ওয়াজ মাহফিল : একাল-সেকাল

প্রকাশিত: ৮:৫৬ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৪, ২০১৯

ইবনে মুসা

ওয়াজ মাহফিল বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্য। ব্যক্তি__সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনে ওয়াজ মাহফিলের ভূমিকা অপরিসীম। বহুকাল ধরে ওয়াজ মাহফিলের এ সুস্থ সংস্কৃতি চলে আসছে বাংলাদেশে। বিশেষ করে শীতের মৌসুমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থানীয় যুবসমাজ, এলাকাবাসী, মসজিদ কিংবা মাদরাসার উদ্যোগে আয়োজন হয়ে থাকে মাহফিলগুলোর।

যুগ যুগ ধরে ওলামা-মাশায়েখ কোরআন হাদীসের আলোকে বয়ান করে আসছেন। অসংখ্য মানুষ তাঁদের হৃদয়াগ্রাহী বয়ানের মাধ্যমে দীনের পথে এসেছে। চোর-ডাকাত নেশাখোর— এমনকি খুনি পর্যন্ত এই ওয়াজের বদৌলতে সকল অপকর্ম ছেড়ে সঠিক পথে ফিরে এসেছে।

তবে সময়ের পাশাপাশি ওয়াজের মাঝেও এসেছে বিস্তর পরিবর্তন। আগের দিনে ওয়াজ মাহফিলগুলো ছিল নিছক দীনিস্বার্থেই। পীর-মাশায়েখ ও ওয়ায়েজীনরা অত্যন্ত পরিশ্রম করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ওয়াজ মাহফিলে যোগ দান করতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে সেই চিত্র অনুপস্থিত বললেই চলে। এখনও যে দিনের দরদী নিয়ে কেউ কথা বলছে না বিষয়টি এমন নয়। তবে সংখ্যা খুবই নগণ্য।

বর্তমান সময়ে ওয়াজ মাহফিলের নামে কোথাও কোথাও অপসংস্কৃতিও চলছে। মাহফিল কর্তৃপক্ষ মাহফিল এড়িয়া মরিচা বাতি দিয়ে আলোকসজ্জা করেন! সেলফি তো আছেই! আবার কেউ কেউ এসবের প্রতিবাদের নামে ঢালাওভাবে সমস্ত ওলামায়ে কেরামের বিপক্ষে দাঁড়ায়! এটা অগ্রহণযোগ্য।

বক্তা পরিচয়ে যেমন কিছু নাটকবাজ রয়েছে, ঠিক তেমনি এখনও পূর্ণ দীনের দরদী হয়ে কথা বলার মতো আলেমও আছেন। অতএব— ঢালাওভাবে এই ময়দানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

একটি অনলাইন পোর্টালের প্রতিবেদনে এরকমই কিছু নাটকবাজ বক্তার সঙ্গে গ্রহণযোগ্য ও অতিপরিচিত কিছু ওয়ায়েজের সমালোচনা করা হয়েছে— যেটা কাম্য ছিল না। তবে এটা সত্য যে, বয়ানের মঞ্চে কথা বলার ক্ষেত্রে সামনের শ্রোতাদেরকে অন্তরের দরদ দিয়ে বোঝানো, যাতে তারা কথাগুলো গুরুত্বসহকারে বোঝে এবং আমল করার নিয়ত করে; এমন ওয়ায়েজের সংখ্যা আসলেই কম।

আরও পড়ুন : ভাই হে! ওয়াজের নামে ঠাট্টা-তামাশা বন্ধ করুন

বর্তমান সময়ে অনেক বক্তা রয়েছে— যারা শুধুমাত্র সুরের মুর্ছনায় শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে থাকে। বয়ানের মাঝে তাত্ত্বিক ও কোরআন হাদীসের কিছু না থাকায়, শ্রোতারা যাতে ময়দান ছেড়ে চলে না যায়, সেজন্য ওয়াজের মঞ্চকে নাটকের মঞ্চে পরিণত করে! শ্রোতারাও ঐসব বক্তার বক্তৃতা শোনে বিনোদন পাবার জন্য, দীন শেখার জন্য নয়।

তাদের এসব আচরণে ওলামায়ে কেরামের বদনাম হচ্ছে। বদনাম হচ্ছে ইসলামের। এসব অনৈতিক কথাবার্তার কারণে ওয়াজ থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। শিশু বক্তা, মহিলা পুরুষ হয়েছে এমন বক্তা, ইঞ্চি বক্তা, এরকম বহু নাটক দেখা যায় ওয়াজ মাহফিলে! এগুলো নিশ্চয়ই পরিত্যাজ্য।

তবে যেসমস্ত আলোচক কোরআন-সুন্নাহর আলোকে এবং বাস্তবতার নিরিখে কথা বলে থাকেন, দিলের দরদ দিয়ে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, অপ্রাসঙ্গিক কথা না বলে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলোয় যারা প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, চাই সেটা সুর দিয়ে হোক কিংবা ব্যক্তি স্বভাবসুলভ ভঙ্গি দিয়ে হোক, সেগুলোর সমালোচনা করা যৌক্তিক মনে করি না।

উক্ত পোর্টালটিতে জনৈক ব্যক্তির মন্তব্য— “বয়ানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চিল্লাচিল্লি করা নিয়ে”। আসলে এমন মন্তব্য ব্যক্তি আক্রমন বলে মনে করি। একজন আলোচক তার কথাগুলো শ্রোতাদের অন্তরে কীভাবে হৃদয়াঙ্গম করাবেন— সেটা আলোচকের ব্যাপার। তার আলোচনা যদি শ্রোতারা গ্রহণ করেন এবং পছন্দ করেন, সে ক্ষেত্রে অন্যদের প্রশ্ন তোলার সুযোগ দেখি না। তবে হ্যাঁ, যদি আলোচকের আলোচনা কোরআন-হাদিস, যুক্তি ও বাস্তবতার নিরিখে হয়।

নাটকবাজ বক্তাদের যেমন পরিত্যাগ করা সময়ের দাবি, তেমনই হক্কানী ওলামায়ে কেরাম ও দীনের দরদী ওয়ায়েজদের সঠিক মূল্যায়ন করা এবং তাদের পাশে দাঁড়ানো সময়ের দাবি। অনেকে হিংসা ও নিজের চরিত্রের পরিচয় দিতে গিয়ে উভয়কে গুলিয়ে ফেলে! সবাইকে এক পাল্লায় এনে মন্তব্য করা বা কটুবাক্য ব্যবহার করা যৌক্তিক নয়। অনেককে ওয়ায়েজদের ক্ষেত্রে অশালীন শব্দও ব্যবহার করতে দেখা যায়। এগুলো সুস্থতার পরিচয় বহন করে না।

ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্ম ধীরে ধীরে ইসলামের দিকে ঝুঁকছে। ইসলাম জানার ব্যাপারে আগ্রহ বাড়ছে। মাহফিলের মাধ্যমে অন্তত ইসলামের আওয়াজ ও জাগরন তৈরি হয়। থাক না ইসলামের জাগরণ! তৈরি হোক না দীনের দুর্গ! অব্যাহত থাকুক তাকবীর ধ্বনি!

যে কাজগুলো প্রশাসন, মামলা, জেল কিংবা রিমান্ডের মাধ্যমে সম্ভব হয় না, এরকম বহু অসাধ্য সাধন হয় আধাঘন্টা, একঘন্টা, দেড়ঘন্টার বয়ানের মাধ্যমে। আমরা দেখেছি— বহু চোর-ডাকাতোর জেল-রিমান্ড হওয়ার পর ছাড়া পেয়ে আরও বড়ধরনের অপকর্ম করে বসে। কিন্তু সেই চোর-ডাকাতগুলো ওলামায়ে কেরামের মজলিস বা ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে ওলামা-মাশায়েখের বয়ান শুনে চিরতরে চুরি ছেড়ে দেয়, ডাকাতি ছেড়ে দেয়, ফিরে আসে মাদক ও যৌনহয়রানী থেকে।

পড়ুন : ক্যারিয়ার ভাবনায় হক কথা না বলা বক্তাদের ধিক্কার

ওয়াজ মাহফিল ব্যক্তি, সমাজ ও দেশ গঠনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই। তবে ওয়াজের নামে মঞ্চে উঠে যেসমস্ত বক্তারা ভেংচি কেটে কথা বলে, হাসিঠাট্টার আসর জমায় এবং সেগুলোর পক্ষে আবার দলীল পেশ করার চেষ্টা করে, তাদেরকে পরিত্যাগ করতেই হবে। তাদের এহেন আচরণে ওলামায়ে কেরাম, ওয়াজ মাহফিল ও ইসলামের ক্ষতি বৈ উপকার হচ্ছে না।

মন্তব্য করুন