

জ্যাক ম্যা। প্রযুক্তি ও ব্যবসা জগতের যে ক’জন মানুষ কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাদের মাঝে সবচেয়ে পরিচিত মুখ তিনি । প্রায় সাড়ে তিন’শ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের কোম্পানি আলিবাবা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা তিনি।
ফোর্বসের ‘রিয়াল টাইম নেট ওর্থ’ এর হিসেব অনুযায়ী যার বর্তমান সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় চল্লিশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এশিয়ার শীর্ষ সারির ধনী এই চীনা মানুষটি পুরো পৃথিবীর সকল ছোট-বড় ব্যবসায়ী কিংবা উদ্যোক্তার কাছে একজন আদর্শ এবং অনুপ্রেরণার নাম। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হওয়া, অপমানিত হয়ে ফেরৎ আসা, মাত্র দশ (১০) ডলার বেতনের চাকরির মাধ্যমে পেশাগত জীবন শুরু করা এই মানুষটার বিভিন্ন বাধার মধ্য দিয়ে সামনে এগিয়ে গেছেন। তার এই নিরন্তর পথচলা সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?
জ্যাক ম্যা এর জীবনী শুধু সাফল্যগাথা কিংবা ব্যর্থতার নয়। জ্যাক ম্যার জীবনী একটি ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস আর অনুপ্রেরণা। চরম দুরাবস্থা আর ব্যর্থতার মাঝে স্বপ্ন আর আশার আলো জ্বেলে রাখার উদাহরণ। বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসা বানিজ্যকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে যে কয়জন মানুষের অবদান সবচেয়ে বেশি – জ্যাক ম্যা তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ফোর্বস ম্যাগাজিন তাকে প্রায় প্রতি বছরই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী মানুষদের একজন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
২০১৭ সালে বিখ্যাত ফরচুন ম্যাগাজিন জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে শীর্ষ নেতাদের তালিকা তৈরি করে। যেখনে জ্যাক ম্যা ২য় অবস্থান অর্জন করেন। অথচ এই মানুষটিই একসময় ছোট একটি চাকরির জন্য ছোট-বড় বহু কোম্পানির দ্বারে দ্বারে গিয়েও খালি হাতে ফিরে এসেছেন। আজ তিনিই আগামী কয়েক দশকের মধ্যে পুরো পৃথিবীতে একশত মিলিয়ন কর্মসংস্থান তৈরির পরিকল্পনা করেছেন।
চলুন জেনে নিই তার সংগ্রামী জীবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
যদি আপনিও স্বপ্ন দেখেন নিজের চেষ্টা, মেধা, আর শ্রম দিয়ে একদিন নিজেকে ও পৃথিবীকে বদলে দেয়ার তবে জ্যাক ম্যা এর জীবনী দারুণ এক উপজীব্য হতে পারে। ‘জ্যাক ম্যা ইউন’ এর জন্ম হয় ১৯৬৪ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর চীনের শি-চিয়াং প্রদেশের হাংযু শহরের এক দরিদ্র পরিবারে। তার বাবা-মা ছিলেন পেশাদার গল্প বলিয়ে ও সঙ্গীত শিল্পী। বর্তমানে এই পেশা চীনে বেশ সম্মানজনক হলেও তখন এই পেশায় আয় রোজগার খুব বেশি হত না।
ছোটবেলার সেই দুঃসহ জীবনের ঘটনা বলতে গিয়ে আবেগী কণ্ঠে টেলিভিশন সাক্ষাতকারে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমার পরিবারের ছয়জন সদস্য ছিলো, আমার বাবা’ই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মাসিক আয় ছিলো সাত ডলার, আমরা বছরে একবারই মুরগী খেতে পেতাম’।
দুই ভাই ও এক বোনের মাঝে দ্বিতীয় ‘জ্যাক ম্যা’ যে জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়ে আজ এ পর্যায়ে আসবেন – তা তার পরিবারের কেউ স্বপ্নেও হয়ত ভাবেনি। শুধু তাই নয়, আলিবাবা গ্রুপের অন্যতম সফল আর্থিক লেনদেন প্রতিষ্ঠান ‘আলি-পে’ যখন যাত্রা শুরু করে তখন অনেকে হাসাহাসি করে বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছিলো এমনকি বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন জ্যাক ম্যাকে ‘পাগল জ্যাক’ আখ্যা দিয়েছিল। তার ঐ প্রোজেক্ট সফল হবার পর একবার ঐ ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে জ্যাক বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি পাগল হওয়া ভালো। কারণ আমরা পাগল, কোনো বোকা নই, কারণ আমরা জানি আমরা কি করছি’।
১৯৬৪ সালে জন্ম নেওয়া জ্যাক ছোটবেলা থেকেই কৌতুহলী বিষয়সমূহ শেখার প্রতি বেশ আগ্রহী ছিল। তা বোঝা যায় তার ইংরেজি ভাষাভাষীদের সাথে কথা বলার মাধ্যমে নিজের ইংরেজি বলার দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টার গল্প শুনলেই। তরুণ জ্যাক বাড়ি থেকে প্রায় চল্লিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন স্থানীয় পর্যটন নগরী হাংযুতে বিভিন্ন নামকরা হোটেলে আসতেন বিদেশিদের সাথে কথা বলার জন্য। দীর্ঘ সময় কথোপকথন চালিয়ে যাবার জন্য তিনি কোনো টাকা ছাড়াই শহর ঘুরিয়ে দেখাতেন। একনাগাড়ে পুরো নয় বছর তিনি এই কাজ করে গেছেন। দীর্ঘ সময়ের ভ্রমণসঙ্গী হবার সুবাদে বেশ কিছু পর্যটকের সাথে তার সুসম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। জ্যাক ম্যার আসল নাম কিন্তু ‘ম্যা ইউন’।
এ নামের উচ্চারণ কষ্ট সাধ্য হওয়ায়, এক পর্যটক তাকে জ্যাক নামে ডাকা শুরু করে। কালক্রমে জ্যাক নামেই তিনি সর্বাধিক সমাদৃত হোন। আলিবাবায় সফলতার আগে জ্যাক ম্যা জীবনের কঠোরতা বেশ ভালোভাবেই টের পেয়েছিলেন । ৪বার ফেল করে কলেজে ঢোকার পর, যখন পাশ করে বের হলেন– তখন ব্যর্থতা কাকে বলে, তা তিনি আবারও বেশ ভালোই টের পেলেন।
জ্যাক ম্যা’র জীবন কাহিনীর সবচেয়ে করুণ, কিন্তু শক্তিশালী অংশ এটি। তিনি ১৯৮৮ সালে তৎকালীন হ্যাং-চাও টিচার্স ইন্সটিটিউট এর ইংরেজী বিভাগ থেকে বি.এ ডিগ্রী অর্জন করেন। এর পর ২০০৬ সালে বেইজিং এর ‘চিউং-কং গ্রাজুয়েট স্কুল অব বিজনেস’ থেকে ব্যবসায় শিক্ষায় ডিগ্রী নেন। উচ্চশিক্ষার পরও চাকরি পাচ্ছিলেন না জ্যাক। এমনকি তিনি একটি রেস্টুরেন্টে ম্যানাজারের চাকরির জন্যও আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তাও হয়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী পড়ানোর চাকরী পান। মাসে ১০ ডলার বেতন পেতেন জ্যাক।
জ্যাকের ব্যর্থতার গল্পের শুরু কলেজে ভর্তি হবার সময় থেকেই। চীনে জাতীয় কলেজে ভর্তির জন্য বছরে একবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু জ্যাকের সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে অতিরিক্ত তিন বছর লেগেছিল। হার্ভাডে ভর্তির জন্য তিনি মোট দশবার আবেদন করেন, কিন্তু দশবারই প্রত্যাখ্যাত হন এমনকি তাকে ইন্টারভিউ এর জন্যেও ডাকা হয়নি। চাকরির বাজারেও বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে তাকে। ছোট-বড় প্রায় ত্রিশটি কোম্পানিতে আবেদন করেও কোনো চাকরি পাননি।
আমেরিকান এক টিভি প্রোগ্রামে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জ্যাক বলেন, ‘আমি পুলিশের চাকরির জন্য আবেদন করেছিলাম, কিন্তু সেখান থেকেও নাকচ করে দেওয়া হয়। এমনকি আমার শহরে কেএফসি আসার পর সেখানেও আমি আবেদন জানাই। সেখানে চব্বিশজন আবেদনকারীর মধ্যে আমি ছাড়া অন্য তেইশ জনই চাকরি পায়’।
এমনকি আলিবাবার সফলতার আগে তিনি দুটি উদ্যোগে বেশ খারাপভাবে ব্যর্থ হন। যদিও তিনি হাংযু তিয়ানচি ইউনিভার্সিটিতে প্রায় ছয় বছরের মতো ‘ইংরেজি’ এবং ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড’ বিভাগ দুটিতে শিক্ষকতা করেন। কিন্তু সেখানেও এই কাজগুলো করে তিনি আত্মতুষ্টি পাচ্ছিলেন না।
১৯৯৪ সালে তিনি প্রথমবারের মতো ইন্টারনেট নামক প্রযুক্তির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারেন। ১৯৯৫ সালের প্রথম দিকে ব্যবসায়িক কাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেলে জ্যাক সেখানে এক বন্ধুর সহযোগিতায় ইন্টারনেটের প্রথম পাঠ নেন। তখন তিনি ইন্টারনেটে ‘বিয়ার’ লিখে সার্চ দিয়ে নানা রকম তথ্য পান। তার মধ্যে বিভিন্ন দেশের বিয়ার সম্পর্কে তথ্য থাকলেও চীনের কোনো ওয়েবসাইট থেকে এ বিষয়ে কোনো তথ্য তিনি দেখতে পাননি। এমনকি নিজের দেশের কোনো তথ্য ইন্টারনেটে সার্চ দিয়েও না পেয়ে হতাশ হন জ্যাক।
পরে নিজেই অন্য এক বন্ধুর সহযোগিতায় একটি সাধারণ ওয়েবসাইট তৈরি করেন। ওয়েবসাইটটি প্রকাশ করার মাত্র ঘণ্টা পাঁচেকের মধ্যে তিনি বিভিন্ন জনের কাছ থেকে শুভেচ্ছা বার্তা পান। এটিই মূলত ইন্টারনেট ভিত্তিক ব্যবসা করার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে তার জন্য। সে বছরই দেশে ফিরে জ্যাক তার স্ত্রী জ্যাং ইং এর সহযোগিতায় বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে প্রায় বিশ হাজার ইউএস ডলার সংগ্রহ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের একজন বন্ধুর সহযোগিতায় ‘চায়না ইয়েলো পেইজ‘ নামের একটি কোম্পানি তৈরি করেন।
মূলত তাদের কাজ ছিল চীনের বিভিন্ন কোম্পানির জন্য ওয়েবসাইট তৈরি করে দেয়া; যদিও জ্যাক প্রোগ্রামিং এর কিছুই জানতেন না। জ্যাক ম্যা’র ওই ওয়েবসাইটটিকে বলা হয় চীনের প্রথম ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এই ইন্টারনেটভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি চীনা ব্যবসায়ীদের মন গলাতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে তিনি নিজের সতেরজন ছাত্র ও বন্ধুকে একত্রে করেন আলিবাবা নামের ওয়েবসাইটটি তৈরী করার জন্য। এভাবেই শুরু হয় আলিবাবার পথচলা।
তাদের এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল, চীন এর আভ্যন্তরীণ ই-কমার্স মার্কেটকে উন্নত করা। এবং সেই সাথে, চীন দেশের ক্ষূদ্র ও কুটির শিল্পকে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগীতায় এগিয়ে যেতে সাহায্য করা। আলিবাবা নামের ওয়েবসাইটটিতে রপ্তানীকারকরা নিজেদের পণ্যগুলো সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করতে পারে। আর আমদানিকারকরা এই তথ্যগুলো সম্পর্কে জেনে ক্রয়ের বিষয়ে আলোচনা করতে পারে। এক বছরের মধ্যেই গোল্ডম্যান শেকস ও সফটব্যাংক জ্যাক ম্যা’র এই উদ্যোগে মোট ২৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে।
ইন্টারনেট ও তথ্য-প্রযুক্তি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু না জানলেও কিভাবে ই-কমার্স বাণিজ্যের গুরু হয়ে উঠলেন জ্যাক মা? এই প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছেন তার শুরুর দিকের এক সহকর্মী পোর্টার এরিস ম্যান। এরিস ম্যান বলেন, ‘জ্যাক খুব ভালো বক্তা। ও নিজের স্বপ্নগুলো সকলের মধ্যে খুব সহজেই ছড়িয়ে দিতে পারে। জ্যাক আমাদেরকে সবসময় বলতো, আমরা সবাই তরুণ এবং কখনোই নিজেরা লড়াই থেকে সটকে পড়ব না’। এই কোম্পানিটিই বর্তমান বিশ্বে ই-কর্মাসের সফলতার দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
আলিবাবার মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওপর ভিত্তি করেই জ্যাক চীনের সবচেয়ে ধারাবাহিক ধনী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। আলিবাবা এর নামকরন এর ইতিহাস বলতে গিয়ে, জ্যাক বলেছিলেন, ‘শুরু করার সময়ে আমার মনে হয়েছিল- ইন্টারনেট যেহেতু একটি বৈশ্বিক ব্যাপার, আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামটিও বৈশ্বিক হওয়া উচিৎ, সেইসাথে নামটি যেন সহজেই চেনা যায়।
সেই সময়ে Yahoo নামটি ছিল সেরা– আমি অনেক দিন ধরে এমন একটি নাম বের করার চেষ্টা করছিলাম । তারপর হঠাৎ মনে হল আলিবাবা নামটি ভালো হতে পারে। সৌভাগ্যবশত , চিন্তাটি মাথায় আসার সময়ে আমি সান ফ্রান্সিসকোতে একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম। ওয়েট্রিস খাবার সার্ভ করতে এলে, আমি তাকে বললাম আলিবাবাকে চেনে কিনা। সে বলল সে চেনে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আলিবাবা কি? – সে বলল ‘এটা তো সবাই জানে, আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’! অসাধারণ!
জ্যাক বলেন, ‘রাস্তায় বের হবার পর আমি প্রায় ২০ জন মানুষকে আলিবাবা সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। সবাই আলিবাবা ৪০ চোর ও তাদের গুপ্তধন– সবই জানে। আমি বুঝে গেলাম এটা আসলেই দারুন একটা নাম হতে পারে। বলতে গেলে সবাই এটা একবারে ধরতে ও মনে রাখতে পারবে, আর নামটাও শুরু হয় A দিয়ে’।
এদিকে ১৯৯৯ সালের অক্টোবর এবং ২০০০ সালের জানুয়ারিতে পর পর দু’বার ২৫ মিলিয়ন ডলারের বিদেশী উদ্যোগের মূলধন বিনিয়োগ পেয়ে আস্তে আস্তে জ্যাক তার কোম্পানিকে গ্লোবাল ই-কমার্স সিস্টেমের আওতায় উন্নীত করার চেষ্টা করেন। সে প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ২০০৩ সালে Taobao Marketplace, Alipay, Ali Mama এবং Lynx নামের চারটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
এর মধ্যে টাওবাও মার্কেটপ্লেস বেশ দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। সে সময় বৃহত্তর ই-কমার্স জায়ান্ট ই-বে আলিবাবাকে চড়া দামে কিনে নেয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু জ্যাক ম্যা তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন বরং ইয়াহুর সহ-প্রতিষ্ঠাতা জেরি ইয়াং থেকে পাওয়া এক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ নিয়ে তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানটি আরো দক্ষতার সাথে পরিচালনা করতে থাকেন। তার সঠিক সিদ্ধান্ত, বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ এবং হাল ছেড়ে না দেয়ার ফলাফল হিসেবে আলিবাবা বর্তমানে বিজনেস-টু-বিজনেস, বিজনেস-টু-কাস্টমার এবং কাস্টমার-টু-কাস্টমার সার্ভিস দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো এখন দৈনিক কয়েকশ বিলিয়ন ডলার অর্থ লেনদেন করছে।
অন্যদিকে আলি পে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ‘ফিনটেক’ বা ফাইনানশিয়াল টেকনোলজি কোম্পানী, যার বর্তমান মার্কেট ভ্যালু ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি! – মূলত এই আলি-পে’র আইডিয়ার কারণেই জ্যাক ম্যাকে বিখ্যাত টাইমস ম্যাগাজিন পাগল খেতাব দিয়েছিল। বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় মোবাইল এবং অনলাইন পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আলিবাবা নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ এ আইপিও ছাড়ে। এর মাধ্যমে তারা ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ পায়! এটি আমেরিকার অর্থনৈতিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ আইপিওর ঘটনা– যা স্বয়ং আমেরিকার কোনো কোম্পানীও করে দেখাতে পারেনি। বর্তমানে আলিবাবা গ্রুপের অধীনে মোট ৯টি বড় কোম্পানী রয়েছে।
- ২০১৭ সালে জ্যাক ম্যা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং আগামী দশ বছরে আমেরিকার বাজারে ১ মিলিয়ন চাকরি সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দেন।
ইন্টারনেট সংযোগ নেয়ার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রথম যেদিন আমি ইন্টারনেট কানেকশন নিই, সেদিন আমি আমার বন্ধুবান্ধব ও কিছু সাংবাদিককে দাওয়াত করেছিলাম। খুবই ধীরগতির একটি ডায়াল আপ কানেকশন সেট করে আমি ইন্টারনেট চালু করি। প্রথম পেজটির অর্ধেক লোড হতেই সাড়ে ৩ ঘন্টা লাগে। এই সময়টা আমরা খাওয়াদাওয়া, আড্ডা ও বিনোদন করে কাটিয়েছিলাম। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সার্থক হয়েছিলো। আমি তাদের কাছে প্রমাণ করেছিলাম যে, ইন্টারনেট বলতে সত্যিই কিছু আছে!
এক সাক্ষাৎকারে জ্যাক বলেছিলেন, ‘২০০৩ সালে যখন আমরা ‘তাওবাও’ শুরু করি, তখন আমার টিমের সবাইকে বলা হয়েছিল, বাসায় গিয়ে বিক্রী করার মত ৪টি জিনিস নিয়ে আসতে। আমাদের বেশিরভাগই বিক্রী করার মত ৪টি জিনিস বাসায় খুঁজে পাইনি। কারণ আমরা আর্থিক ভাবে খুবই দরিদ্র ছিলাম’।
চলতি বছর ৯ সেপ্টেম্বর আলিবাবা থেকে পুরোপুরি অবসর নিয়ে শিক্ষার প্রসার ও মানব সেবার কাজে মনোনিবেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন জ্যাক। এর আগে তিনি আলিবাবার সিইও পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নির্বাহী চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। জ্যাক ম্যা’র কথা অনুযায়ী ‘প্রতিটি সফল মানুষের ৫০ বছর বয়স হওয়ার পর অর্থের চিন্তা ছেড়ে দিয়ে মানব সেবা ও নতুনদের সফল করার কাজে মনোনিবেশ করা উচিৎ’।
হতাশা ব্যাপারটা খুব সহজেই মানুষকে আঁকড়ে ধরে। একজনকে মানসিকভাবে নিঃস্ব করার জন্য এর বিকল্প নেই বললেই চলে। আর আমরাও বিভিন্ন ব্যর্থতা, আর্থিক বা অন্য কোনো অসচ্ছলতার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে খুব সহজেই হতাশ হয়ে পড়ি। নিজের ভালো লাগার কাজগুলো থেকে দূরে চলে যাই। বড় বড় স্বপ্নে বিভোর হয়ে থেকে ছোট ছোট সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে ভুলে যাই। কয়েকবার চেষ্টা করার পর হাল ছেড়ে দেই।
আর এই জায়গাতেই জ্যাক মা সবার চেয়ে আলাদা। তার সফলতার পেছনে অনেকগুলো ব্যর্থতার গল্প আছে, তা আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি। তিনি বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েও হাল ছেড়ে দেননি, বরং শেখার এবং ছোট ছোট সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে বড় কিছু তৈরি করার দিকগুলোতে বেশ সময় দিয়েছেন।
জ্যাক মার মতে, ‘আপনি যদি হাল ছেড়ে না দেন, তাহলে সামনে জয়ী হওয়ার আরো সুযোগ পাবেন। তিনি আরো বলেন, ‘আপনি যদি চেষ্টা না করেন তাহলে কোনো কিছুই সম্ভব নয়, আর যদি চেষ্টা চালিয়ে যান তাহলে সফল হবার আশা এখনও আছে’।
অর্থাৎ তিনি হাল ছেড়ে না দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে বলেছেন। এক জায়গায় ব্যর্থ হলেও, আরেক জায়গায় চেষ্টা করার কথা বলেছেন। তিনি বারবার ধৈর্য ধারণ করার কথা বলেছেন। নিজের পছন্দের কাজের প্রতি আসক্ত হবার কথা বলেছেন। ছোট ছোট কাজ দ্বারা এগিয়ে যাবার মাধ্যমে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখতে উৎসাহী করেছেন। জ্যাক ম্যা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ না হয়েও দেখিয়ে দিয়েছেন, কীভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশাল সাম্রাজ্য তৈরি করা যায়।
এ ব্যাপারে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি প্রযুক্তি বোদ্ধা নই। আমি এটাকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে দেখি ও ক্রমাগত এটিকে উন্নততর করার কাজ চালিয়ে যাই।
পণ্যের উপর নির্ভরশীল ব্যবসাগুলোতে তার সফলতার মূল কারণ তার দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি বারবার প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর লক্ষ্য না রেখে গ্রাহকদের চাহিদার উপর লক্ষ্য রেখে তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছেন। সর্বোপরি, সবার মতো তিনিও ক্রেতাদের খুশি রাখার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি সবসময় ক্রেতাদের খুশি রাখার চেষ্টায় থাকি। এটি একারণেই যে, আমি জানি ক্রেতা খুশি থাকা মানে আমার ব্যবসা খুশি, আমার ব্যবসা খুশি মানে শেয়ারহোল্ডাররা খুশি’। এই একটি কথা থেকেই তার ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি বেশ দৃঢ়ভাবে ফুটে উঠেছে!
লেখক: ফয়সাল আরেফিন
শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক ভয়েসের জবি প্রতিনিধি
/এসএস