আলেম সাংসদের এক বিকেল

প্রকাশিত: ৫:৩৫ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৯, ২০১৯

জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি সমাজ সেবা করা এটা আমাদের আকাবিরে দেওবন্দ, নদওয়া বা তাবলিগী মুরব্বিদের একটা বিশেষ গুণ

কওমি মাদরাসা শিক্ষা সনদের বিল পাশ ও কওমি শিক্ষার্থীদে স্বার্থ নিয়ে সংসদে যিনি সরব ভুমিকা রাখছেন এবং এদেশের মসজিদ মাদরাসার উন্নয়নে সরকারের হয়ে আরব বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছেন তিনি প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভি এমপি। তিনি একজন প্রতিথযশা আলেম। তাকে নিয়ে জানাচ্ছেন এহসান সিরাজ

সময়টা নির্ধারণ হয়েছিলো খুদে বার্তায়। সময়ানুযায়ী এক বিকেলে উপস্থিত হয়েছিলাম জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার ন্যম ভবনের নির্ধারিত এপার্টম্যান্টে। কচকচে পেয়ারা আর কফিতে চুমুক দিতে দিতে জানলাম, ড. আবু রেজা’র বাবা আবুল বারাকাত মুহাম্মদ ফজলুল্লাহ ছিলেন ভারতের প্রখ্যাত শাইখুল হাদিস আল্লামা জাকারিয়া কান্ধলভির সঙ্গী। দাদা ছিলেন আধ্যাত্মিক সম্ভ্রাট হজরত রশিদ আহমদ গাংগুহি রহ.-এর শিষ্য! তাঁর পূর্বপুরুষ শেখ ইয়াছিন মক্কি সুদূর মক্কা থেকে এসে এদেশে বসতি করেছিলেন। এজন্য এখনও তাদের বাড়িটি মক্কি বাড়ি হিসেবে সবার কাছে পরিচিত! চট্টগ্রাম জেলা সাতকানিয়া উপজেলার বাবুনগর গ্রামের সেই মক্কি বাড়িতেই ১৯৬৮ সালের ১৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন আবু রেজা। তিনি কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসপাস করেন।

১৯৮২ সালে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে দাখিল পরিক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণীতে ১ম স্থান লাভ করেন। এরপর ১৯৮৮ সালে ভারতের নদওয়াতুল উলামা থেকে আরবি সাহিত্য ও ইসলামিক শিক্ষায় বিএ [অনার্স] ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮৯ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেThe Science Of Islamic Law এর উপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এবং ১৯৯১ সালে Daowah and Islamic Thought এর উপর উচ্চতর ডিপ্লোমা অর্জন করেন। ১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়থেকে আরবি ভাষা সাহিত্যের উপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।


কর্মজীবন সম্পর্কে বলেন, ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রামের জামিয়া দারুল মা’আরিফ আল ইসলামিয়া থেকে শিক্ষকতা শুরু করে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত শিক্ষা সচিব হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে দাওয়াহ ও ইসলামিক শিক্ষা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। এখনও অধ্যাপক হিসেবে আছেনে সেখানে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ান নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয়সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বোর্ড অব গভর্নর’র সদস্য, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ইমাম মুয়াজ্জিন ট্রাস্টের সদস্য, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন শেখ জায়েদ বিন সুলতান নাহিয়ান ট্রাস্ট এর সদস্য।


তাছাড়া কাতারের আন্তর্জাতিক মুসলমান পন্ডিতদের অ্যাসোসিয়েশন-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। আন্তর্জাতিক ইসলামী সাহিত্য সংস্থা, রিয়াদের কেএসএ-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট। তাছাড়া দারুল হিকমা এডুকেশন ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম, এরাবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল মাদরাসা চট্টগ্রাম ও আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন ফর চ্যারিটি এন্ড ইসলামিক রিসার্চ এন্ড পাবলিকেশন্স এর চেয়াারম্যান। এবং আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম-এর সেক্রেটারিও। তিনি একজন বিদগ্ধ লেখক ও গবেষক। তাঁর গবেষণা প্রবন্ধ বাংলা ও আরবি ভাষায় বিভিন্ন দেশি-বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রায় ৩০টিরও বেশি গবেষণা পুস্তক [অনুবাদ গ্রন্থসহ] বিভিন্ন দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষা উন্নয়ন ও গবেষণার কাজে তিনি এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকাসহ বিশ্বের প্রায় ৪২টি দেশ সফর করেছেন। সামাজিক ও শিক্ষা সংক্রান্ত অবদান ও স্বীকৃতির জন্য এ পর্যন্ত প্রায় ১০০টি স্বর্ণপদকসহ বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি!

এমপি মহোদয়কে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান, নিজেও ইসলামী স্কলার। আছেন শিক্ষকতার মতো পেশায়! এখানে সুনামও কুড়িয়েছেন বেশ ভালো। সমাজ সেবা ও রাজনীতিতে কেন এলেন? বললেন, জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি সমাজ সেবা করা এটা আমাদের আকাবিরে দেওবন্দ, নদওয়া বা তাবলিগী মুরব্বিদের একটা বিশেষ গুণ! তাছাড়া পৈত্রিক সূত্রেও আমি এটা পেয়েছি। আমার বাবা তার নিজের গোলার ধান বিক্রি করে মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন দিয়েছেন! রাজনীতি মানে সমাজের সেবা করা, প্রতারণা করা নয়।

প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করা, ওয়াদা খেলাফ না করা। জনগণের কাজ করা, তাদের পাশে থাকা। সমস্যা সমাধান করা, জনকল্যাণমূলক কাজ করার নামই রাজনীতি! বায়হাকির হাদিসে হুজুর সা.বলেছেন, যে ব্যক্তি কারও অভাব পূরণ করবে, এতে তার উদ্দেশ্য হলো ওই ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করবে; প্রকৃতপক্ষে সে আমাকে সন্তুষ্ট করল। আর যে আমাকে সন্তুষ্ট কল, সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করল। আর যে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করল, আল্লাহ তাকে বেশেতে প্রবেশ করাবেন! রাজনীতির যদি সঠিক ব্যাখ্যা করা হয় তাহলে রাজনীতি এবং সমাজসেবা একটা আরেকটার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত; একরকম ইবাদতও বটে।


তাঁর কাছে জানতে চেয়ছিলাম, রাজনীতিতে এসে আপনি ধর্মীয় এবং সামাজিক কোন কাজটাকে প্রাধান্য দেন? বললেন, মুমিনের ভালো কাজগুলো ইবাদতের সামিল। সামাজিক কাজগুলোকে ধর্মের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বঙ্গবন্ধুকে কিভাবে মূল্যায়ান করেন এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের পরিবার মুক্তিযোদ্ধা পরিবার। আমার বড় ভাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা। অনেক আগে থেকে আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পড়াশোনা করি। আল্লাহর হুকুমে বঙ্গবন্ধুর কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণ ছিল এক ঐতিহাসিক ভাষণ! এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুখ দিয়ে বলানো কথা। এজন্য মানুষের হৃদয়ে তাঁর কথাগুলো স্থান করে নিয়েছে! বঙ্গবন্ধু দেশের জন্য কতটুকু আন্তরিক ছিলেন এটা তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লে বুঝা যায়। পীর মাশায়েখ এবং আলেম-ওলামাদের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক ছিল বইগুলো পড়লে জানা যাবে। আমার পরামর্শ থাকবে প্রত্যেকেই যেন তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা পড়েন।


ড. আবু রেজাকে ছোট্ট করে প্রশ্ন করেছিলাম, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আপনি বঙ্গবন্ধুর উদারতা ও ইসলামপ্রীতির নমুনা কিভাবে তুলে ধরেছেন? বললেন, আরব বিশ্বের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক আছে এটা সবাই জানেন। নানা কারণে বিভিন্ন দেশের সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশ নিতে হয় আমাকে। ওইসব জায়াগায় আমি বঙ্গবন্ধু এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে একজন সত্যিকারের মুসলমান হিসেবে উপস্থাপন কওে থাকি। কারণ, এর আগে জামায়াত-বিএনপি সরকার ইসলামের নাম ও লেবাস ধারণ করে বাংলাদেশের অনেক ক্ষতি করেছে। তারা আওয়াামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুকে ইসলাম বিরোধী শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেছে। এ কারণে সে সময় দেশের ও দলটির ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। এর মোকাবেলায় আমি আমার মতো করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওপ্রধানমন্ত্রী জনত্রেী শেখ হাসিনাকে বিশ্বদরবার বিশেষ করে আরব বিশ্বের কাছে তুলে ধরছি অনবরত।

ড. আবু রেজার ভিন্নতা হলো, সংসদ সদস্য হওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছেন নিয়মিত! মুসলিম শরিফের মতো হাদিসের কিতাব, আরবি সাহিত্যের ক্লাশ করাচ্ছেন নিয়মিত! মানুষ তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন একমাত্র আলেম সংসদ সদস্য হওয়াার কারণে! তাঁর মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রম যে জিনিস সেটা হলো, তিনি একেক জুমার খুতবা দেন তাঁর নির্বাচনী এলাকার একেক মসজিদে! খুতবায় সমসায়িক বিষয়ের উপর মানুষকে সচেতন করেন তিনি! একজন আলেমের কাছে এটাই তো চাওয়া সাধারণ মানুষের!

মন্তব্য করুন