

বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তিন ধরণের শিক্ষার প্রধান্য লক্ষ্য করা যায়। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে উপমহাদেশ তিন ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশেও তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত। জেনারেল, মাদরাসা ও কারিগরি। মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা আবার কয়েক ভাগে বিভক্ত। আলিয়া, কওমি ও ফোরকানিয়া। ফোরকানিয়া মাদরাসা মূলত কুরআন শিখার প্রাথমিক পাঠশালা। ফোরকানিয়ার বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক রুপ হলো হাফিজিয়া ও নূরানি মাদরাসা।
প্রতিষ্ঠার দিক থেকে বাংলাদেশে কওমি মাদরাসার প্রাতিষ্ঠানিক রুপ প্রাচীন হলেও আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে খুব বেশি সময়ের ব্যবধান নেই। ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্রগ্রামে দারুল উলুম মঈনুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসা বাংলাদেশের প্রথম কওমি মাদরাসা।
অপরদিকে বাংলাদেশে আলিয়া মাদরাসার গোড়াপত্তন ঘটে ১৯৪৭ সালে কলকাতা আলিয়া মাদরাসা ঢাকায় স্থানান্তরের মাধ্যমে। এর আগে ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে সুবেদার শায়েস্তা খানের উদ্যোগে ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে একটি মাদরাসা ও মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস পাওয়া যায়।
১৭৮০ সালে ইংরেজ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস সর্বপ্রথম মাদরাসা-ই আলিয়া নামে কলকাতায় আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ইংরেজ শাসনের প্রাথমিক পর্বে প্রচলিত ফার্সি ভাষায় রচিত আইন অনুসারে প্রশাসন পরিচালিত হতো । এ কারণে প্রশাসনের জন্য, বিশেষ করে বিচার বিভাগের জন্য আরবি, ফার্সি ও বাংলা ভাষায় দক্ষতার প্রয়োজন ছিলো। এ ছাড়া মুসলিম আইনের ব্যাখ্যা ও মামলার রায় দেওয়ার জন্য অনেক মৌলবি ও বিজ্ঞ মুফতির প্রয়োজন ছিলো। একই সঙ্গে মৌলবি ও মুফতিদের ইংরেজি ভাষায় জ্ঞান থাকারও প্রয়োজন ছিলো।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস মুসলমানদের জন্য একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদরাসাটি স্থাপন করা হয় কলকাতায়। মাদরাসার প্রথম হেড মাওলানা নিযুক্ত হন মাওলানা মাজদুদ্দীন। ওয়ারেন হেস্টিংস হিন্দুদের জন্য একটি সংস্কৃতি কলেজও প্রতিষ্ঠা করেন সে সময়।
ওয়ারেন হেস্টিংস এর নির্দেশে মৌলভি বাহরুল উলুম মোল্লা মজদুদ্দীন ইসলামি আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিয়ে কারিকুলাম প্রণয়ন করেন। পাশাপাশি গণিত, যুক্তিবিদ্য ও দর্শন অন্তর্ভুক্ত করা হয় পাঠ্য সিলেবাসে।
১৮২৯ সালে মাদরাসায় ইংরেজি বিভাগ খোলা হয়। নওয়াব আবদুল লতিফ ও সৈয়দ আমীর আলী ইংরেজি বিভাগের অন্যতম কৃতি শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৯০৭ সালে ৩ বছর মেয়াদী কামিল কোর্স চালু হয়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৮১৯ সাল পর্যন্ত ‘বোর্ড অব গভর্নরস’ দ্বারা মাদরাসা পরিচালিত হতো। ১৮১৯ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত ইংরেজ সেক্রেটারির পাশাপাশি মুসলমান সহকারি সেক্রেটারির অধীনে ‘বোর্ড অব গভর্নরস’ পরিচালিত হয়। ১৮৫০ সালে আলিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষের পদ সৃষ্টি হলে ড. এ. স্প্রেংগার মাদরাসার প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৮৫০ সাল থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ২৬ জন ইংরেজ কর্মকর্তা অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯২৭ সালে শামসুল উলামা খাজা কামালউদ্দীন আহমদ সর্বপ্রথম মুসলমান অধ্যক্ষ হিসেবে কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় যোগদান করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় আলিয়া মাদরাসা কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। ঢাকায় দাপ্তরিকভাবে ‘সরকারি মাদরাসা-ই আলিয়া, ঢাকা’ নামে পরিচালিত হলেও ঢাকা আলিয়া নামেই অধিক পরিচিত। ঢাকা আলিয়া মাদরাসার প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন খান বাহাদুর মাওলানা জিয়াউল হক। কলকাতা আলিয়া ঢাকায় স্থানান্তরিত হলেও কলকাতায় এখনো আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামে মাদরাসাটি বিদ্যমান রয়েছে।
বর্তমানে ঢাকা আলিয়ার অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন প্রফেসর সিরাজ উদ্দিন আহমাদ। ২০১৩ সালে প্রফেসর মোহাম্মদ একেএম ইয়াকুব হোসাইন এর বিদায়ের পর অধ্যক্ষের অবর্তমানে ‘সিরাজ উদ্দিন আহমাদ (ইনচার্জ)২০১৩’, ‘প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল আলী (ইনচার্জ) ২০১৩’, ‘প্রফেসর সিরাজ উদ্দিন আহমাদ (ইনচার্জ) ২০১৩-২০১৪’ এরপর ২০১৪ সালে অধ্যক্ষ পদে আসীন হন প্রফেসর সিরাজউদ্দিন আহমাদ।
ঢাকায় স্থানান্তরেরর পর প্রথমে লক্ষ্মীবাজারে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে কবি নজরুল সরকারি কলেজ)-এ মাদরাসার কার্যক্রম চলতে থাকে। পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ১৯৫৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকার বকশীবাজারে মাদরাসার চারতলাবিশিষ্ট নতুন ভবন ও ছাত্রাবাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে ১৯৬১ সালে লক্ষ্মীবাজার থেকে বকশীবাজারে নিজস্ব ভবনে মাদরাসা স্থানান্তরিত হয়।
২০০৬ সালে ফাজিল এবং কামিলকে ডিগ্রি এবং অনার্সের সরকারি মান ঘোষণা দেয়ার পর ঢাকা আলিয়া মাদরাসা কুষ্টিয়া ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত হয়। বর্তমানে ঢাকা আলিয়াসহ দেশের সব আলিয়া মাদরাসাকে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে।
ঢাকা আলিয়া মাদরাসায় বর্তমানে ১৩ টি অনুষদ রয়েছে। ২০১০ সালে মাদরাসায় অনার্স চালু করার পর ঢাকা আলিয়ায় কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আল-কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ, আল-হাদিস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ, দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ, আরবি এবং ইসলামের ইতিহাস এই চারটি বিষয়ে অনার্স কোর্সের পাঠদান চালু করে।
তবে ২০১৫-২৮ সেশন থেকে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে সারাদেশের আলিয়া মাদরাসাগুলোকে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়।
বর্তমানে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সারাদেশে ১ হাজার ৪৮টি ফাযিল মাদরাসা এবং ২০৬টি কামিল মাদরাসা রয়েছে। এরমধ্যে ৫২টি মাদরাসায় ৫টি বিষয়ে বিষয়ে অনার্সের পাঠদান করা হয়।
বর্তমানে সারাদেশে পূর্ণ সরকারি আলিয়া মাদরাসা রয়েছে চারটি। ঢাকা আলিয়া ছাড়া বাকি তিনটি হলো, ‘সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা’, ‘সরকারি মুস্তাফাবিয়া আলিয়া মাদরাসা, বগুড়া’ এবং ‘রাজশাহীর সরকারি মাদরাসা (আলিম)’।
এছাড়া সারাদেশে বর্তমানে ১ হাজার ৪৮টি ফাজিল মাদরাসা, ২০৬টি কামিল মাদরাসা, প্রায় ২৬ হাজার ইবতেদায়ি মাদরাসা ছাড়াও অসংখ্য দাখিল ও আলিম মাদরাসা রয়েছে। এর মধ্যে কিছু আছে স্বায়ত্বশাসিত, কিছু আধা সরকারি এবং এমপিওভুক্ত মাদরাসা রয়েছে।
এছাড়াও সারাদেশে পাঠদানের জন্য সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত বেশ কিছু প্রাইভেট মাদরাসা আছে। যেগুলো সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে চলে।
তথ্যসুত্র: উকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, সরকারি ওয়েবসাইট ও ইন্টারনেট।
শাহনূর শাহীন
যুগ্ম সম্পাদক, পাবলিক ভয়েস
/এসএস