

সামছ্ আল ইসলাম ভূঁইয়া
ইসলামের অন্যসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মত জিহাদও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জিহাদ বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী মুহাম্মদ (সাঃ) এর হাতেই সূচনা। তিনি অসংখ্য বনী আদমকে ধ্বংসের অতল গহ্বর থেকে টেনে এনে মুক্তির সন্ধান দিয়েছেন। উপহার দিয়েছেন শোষণ ও বঞ্চনাহীন একটি সোনালী সমাজ। জিহাদ সব প্রকার অত্যাচার, অনাচার ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি বড় প্রতিবাদ।
জিহাদকে অনুমোদনই দেয়া হয়েছে আত্মরক্ষার জন্য। অথচ আমাদের দেশে জিহাদ ও সন্ত্রাসকে এক করে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। এটা ইসলাম বিদ্বেষীদের একটা নোংরা হাতিয়ার। তাই জিহাদ নিয়ে অনেক সাধারণ মুসলিমরাও আছেন বিভ্রান্তিতে। তারা ইসলামকে মনে প্রাণে লালন করেন অথচ জিহাদ নিয়ে তাদের মনে তৈরি হয়েছে ঘৃণা।
জিহাদ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। অসংখ্য কুরআনের আয়াত ও রাসূলের সাঃ হাদিসের মাধ্যমে জিহাদের জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
জিহাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো-
সর্বোচ্চ চেষ্টা করা, সাধ্যের শেষ সীমা পর্যন্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা, কঠিন শ্রম ও শক্তি ব্যয় করা, কঠোর সাধনা ও কষ্ট স্বীকারে নিজেকে প্রস্তুত করা।
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় জিহাদ বলা হয়- আল্লাহর দ্বীনকে (ইসলামকে) বিজয়ী করার লক্ষে এবং একমাত্র আল্লাহকে খুশি করার জন্য কুফরী তথা ইসলাম বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে মুমিনের সকল প্রচেষ্টা (দৈহিক, মানসিক, আর্থিক, জ্ঞানবুদ্ধি) নিয়োজিত করাকে “জিহাদ” বলে। অর্থাৎ; স্বীয় নফসের বিরুদ্ধে, শয়তানের বিরুদ্ধে, ফাসেকদের বিরুদ্ধে এবং মুশরিক-মুনাফীক-কাফেরদের বিরুদ্ধে জান-মাল ও জবান দিয়ে লড়াই করাকে “জিহাদ” বলা হয়।
বুখারী শরীফের বিখ্যাত ব্যাখ্যাকারক আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন:
কাফেরদের সাথে সংগ্রাম করতে গিয়ে শক্তি ক্ষয় করা_এর (জিহাদ শব্দ) দ্বারা নিজের প্রবৃত্তি, শয়তান এবং দুরাচার সকলের সাথে সংগ্রাম করাকেও বুঝায়। এখানে প্রবৃত্তির সাথে জিহাদ বলতে দীনের শিক্ষাগ্রহণ করা, শিক্ষাদান করা ও নিজের জীবনে তা বাস্তবায়ন করা, শয়তানের সাথে সংগ্রাম বলতে তার আনীত সংশয় ও অযাচিত লোভ লালসা প্রতিরোধ করাকে বুঝায়। আর কাফেরের সাথে জিহাদ হাত (শক্তি প্রয়োগ), সম্পদ, কথা কিংবা অন্তর যে কোনটার মাধ্যমেই হতে পারে। এছাড়া দুরাচারীদের সাথে জিহাদ হাত দ্বারা(শক্তি প্রয়োগ) অতঃপর জবান তারপর অন্তর দ্বারা হতে পারে। (ফাতহুল বারী: জিহাদ ও শি’য়ার অধ্যায়)
ইমাম জুরজানী (রহঃ) বলেন: জিহাদ হল-সত্য দ্বীন তথা ইসলামের দিকে মানুষকে আহবান করা। (আত-তা’রীফাত)
আল্লামা কাসানী (রহঃ) বলেন: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের অর্থ হল- প্রচেষ্টা ও শক্তি ব্যয় করা কিংবা কোন কাজে সফল হওয়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় মুখের কথা, সম্পদ ও জীবন ইত্যাদি ক্ষয় করে সফলতার মানদন্ডে পৌছার জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার নামই জিহাদ।(আল বাদায়েউস সানায়া)
জিহাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য-
প্রচলিত মতবাদী সমাজ, রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক ব্যবস্থার অবসান এবং ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা, সংরক্ষণ, সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত করাই হলো জিহাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। কোন দুনিয়াবী স্বার্থ ছাড়া আল্লাহ তায়ালার বাণী তথা বিধানকে উচ্চকিত করা, মজলুম তথা অত্যাচারিতদেরকে সাহায্য করা এবং শত্রুদেরকে প্রতিরোধ করে তাদের হাত থেকে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে হেফাজত করা জিহাদের উদ্দেশ্য।
জিহাদের প্রকার ও স্তর-
জিহাদ প্রথমত ২ প্রকার। এবং জিহাদের প্রতিটি প্রকারের বেশ কিছু স্তর রয়েছে। জিহাদ বললেই অস্ত্র ব্যবহার করা বুঝায় না। জিহাদের প্রকার হলো-
১/ বাতেনি বা অপ্রকাশ্য জিহাদ
২/ জাহেরী বা প্রকাশ্য জিহাদ।
অপ্রকাশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ বলতে নফস ও শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ করা বুঝায়।
প্রকাশ্য শত্রু বিরুদ্ধে জিহাদ বলতে কাফির, মুশরিক, মুনাফিক ও জালিমদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা বুঝায়।
ক. নফসের সাথে জিহাদ করা-
নফসের সাথে জিহাদের অর্থ হল নিজের নফসকে আল্লাহর আনুগত্যের কাজে বাধ্য করা, ভাল কাজের প্রতি সর্বদা তাকে আদেশ করা এবং অসৎ কাজ হতে বারণ করা। নফসের সাথে জিহাদ ব্যতীত কেউ শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করতে সক্ষম হবে না।
খ. শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ করা-
শয়তান মানুষের আদি শত্রু। সে মানুষকে নানা অপকর্মের আদেশ করে থাকে। তাই শয়তানের সাথে সদা সংগ্রামে লিপ্ত থাকাও জিহাদ। শয়তানের আদেশ সর্বদা অমান্য করা এবং সে যা নিষেধ করে তাই-ই করা আমাদের কর্তব্য। এক হাদিসে প্রকাশ্য শত্রুর চেয়ে অপ্রকাশ্য শত্রুর সঙ্গে জিহাদ করা কে বড় জিহাদ বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেনঃ- জিহাদ করো আল্লাহর জন্য। যেমনিভাবে জিহাদ করা উচিত। ( সুরা হজ্ব, আয়াতঃ ৭৮)
উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইমাম কুরতাবী রহ. লেখেন- তোমরা জিহাদ করো তোমাদের নফসের বিরুদ্ধে। তাকে আল্লাহর অনুগত বানানোর এবং লালসা, কামনা, বাসনা থেকে বিরত রাখার জন্য, শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ কর তার প্ররোচনা প্রতিহত করার লক্ষ্যে, জালিমদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর জুলুম বন্ধ করার জন্য এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর তাদের কুফরীকার্য প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে।
এবং হাদিসে বলা হয়েছে, যে লোক স্বীয় নফসকে আল্লাহর অনুগত বানাবার লক্ষ্যে জিহাদ করল, সে একজন প্রকৃত মুজাহিদ। (মুসনাদে আহমাদ)
প্রকাশ্য জিহাদের স্তর তিনটি-
ক. সমাজ, রাষ্ট্র ও সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত অন্যায়কে মূলোৎপটনের লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন জিহাদের প্রাথমিক স্তর।
খ. মৌখিক শক্তি বা বাকশক্তি প্রয়োগ দ্বিতীয় স্তর।
গ. বাহুশক্তি প্রয়োগ তৃতীয় স্তর।
সত্য, ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠাই জিহাদের দাবী “তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর তোমাদের ধন-সম্পদ, জান-প্রাণ ও
বাকশক্তি (ভাষা ও সাহিত্য) দিয়ে। (আবু দাউদ)
জিহাদের শর্ত হলো ঈমানের তাগিদে ও ঈমানের ভিত্তিতে জিহাদ হতে হবে। যে জিহাদের পশ্চাতে ঈমানের তাগিদ নেই এবং ঈমানের ভিত্তিতে যে জিহাদ পরিচালিত হয় না, তা কখনই ইসলামী জিহাদ হতে পারে না। জিহাদের লক্ষ্য, পথ-পদ্ধতি হতে হবে ফী-সাবীলিল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা বলেন “ঈমান আনবে আল্লাহ ও তার রাসূলের ওপর এবং জিহাদ করবে আল্লাহর পথে। (সুরা ছফ, আয়াতঃ ১৯)
প্রকাশ্য জিহাদের ভাগ ২টি-
১/আক্রমণাত্মক জিহাদ।
২/আত্মরক্ষামূলক জিহাদ।
ইসলামী শরিয়তে আক্রমণাত্মক জিহাদ ফরজে কিফায়া। আক্রমণাত্মক জিহাদের হুকুম ইসলামী খিলাফতের পরবর্তী অবস্থায় প্রযোজ্য। ইসলামী খিলাফতের সংহতি ও মজবুতি বজায় রাখা এবং পরিধি বিস্তৃত করার স্বার্থে আগ্রগামী হয়ে জিহাদ করা।
আর আত্মরক্ষামূলক জিহাদ সর্বদাই ফরজে আইন।
কাফির ও তাগুত শত্রুর আক্রমণে ঈমান, ইসলাম ও মুসলিম ভূখন্ড আক্রান্ত হলে পর্যায়ক্রমে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলের জন্যই জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। এবং কোনো মুসলিম ভূখন্ডে কুফরী মতবাদ প্রতিষ্ঠিত থাকলে, তাগুতি শাসনব্যবস্থা বহাল থাকলে, সেই ব্যবস্থাপনাকে উৎখাত করে আল্লাহর শাসন ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা ফরজে আইন।
কয়েকটি অবস্থায় জিহাদ ফরজ হয়-
প্রথমত: যখন দু’টি দল (মুসলিম ও অমুসলিম) পরস্পর মুখোমুখি হয়। যুদ্ধ ছাড়া আর কোন শান্তিপূর্ণ পথ খোলা থাকে না তখন উপস্থিত ব্যক্তিদের সেখান থেকে পলায়ন করা বৈধ নয়। তখন উপস্থিত প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য আবশ্যক হয়ে যায় দৃঢ়পদ ও অবিচল থাকা।
দ্বিতীয়ত: যখন শত্রুবাহিনী কোন মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর আকস্মিক আক্রমণ করে তখন নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের উপর আবশ্যক হয়ে যাবে তাদের গতিরোধ করা। তারা যদি সক্ষম না হয় তাহলে, তাদের পার্শ্ববর্তী লোকদের উপর পর্যায়ক্রমে জিহাদ ফরজ হবে।
তৃতীয়ত: রাষ্ট্রপ্রধান যখন কোন সম্প্রদায়কে জিহাদে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন তখন জিহাদে যাওয়া আবশ্যক হবে। তবে, কারও কোন ওজর থাকলে ভিন্ন কথা।
জিহাদের একটা অংশ হল যুদ্ধ। কিন্তু আজকাল জিহাদ বলতে প্রথমেই এবং একমাত্রই যুদ্ধকে বুঝে বা বুঝানো হয়। অথচ যুদ্ধ হচ্ছে জিহাদের চুড়ান্ত স্তর। হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)!মহিলাদের কি কোন জিহাদ আছে? রাসুল (সাঃ)বললেন: মহিলাদের জন্য জিহাদ আছে কিন্তু, তাতে কোন যুদ্ধ নেই। আর তা হল- হজ্জ ও ওমরাহ আদায় করা। (ইবনে মাজাহ, দারে কুতনী, মুসনাদে আহমাদ) যুদ্ধ-বিগ্রহ, দাংগা-হাংগামা মানুষের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনে না। তবে, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে এটার দারস্থ হতে হয়। যখন যুদ্ধ ছাড়া সমাজকে শান্তিপূর্ণ রাখার আর কোন পথ অবশিষ্ট থাকে না তখনই বাধ্য হয়ে জিহাদের চুড়ান্ত স্তর যুদ্ধের মত কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। ঠিক তেমনি আল্লাহ তায়ালা জিহাদকে পবিত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে বৈধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকো যতক্ষণ না ফিতনা নির্মূল হয়ে যায় এবং দীন একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তারপর যদি তারা বিরত হয় তাহলে জেনে রাখ যালেম তথা অত্যাচারী ছাড়া আর করোর ওপর হস্তক্ষেপ করা বৈধ নয়। (সুরা বাকারা: ১৯৩)
বর্তমানের পরিস্থিতির উপর তো জিহাদ নিয়ে আলোচনা বা পর্যালোচনা করলে এর পরিধি আরো বৃদ্ধি পাবে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত কুফুরি মতবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা কে উপমহাদেশের অবস্থার আলোকে পূর্ববর্তী আকাবিরগণ নির্বাচনের পন্থায় লড়াই করা কেও জিহাদ বলেছেন। আর্থিক, বুদ্বিবৃত্তিক, প্রচার মাধ্যম, শিল্প সাহিত্য রচনার মাধ্যমে এবং সাংসকৃতিক লড়াইকে অনেক আলেম জিহাদ হিসেবেই নিচ্ছেন।
জিহাদ নামক পবিত্র শব্দটিকে এখন কলঙ্কিত করে ফেলা হচ্ছে। কুরআন শরীফের বহু স্থানে জিহাদ শব্দটি এসেছে। অথচ, এখন একে কলঙ্কিত করে এর দ্বারা সন্ত্রাসকে বুঝানো হচ্ছে। বর্তমানে “জিহাদ” শব্দটি সাধারণ মানুষের নিকট আতংকজনক হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। এমনভাবে একে উপস্থাপন করা হয় যে, জিহাদ মানেই যেন সন্ত্রাস কিংবা অস্ত্রবাজি ইত্যাদি। অথচ ইসলাম সন্ত্রাসকে কঠোরভাষায় ঘৃণা করেছে। সন্ত্রাসীর জন্য গুরুতর শাস্তির বিধানও ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। ইসলাম বিদ্বেষীরা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করতে জিহাদকে বিকৃত করে উপস্থাপন করার পথকে বেছে নিয়েছে। আর একে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে। আর কিছু লোক যারা জিহাদের নাম ভাঙগিয়ে নীরিহ মানুষ মারার খেলায় মেতে উঠেছে।তারাও জিহাদকে সন্ত্রাস বানানোর সমান অপরাধী। ইসলাম নিরীহ মানুষ মারার কোন অনুমোদন দেয় না।
লেখক : বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক কর্মী ।