

ফারজানা ইসলাম মিম
কুরবানি একটি ফজিলতময় ইবাদত। এটা মুসলিম উম্মাহর সমুন্নত ঐতিহ্যের একটি অন্যতম নিদর্শন। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহীম আ. এর ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার অনুপম দৃষ্টান্ত হলো কুরবানি। আল্লাহর প্রিয় বন্ধু হযরত ইবরাহীম আ. স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে একমাত্র পুত্র ইসমাইলকে আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করার কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তখন থেকেই তাদের ত্যাগের অবিস্মরণীয় স্মৃতিকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজে কুরবানি বা ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়ে আসছে। ইসলামের পরিভাষায় প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত পশু আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে জবাই করাকে কুরবানি বলা হয়।
পবিত্র কোরআনে কুরবানির নির্দেশ
কুরবানি আল্লাহ প্রদত্ত একটি নেয়ামত। এতে আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত রয়েছে। কুরবানির পশু জবাই করার ক্ষেত্রে শরিয়তের নীতিমালার অনুসরণ করতে হবে। শুধু জবাই করলেই পশুর গোশত হালাল হয় না, বরং এ ক্ষেত্রে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা ওয়াজিব। তাহলে পশুর গোশত মুসলিম উম্মাহর জন্য হালাল হবে। তবে কোরবানির গোশত নিজে খাওয়া, আত্মীয়স্বজন ও গরিব-মিসকিনকে প্রদান করা সুন্নত। কারণ নবীজি সা. কুরবানির গোশতকে তিন ভাগে ভাগ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি ঘোষণা করে দাও মানুষের মধ্যে হজ্বের। তারা আসবে তোমার কাছে পায়ে হেঁটে এবং উটে চড়ে, যা আসবে দূরদূরান্ত থেকে যাতে তারা শামিল হয় তাদের লাভের ব্যাপারগুলোতে এবং স্মরণ করে আল্লাহর নাম গৃহপালিত চতুষ্পদ পশুর ওপরে, যা আল্লাহ দান করেছেন কতক নির্দিষ্ট দিনে। অতঃপর তোমরা নিজেরাও খাও এটা থেকে এবং গরিব অভাবীকেও খাওয়াও।’ (সূরা হজ : ২৭-২৮)। তিনি আরো বলেন, ‘আমি নির্ধারণ করেছি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানির নিয়ম; যাতে তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করে গৃহপালিত চতুষ্পদ পশুর ওপর’। (সূরা হজ : ৩৪)।
হাদিসের আলোকে কুরবানি
রাসুল সা. নিজেও কুরবানি করেছেন এবং উম্মতদেরও তা করার জন্য হুকুম দিয়েছেন। সেই সঙ্গে নিজের কুরবানির পশুকে নিজে জবাই করাকে সুন্নত বলেছেন। তবে বর্তমান সমাজে পশু জবাইকালে কুরবানিদাতারা মাওলানার অপেক্ষায় থাকেন। এমন অপেক্ষা জরুরি নয়। জবাই করার সুন্নত তরিকা জানা থাকলে নিজের কুরবানির পশু নিজেই জবাই করা উত্তম। হাদিসেও এর বর্ণনা রয়েছে। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আছে, ‘একবার রাসুলুল্লাহ সা. আদেশ দিলেন এমন একটি শিংদার দুম্বা আনতে যা কালোতে হাঁটে, কালোতে শোয় ও কালোতে দেখে, যাতে তিনি তা কুরবানি করতে পারেন। সুতরাং তাঁর জন্য এরূপ একটি দুম্বা আনা হলো। তখন তিনি বললেন, হে আয়েশা! ছুরিটি দাও, অতঃপর বললেন, পাথরে ছুরিটি ধারালো করো। আয়েশা বলেন, আমি তা করলাম। অতঃপর তিনি তা গ্রহণ করলেন এবং দুম্বাকে ধরলেন, এরপর তাকে কাত করে শোয়ালেন এবং জবাই করতে গিয়ে বললেন, ‘বিসমিল্লাহ’ হে আল্লাহ! তুমি এটা মুহাম্মদ, মুহাম্মদের পরিবার এবং মুহাম্মদের উম্মতদের পক্ষ থেকে কবুল করো। অতঃপর এটা দ্বারা তিনি লোকদের সকালের খানা খাওয়ালেন’। (মুসলিম : ৫২০৩)। হাদিসে আরও আছে, হযরত ইবনে ওমর রা. বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সা. মদিনায় ১০ বছর অবস্থান করেছেন আর বরাবর কুরবানি করেছেন’। (তিরমিজি : ১৫৮৯)।
ইসলামে কোরবানির ফজিলত
ইসলামে কোরবানির ফজিলত অপরিসীম। এটি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য লাভের অনন্য সোপান। হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাইল আ. এর ত্যাগের বিনিময়ে মুসলিম উম্মাহর ওপর এই কুরবানি সুন্নতরূপে অর্পিত হয়। কুরবানির গুরুত্ব সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ সা. এর হাদিস রয়েছে। যেমন হযরত যায়েদ বিন আরকাম রা. থেকে বর্ণিত, ‘একদা সাহাবারা রাসুল সা.-কে প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! কুরবানি কী? উত্তরে রাসুল সা. বললেন, এটা তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহীম আ. এর সুন্নত। তারা পুনরায় প্রশ্ন করলেন, এতে আমাদের জন্য কী প্রতিদান আছে? প্রতি উত্তরে রাসুল সা. বললেন, কুরবানির পশুর প্রতিটি লোমের বিনিময়ে এক একটি সওয়াব পাবে। পুনরায় সাহাবারা প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ সা.- উট বা দুম্বার পশমের কী হুকুম? তদুত্তরে নবীজি সা. বললেন, এসবেরও প্রতিটি পশমের পরিবর্তে নেকি পাবে’। (ইবনে মাজাহ : ৩২৪৭)।
রাসুল সা. আরো বলেন, ‘কুরবানির দিন কুরবানির রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় অন্য কোনো আমল আল্লাহর কাছে নেই। ওই ব্যক্তি কেয়ামতের দিন জবাইকৃত পশুর লোম, শিং, খুর, পশম ইত্যাদি নিয়ে আল্লাহ তায়ালার কাছে উপস্থিত হবে। কুরবানির রক্ত মাটিতে পতিত হওয়ার আগেই তা আল্লাহ তায়ালার কাছে পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পবিত্র মনে কোরবানি আদায় করো’। (তিরমিজি : ১৫৭২)।
লেখক: ফারজানা ইসলাম মিম, শিক্ষার্থী- মঠবাড়িয়া সরকারি কলেজ