছে। মহিলা শাখায় সর্বশেষ ২০১৮ সালের বেফাকের কেন্দ্রীয় পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী স্নাতকোত্তর স্তরে সারাদেশে ১ম,২য়,৪র্থ ও ১২ তম মেধা তালিকা সহ উল্লেখযোগ্য অবস্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
জামেয়ার উভয় শাখায় ১৩০ জন শিক্ষক ও বিভিন্ন সেক্টরের মুলাযিমীন সহ প্রায় ১৬৫ জন স্টাফ রয়েছেন। শিক্ষকদের বেতনভাতা ও কোয়ার্টার সুবিধাও সঙ্গতিপূর্ণ।
জামেয়ার আবাসন ও খাবারের মানও উন্নত। আবাসিক সকল ছাত্রদের জন্য জামেয়ার তরফ থেকে দুই বেলা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, কিতাব পত্র সহ প্রাথমিক চিকিৎসা ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। দারুল উলূম দেওবন্দের নমুনায় মেধা তালিকায় উত্তীর্ণ ছাত্রদের পড়াশুনার সুবিধা লক্ষ্য করে বিশেষ কামরার ব্যবস্থাও এদেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে বিশেষত্ব দিয়েছে।
প্রতিষ্ঠাকালের বিবেচনায় চরমোনাইর দ্বীনি মাদরাসার বয়স শতাব্দীকাল ছুঁইছুঁই। এই সুদীর্ঘ সময়ে চরমোনাই জামেয়া জাতিকে দিয়েছে অনেক সুফল। বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে এই জামেয়ার খেদমত। দেশের ধর্মীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন সেক্টর সহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এই জামেয়ার কৃতী সন্তানদের ব্যপক ভিত্তিক খেদমত সুনামের সঙ্গে চলমান রয়েছে। শিক্ষাবোর্ড, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অসংখ্য কমপ্লেক্স ও ফাউন্ডেশনের বিশিষ্ট পদেও আসীন আছেন চরমোনাই জামেয়ার কৃতী সন্তানরা।
এই জামেয়া যেমনিভাবে শাইখুল হাদীস, মুফতি ও মুফাসসির তৈরি করে তেমনিভাবে রাষ্ট্রচিন্তক, লেখক ও গবেষক তৈরিতেও উপমাহীন। গতানুগতিক চিন্তাধারা থেকে অগ্রসর হয়ে ক্রিয়াশীল সকল উদ্যোগ ও আন্দোলনে এই জামেয়া বৈশিষ্ট্যের দাবীদার।
তালীম, তাযকিয়া তাবলীগ ও জিহাদের সমন্বিত প্রয়াস এই জামেয়ার মূল লক্ষ্যের অন্তভুর্ক্ত হওয়ায় এখানকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যতিক্রমী হওয়াটা সহজাত। মুসলিম মিল্লাতের জন্য চরমোনাই জামেয়ার অবদান হিসেবে এটা কি বিশাল নয় যে, দুই দুই জন আমীরুল মুজাহিদীন এই জামেয়ার সন্তান। বিশ্বমানের ইসলামিক স্কলার দুই দুই জন নায়েবে আমীরুল মুজাহিদীন এই জামেয়ারই সন্তান। দেশ বিদেশে বরেণ্য এমন হাজারো কীর্তিমান রয়েছেন যারা চরমোনাই জামেয়ার শিক্ষার্থী পরিচয় দিতে গর্বিত বোধ করেন।
সুতরাং চরমোনাই জামেয়া এদেশ ও জাতির সম্পদ ও গৌরব। এ জাতির উচ্চাশা ও স্বপ্নের এ বিদ্যাপীঠ যুগে যুগে উম্মাহর প্রয়োজনে অগ্রণী ভূমিকায় থেকেছে এবং থাকবে। দাওয়াত, তাবলীগ, ফিকর এবং তাযকিয়ার মেহনতে অতীতের মত ভবিষ্যৎও উজ্জ্বল করবে। এই কামনা।
লেখক, তরুণ আলেম ও আলোচক
আই.এ/