
গত ১৭ জুন সন্ধায় হবিগঞ্জের পাট্টাশরীফে এলাকা থেকে অপহরণ হন দুলা মিয়া (৪৫) নামের এক ব্যক্তি। ১৮ জুন দুপুরে রাজধানীর হাজারীবাগের সিকদার মেডিকেল কলেজের পেছনে বুড়িগঙ্গা নদী থেকে পাটের বস্তায় মোড়ানো এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
অন্যদিকে দুলা মিয়ার ছোট ভাই ইদু মিয়া অপহরণের ঘটনায় চুনারুঘাট থানায় মামলা করেন। এরপর চুনারুঘাট থানা-পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে অপহরণের পর তাকে হত্যার লোমহর্ষক ঘটনা। জানা যায়, জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে দুলা মিয়াকে অপহরণ করিয়ে নিজের হাতে খুন করেছে তারই ভাতিজা র্যাব সদস্য মো. সাদেক মিয়া। সাদেক বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একজন ল্যান্সনায়েক, প্রেষণে ঢাকায় র্যাব-২-এ কর্মরত। তার গ্রামের বাড়িও চুনারুঘাটের পাট্টাশরীফে।
জানা যায়, র্যাব সদস্য সাদেকের চাচার কাছ থেকে তিন শতক জমি কিনেছিলেন দুলা মিয়া। সাদেক এই জমি নিজের দাবি করলে অস্বীকার করেন দুলা মিয়া। সাদেক এ নিয়ে মামলা করলে রায় পান দুলা মিয়া। এছাড়াও এর আগে একবার সাদেক মিথ্যা মামলা দিয়ে দুলা মিয়াকে গ্রেপ্তারও করিয়েছিলেন। তখন তাকে তিন মাস জেল খাটতে হয়েছিল। কিন্তু এতো কিছু করেও শান্তি পাচ্ছিল না সাদেক। এর পরই নিজের চাচাকে হত্যার পরিকল্পনা করে সাদেক। ১ লক্ষ টাকার বিনিময়ে চুক্তি করেন হত্যায় সহযোগীদের সাথে। এরপর চুনারুঘাট থেকে অপহরণ করে ঢাকায় এনে নিজের হাতে চাচা দুলা মিয়াকে হত্যা করেন সাদেক।
এঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। একজন হলেন দুলালকে অপহরণ করে নিয়ে আসা মাইক্রোবাসের চালক মো. ইউসুফ সর্দার এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত মো. মামুন মিয়া। আদালতে দেওয়া এই দুজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে র্যাব সদস্য সাদেক মিয়ার পরিকল্পনায় দুলা মিয়াকে অপহরণ ও হত্যার পুরো বিষয়টি উঠে এসেছে।
- পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মো. মামুন মিয়া বলেছেন, তিনি পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে আসছিলেন। এরই সূত্র ধরে বছরখানেক আগে র্যাব সদস্য সাদেকের সঙ্গে তার পরিচয়। গত ১৪ জুন সাদেক তাঁকে রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ডেকে নিয়ে দুলা মিয়াকে অপহরণ করে ঢাকায় নিয়ে আসতে বলেন। ১৬ জুন তাকে গাড়ি ভাড়াসহ অন্য খরচের জন্য ১৪ হাজার টাকা তুলে দেন। ১৭ জুন চালক ইউসুফসহ শামীম, বাদল, জামাল, জসিম, ওয়াহাবসহ সাতজন মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদের কাছে র্যাবের ক্যাম্পে যান। কিছুক্ষণ পর তিনি (মামুন) সেখানে গেলে সাদেক মিয়া বলেন, তাঁর ভাগিনা আফরাজ এলাকা থেকে দুলা মিয়াকে অপহরণ করে ঢাকায় নিয়ে আসতে সহায়তা করবে।
- মামুন জানিয়েছেন, তারা সাতজন মাইক্রোবাস নিয়ে বিকেল সাড়ে পাঁচটা-ছয়টার দিকে চুনারুঘাট পৌঁছান। সাদেকের কথা অনুযায়ী আফরাজ তাঁদের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা আফরাজদের বাড়ির সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে আফরাজ তাঁদের জানান দুলা মিয়া হলুদ লুঙ্গি, সাদা চেক শার্ট পরে টমটমে করে আসছেন। টমটম তাদের গাড়ির কাছাকাছি এলে জসিম, ওয়াহাব ও বাদল গাড়িটি থামান। নিজেদের ‘ডিফেন্সের লোক’ পরিচয় দিয়ে তাঁরা দুলা মিয়াকে গাড়িতে তোলেন। পানি খেতে চাইলে ঘুমের ওষুধ গুলিয়ে দুলা মিয়াকে খাইয়ে দেওয়া হয়।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ইউসুফ ও মামুন জানায়, রাত আনুমানিক ১২টার দিকে তারা দুলা মিয়াকে নিয়ে ঢাকায় র্যাব ২ ক্যাম্পের সামনে পৌঁছান। ফোন পেয়ে সাদেক ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এসে তাঁদের নিয়ে সিকদার মেডিকেলের পেছনে যান। সাদেক নির্দেশ দেন দুলা মিয়ার হাত-পা বাঁধতে। ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর ফলে দুলা মিয়ার শরীর এমনিতেই নিস্তেজ ছিল। জোর খাটানোর শক্তি পাননি। এরপর সাদেক নিজে মাছ মারার জাল দিয়ে দুলা মিয়ার গলায় প্যাঁচ দেন, নিস্তেজ হয়ে পড়েন তিনি। এরপর অন্যরা মিলে লাশটি বস্তায় ভরে সেটি বেড়িবাঁধের নিচে নদীতে ফেলে দেন।
দুলা মিয়াকে হত্যার পর মামুনকে আরো টাকা দেন সাদেক। এর মধ্যে গাড়িচালক ইউসুফকে সাড়ে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বাকি টাকা মামুনসহ অন্যরা ভাগ করে নেন।
এ ঘটনার পর হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা গত সোমবার র্যাব-২-এর অধিনায়কের কাছে চিঠি পাঠান। এতে তিনি বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাদেককে চুনারুঘাট থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হোক। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র্যাব ২-এর অধিনায়ক মো. আশিক বিল্লাহ বলেন, হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার তাকে বিষয়টি জানিয়েছেন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে মঙ্গলবার রাতেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নাজমুল হকের উপস্থিতিতে চুনারুঘাট থানা-পুলিশের কাছে সাদেক মিয়াকে হস্তান্তর করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের ধানমন্ডি অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. আব্দুল্লাহিল কাফী বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত বাকিদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলছে।
/এসএস

