

মুফতী ফয়জুল করীমের মতামতের সারসংক্ষেপ:
-সরকারের কোন অধিকার নেই কথা বলার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার।
-বক্তাদের উপর নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা এটা ইসলামের প্রচারকে বাধাগ্রস্থ করার প্রাইমারি পদক্ষেপ।
-বিদয়াতী শিরকপন্থী বক্তাদের বিষয়ে আমাদেরও আপত্তি আছে।
-তাদের সাথে মিলিয়ে হকপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ করাটা একটা অপকৌশল মাত্র।
সম্প্রতি ইসলামী আলোচক বিভিন্ন বক্তাদের নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনায় থেকে একটি আপত্তি জানিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বেশকিছু বিষয় নিয়ে ইসলামী আলোচকদের উপর আপত্তি তোলা হয়েছে। স্বরাষ্টমন্ত্রনালয় থেকে দেয়া এ আপত্তিপত্রের বিষয়ে বেশ কয়েকজন আলোচকের সাথে পাবলিক ভয়েসের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমীর মুফতী ফয়জুল করীম বেশকিছু মতামত দিয়েছেন। তিনি বলেন;
“এটা ইসলামকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি অপকৌশল মাত্র এবং দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করার প্রাইমারি পদক্ষেপ। এটা সুদূরপ্রসারি একটি পরিকল্পনা। এ ধাপে সফল হতে পারলে পরবর্তিতে ইসলামের পক্ষে কথা বলা সবার মুখ বন্ধ করার প্রচেষ্টা করা হবে বলে মনে করি”
“স্বরাষ্ট্রমন্ত্রলায়ের সে তালিকায় থাকা কিছু বক্তাদের ব্যাপারে তো আপনাদেরও অভিযোগ রয়েছে, বিষয়টা কিভাবে মূল্যায়ন করছেন” প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,
“কিছু ক্ষেত্রে আলোচনা করতে গিয়ে শরয়ী সমস্যা অনেকের দেখা যায়। সে বিষয়ে সম্পর্কে তাদেরকে আগে জানিয়ে সমাধান করে নিতে হবে। এবং তাদেরকে সতর্ক করতে হবে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই আইন করে দোয়া কোনভাবেই মানা যায় না” যে সব বক্তাদের আলোচনায় শরিয়তের ক্ষেত্রে বাধা আছে সেসবের ক্ষেত্রে তো আমাদেরও আপত্তি আছে। দেওয়ানবাগীর ব্যাপারে এদেশের সব ওলামায়ে কেরামদের আপত্তি আছে। এখন তাদের সাথে মিলিয়ে হকপন্থী বক্তাদের উপরও নিষেধাজ্ঞা দেয়ার প্রচেষ্টা করা এটা এক ধরণের অপকৌশল”
তিনি আরও বলেন, “সবার বক্তব্য মানার মতোও না আবার সবার বক্তব্য নিয়ন্ত্রণ করার মতোও না, এ বিষয়টা সবার খেয়াল রাখতে হবে” তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “যাদের ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামদের আপত্তি আছে তাদের বিষয়ে সরকারও জানে, কিন্তু তখন কোন পদক্ষেপ সরকার নেয়নি। কিন্তু এখন সরকার এসে সেসব “বিদয়াতি, মুশরিকপন্থী” বক্তাদের সাথে মিলিয়ে সমষ্টিগতভাবে ইসলামের পক্ষে যারা কথা বলে তাদের আওয়াজ বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে বলেই আমরা মনে করি” এটাকে আমি ইসলামের প্রচারের ক্ষেত্রে বাধা দেয়ার নবকৌশল বলে মনে করি, বলেন তিনি।
“সরকারের পক্ষ থেকে বা সরকারি প্রতিষ্ঠান ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে আপনাদের সাথে এ বিষয়ে কোন যোগাযোগ করা হয়েছে কি না” জানতে চাইলে তিনি বলেন;
“না, এ আপত্তিপত্র প্রকাশের আগেও আমাদের কিছু বলা হয়নি এবং এর পরও আমাদের কিছু জানানো হয়নি। মিডিয়ার আলোচনা থেকেই আমরা জেনেছি। এবং এতে আমরা সামান্যতমবিচলিতও নই”
“সরকারের সাথে আপনারা এ বিষয়ে কোন যোগাযোগ করবেন কি না” জানতে চাইলে তিনি বলেন,
“প্রশ্নই আসে না! সংবিধান আমাদেরকে অধিকার দিয়েছে কথা বলার, আমাদের বাকস্বাধীনতার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। আমরা কতটুকু বলতে পারবো_কতটুকু পারবো না সে বিষয়ে আমাদের সংবিধান অধ্যয়ন করা আছে। এমনকি সরকার নিজেও সংবিধানের অংশ। দেশের সংবিধান তো পরিবর্তন করা হয়নি যে, কতটুকু কথা বলা যাবে_কতটুকু বলা যাবে না। এক্ষেত্রে বরং সংবিধান লঙ্খণের দায়ে সরকারে অবৈধতা আরও বেশি করে প্রমানিত হবে যদি কথা বলার অধিকার কেড়ে নিতে চায়। আমাদের নিয়ন্ত্রণের এই অপকৌশল এটা অনেকটাই সংবিধান পরিপন্থী” এদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমাদের কথা বলার অধিকার রয়েছে। হ্যাঁ, শরিয়তের বাইরে কেউ কথা বললে তা নিয়ে আলেম ওলামারা সিদ্ধান্ত নেবেন। সরকার নয়। এটা সরকারের বরং বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে। সরকারের জন্য এ ধরণের নিয়ন্ত্রণের কোন ক্ষমতা নেই”। “ইসলামের নামের ভন্ডামিও শরিয়ত সমর্থন করে না সংবিধানও এটা সমর্থন করে না” আমরা চাই এটা বন্ধ হোক কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় সরকার আগাচ্ছে তা কোনোভাবেই সঠিক নয়, বলেন তিনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে আপত্তি জানিয়ে প্রকাশ করা প্রতিবেদনে দেয়া ১৫ জন বক্তার তালিকা
নির্দিষ্ট করে ১৫ জন আলোচকের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় আপত্তিপত্র দিয়েছে। পনেরোজন হলেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির মুফতি ফয়জুল করিম, জামিয়া রাহমানিয়া মাদরাসার শাইখুল হাদিস আল্লামা মামুনুল হক, জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া, মোহাম্মদপুরের মুহতামিম মাওলানা মুফতি মাহমুদুল হাসান, ইসলামী ঐক্যজোটের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন, আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসূফ, মুফতি ইলিয়াছুর রহমান জিহাদী, মুজাফফর বিন বিন মুহসিন, মতিউর রহমান মাদানী, মাওলানা আমীর হামজা, মাওলানা সিফাত হাসান, দেওয়ানবাগী পীর, মাওলানা আরিফ বিল্লাহ, হাফেজ মাওলানা ফয়সাল আহমদ হেলাল, মোহাম্মদ রাক্বিব ইবনে সিরাজ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় তিন নম্বরে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের নাম রয়েছে। কওমি মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত গাইতে না দেওয়াসহ চারটি বিষয়ের ওপর তার মন্তব্য যুক্ত রয়েছে প্রতিবেদনে।
মাওলানা মামুনুল হকের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করার জন্য কল করা হলেও তিনি কল কেঁটে দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে তার একটি মন্তব্য পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, ‘দেশের একজন নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নিয়ে আমার কোনও মন্তব্য নেই। তবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে সেটি ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশি মুসলিম জাতিসত্তাবিরোধী একটি সাম্প্রদায়িক কবিতা।’ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন এই শিক্ষকের কথায়, ‘ঢাকার ওপর কলকাতার দাদাবাবুদের আধিপত্য খর্ব হতে দেখে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কবিতা রচনা করেছিলেন। ইসলামি চেতনার শিক্ষাগার কওমি মাদ্রাসাগুলো কখনোই রবীন্দ্রনাথের চেতনাকে মেনে নিতে পারে না।’
আপত্তির তালিকায় থাকা মাওলানা মুফতি মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমি তো ওয়াজ তেমন করি না। এমন কোনও বক্তব্য আমি দিইনি। কেন এমন বলা হলো বলতে পারবো না।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে ইসলামী ঐক্যজোটের সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি সাখাওয়াত হোসাইনের নাম রয়েছে। তার দেওয়া ‘মিয়ানমারের বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুসলমানদের ওপর জিহাদ ফরজ’ শীর্ষক বক্তব্য সংযুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া কাদিয়ানী প্রসঙ্গেও তার বয়ানের লিংক দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
রবিবার (৩১ মার্চ) রাতে মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, ‘আমরা সবসময় জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ওয়াজ মাহফিলে কথা বলে এসেছি। দেশে যখন জেএমবির উত্থান ঘটে তখন থেকেই প্রতিবাদ করে বক্তব্য রাখছি। সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে মাদকের বিরুদ্ধেও বক্তব্য রাখি ওয়াজ মাহফিলে। যারা প্রতিবেদন তৈরি করেছে তারা কী আমার এসব বক্তব্য শোনেননি।’ মিয়ানমার প্রসঙ্গে মুফতি সাখাওয়াত হোসাইনের ব্যাখ্যা, ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নিয়ে প্রতিবাদ করেছি। মিয়ানমার যখন আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিল, তখনও প্রতিবাদ করেছি। বলেছি, আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ব্যবস্থা নিক। বিভিন্ন সময়ে বলেছি, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ ও বাংলাদেশ সীমান্তে অস্থিরতা দূর করতে সেনাবাহিনী যদি যুদ্ধ করে আমরাও সহায়তা করবো।’ মুফতি সাখাওয়াত হোসাইনের উল্টো প্রশ্ন, ‘এখানে উগ্রতা কোথায়? আমি নিজের দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা আর দেশপ্রেম থেকেই বলেছি।’
প্রতিবেদনে উল্লিখিত বক্তাদের আরও কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে।
বক্তাদের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছয়টি সুপারিশ হলো:
১. ওয়াজি হুজুররা যেন বাস্তবধর্মী ও ইসলামের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সংহতিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন, সেজন্য তাদের প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণের ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন ও কমিউনিটি পুলিশের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ।
২. যারা ওয়াজের নামে হাস্যকর ও বিতর্কিত বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে ধর্মের ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট করার চেষ্টা চালান তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রো-অ্যাকটিভ উদ্বুদ্ধকরণ করা।
৩. অনেক আলেমের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রির মতো উচ্চশিক্ষা ব্যতীত যারা ওয়াজ করে তারাই জঙ্গিবাদ ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তাই মাদ্রাসায় উচ্চশিক্ষিত ওয়াজকারীদের নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসা।
৪. অনেকেই আছেন, যারা হেলিকপ্টারযোগে ওয়াজ মাহফিলে যোগ দেন এবং ঘণ্টাচুক্তিতে বক্তব্য দিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করেন। তারা নিয়মিত ও সঠিকভাবে আয়কর প্রদান করেন কিনা তা নজরদারির জন্য আয়কর বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব বিভাগে কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি করা।
৫. ওয়াজি হুজুরদের বক্তব্য স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক সংরক্ষণ ও পর্যালোচনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া এবং উস্কানিমূলক ও বিদ্বেষ ছড়ানোর বক্তব্য দিলে তাদের সতর্ক করা। প্রয়োজনে পরবর্তী সময়ে তাদের ওয়াজ করার অনুমতি না দেওয়া।
৬. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য প্রদানকারীদের আইনের আওতায় আনা।
তবে সামগ্রিক এ বিষয়টি নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন। এভাবে সমষ্টিগত প্রতিবেদন দেয়ার ক্ষেত্রেও আপত্তি প্রকাশ করেছেন অনেকে। তাছাড়া বক্তাদের আলোচনার মধ্য থেকে খন্ডিত বক্তব্য নিয়ে কোন সিদ্ধান্তে যাওয়ার ক্ষেত্রেও আপত্তি রয়েছে অনেকের।
[এ বিষয় নিয়ে পাবলিক ভয়েসের পক্ষ থেকে আরও প্রতেবেদন প্রকাশ করা হবে]
এইচআরআর/পাবলিক ভয়েস
আরও পড়ুন : শীর্ষ আলেমদেরকে বিতর্কিত করার প্রকল্প