

সাইফুল ইসলাম: এক মহামানবের আবির্ভাব হলো। তিনি এসেছেন সত্যের আলো ছড়িয়ে দিতে, এসেছেন মানুষকে পাপ থেকে পূন্যের পথ দেখাতে। তাঁর শুভদর্শনে দৃষ্টি যাদের প্রেমমুগ্ধ হলো জীবন স্বপ্ন তাদের সার্থক হলো। এ মহামানবকে দেখার সৌভাগ্য যারা লাভ করলো, খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি তারা হলো। তারা জন্ম নিয়ে হয়ে গেছেন ক্ষণজন্মা। তাদের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে যুগ থেকে যুগান্তরে। কাল থেকে কালান্তরে।
এইমাত্র তাদের দলে অন্তর্ভুক্ত হলেন উমর ইবনুল খাত্তাব রা.। অথচ একটু আগে উদ্দেশ্য করে বের হয়েছিলেন হত্যা করবেন বলে সেই মহামানবকে, যিনি মহাসত্যের সন্ধান নিয়ে এসেছেন এ ধরণীতে।
মক্কায় মুসলমানদের উপর নির্যাতনকারী কাফেরদের মধ্যে উমর ছিলেন শীর্ষে। তার বুক সংকীর্ণ হয়ে আসছিলো। তিনি ভাবতে বাধ্য হন, কোন কারণে এরা এত কষ্ট.. নির্যাতন বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিচ্ছে? এত নিপীড়নের পরও কেন এসব লোক অবিচল থেকে যাচ্ছে তাদের নতুন ধর্মে? এ কেমন বিস্ময়কর শক্তি? উমর এসব ভাবেন গভীর মনে। অবশেষে মনের গভীর টানে ইসলামের চৌহদ্দিতে প্রবেশ করেন উমর ইবনুল খাত্তাব রা.।
ইসলাম গ্রহণ করে নিজের যাবতীয় শক্তি ব্যয় করেছেন ইসলামের উন্নতিকল্পে। নিজের জীবনটাই দিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করলেন মহাসত্যের ছায়াতলে। হযরত উমর রা. ইসলাম গ্রহণের পরেই এই মহাসত্য ছড়িয়ে পড়ে বাঁধভাঙ্গা ঢেউয়ের গতিতে। সেই ঢেউয়ের সম্মুখে দাঁড়াতে পারেনি কায়সার ও কিসরা। চলে গেছেন হযরত মুহাম্মাদ সা.। এসে গেছে খুলাফায়ে রাশেদার যুগ। নবি-রাসুলের পরে শ্রেষ্ঠ মহামানব ও মুসলামানের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা.ও চলে গেছেন তাঁর আপন রবের কাছে। যাওয়ার সময় খেলাফতের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর কাঁধে। হজরত উমর রা. ছিলেন কঠোর প্রকৃতির লোক। খেলাফতে দায়িত্ব পাবার পর তাঁর কঠোরতা আরও বেড়ে গেলো; সেটা জালিম শাসকদের জন্য।
যখন মুসলমানরা নতুন খালিফার হাতে বায়আত গ্রহণ করছিলেন, তখন খলিফার মনের নিস্পলক দৃষ্টি দূর-দিগন্তপানে। সকল বাঁধা-ব্যবধান ও অন্তরায় ভেদ করে সে তীক্ষ্ণধার দৃষ্টি হারিয়ে গেল অনন্ত বিস্তৃত শূন্যতায়। দ্বিতীয় খালিফা হজরত উমর রা. এর হৃদয়ে ভেসে উঠল অর্ধেক দুনিয়াব্যাপী বিস্তৃত দুটি বিশাল সম্রাজ্যের বিস্তৃত ছবি। যেখানে জালিমদের শাসনে যাঁতাকলে পিষ্ট সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা। জালিম বাদশাহ-রা গলা টিপে হত্যা করেছে ন্যায় সত্য ও ইনসাফকে। যেখানে নিজের অধিকার দাবির আদায়ে টু শব্দ করতে পারেনা সাধারণ জনগণ। দ্বিতীয় মহামানবের কানে যেন ভেসে আসছে সে সম্রাজ্যগুলোর পৈশাচিক জুলুমের নিছে পিষ্ট হওয়া লাখো মানুষের বুক ফাটা আর্তনাদ।
ভেসে আসছে ‘বাঁচাও! বাঁচাও!!’ আহাজারি। সেখানকার নির্যাতিত মানবতা অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুণছে- ‘ঊর্ধ্বজগৎ থেকে কখন নেমে আসবে আমাদের মুক্তির পয়গাম! শান্তি ও নিরাপত্তার মহাপয়গাম নিয়ে, ন্যায় ও ইনসাফের শাসন নিয়ে কখন আসবেন সেই প্রতিশ্রুত নতুন নবি? এখনও কি সময় হয়নি? আর কত দিন ধৈর্য ধরব আমরা? ধৈর্যের বাঁধ যে ভেঙ্গে যাচ্ছে! অসহনীয় জুলুম-নির্যাতনের মুখে প্রাণে বেচেঁ থাকাও যে কঠিন হয়ে ওঠেছে?’ হজরত উমরের কানে যেন মানবতার ফরিয়াদ বিঁধছিল ।
জুলুম-নির্যাতিত মানুষদের বুকফাটা আর্তনাদ তার মর্মে প্রচণ্ড ঝড় তুলল। সেই মানুষদের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি বলে উঠলেন- ‘লাব্বাইক! লাব্বাইক!! এইতো যাচ্ছে আমাদের বাহিনী। হতাশ হয়ো না। ধৈর্য হারিয়ো না। আল্লাহ আমাদেরকে পাঠিয়েছেন তোমাদের কষ্ট অবসান করে দেওয়ার জন্য।’
নতুন খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব-এর মনের গহীন থেকে উচ্চারিত হতে থাকল- খুব দ্রুত নির্যাতিত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে পারস্য বিজয়ের দীপ্ত শপথ নিয়ে। মাঠির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে প্রজাদের শোষণ করে তোলা সেই কিসরার সাদা প্রাসাদ আর সম্রাজ্যবাদীর গর্বোথিত মাথা ও নিপীড়নের সিংহাসন।
উমর ইবনুল খাত্তাব রা. ছিলেন যুদ্ধ পরিকল্পনা ও পারিচালনায় অত্যন্ত অভিজ্ঞ। মনোবলে তিনি ছিলেন অধম্য, কৌশলেও। ধার্মিকতায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়, প্রত্যাহিকতায়ও। তাঁর রাত কাটত নামাজ আদায় করে; দিন কাটত রোজা রেখে আর মানুষের প্রয়োজন পুরা করে। তিনি ইসলামের সেবায় ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ।
হজরত উমর রা. দীর্ঘদিন পর্যন্ত রাসুল সা.-এর সাহচর্য অবলম্বন করেছেন। উমর ইবনুল খাত্তাব- এর মানবতা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ফিকহ ও বিচক্ষণতা চিরকাল ইতিহাসে আলো হয়ে ছড়াবে। আল্লাহর বাচাইকৃত বান্দা, সিদ্দিক ও সালিহিনদের তালিকায় তিনি নিজের নাম লিখিয়ে গেছেন।
তিনি ছিলেন একজন দিগ্বিজেতা সর্বাধিনায়ক। দায়িত্বশীল প্রহরী। দয়ালু, কোমল ন্যায়নিষ্ঠ শাসক। তিনি দায়িত্ব পালন, সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। ছিলেন একজন বিচক্ষণ ও দুরদর্শী শাসক। তাঁর প্রশাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, পক্ষপাত-প্রবণতার অনুপস্থিতি। তার ন্যায়বিচারের চেতনা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। তিনি ছিলেন মহান প্রতিভার অধিকারী। মুসলিম বিজিত সকল ভূমিতে তিনি বিচারক্ষমতাসম্পন্ন ও দৃঢ়সংকল্প প্রশাসনের মজবুত ভিত গড়ে তুলেছিলেন। এ সবকিছু ছাড়াও চরিত্র-মাধুরিমার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন
মহান। আপন সত্তা ও ব্যক্তিত্যের ক্ষেত্রে মর্যাদাবান।
হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর ইমামতিতে ফজরের নামাজে দাঁড়িয়েছেন সবাই। নামাজরত অবস্থা হঠাৎ খঞ্জর দিয়ে আঘাত করেছে আবু লুলু মাজুসি নামের এক ঘাতক তারপর থেকে অসুস্থ হজরত উমর।
২৩ হিজরির জিলহজ মাসের কোনো এক দিনে হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর পবিত্র রুহ শরীর থেকে বেড়িয়ে গেছে। তাঁর আত্মা চলে গেছে ঊর্ধ্বকাশে। তাঁর ইচ্ছেরা সেখানে পায়রা হয়ে উড়ছে। যে সম্মানিত স্থানের সুসংবাদ তিনি পেয়েছেন আল্লাহ ও তার রাসুল সা.-এর কাছ থেকে। সেখানে বিচরণ করে শহিদ আর পূন্যাত্মারা! চিরসবুজ পাখি হয়ে উড়ে বেড়ায় এপাশ হতে ওপাশ।
পর্যালোচনা : উমর রা. সম্পর্কে তেমন কিছু পড়া হয়নি। প্রায় ২-৩ বছর আগে স্বর্ণযুগের স্বর্ণমানব সিরিজের দ্বিতীয় বই ‘আমিরুল মুমিনিন হজরত উমর রা.-এর ১০০ ঘটনাবলী’ বইটি পড়েছিলাম। তারপর থেকে তাঁর সম্পর্কে জানার আগ্রহ থাকলেও হাতের কাছে তেমন কোনো বই পাইনি। হঠাৎ একদিন কালান্তরের পেইজে দেখলাম তারা নাকি বইটি বের করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর অনুবাদক হলেন কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক সাহেব। তিনটা জিনিস এক জায়গায় হয়েছে। পছন্দের প্রকাশনী,অনুবাদক, বই। না পড়ে কি পারা যায়! তারপর থেকে শুরু অপেক্ষা.. কত মাস আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন আর কত মাস পরে ছাপানো হয়েছে এটাই ভুলে গেছি। যাক, তারপরেও পেলাম।
যতটা আগ্রহ নিয়ে শুরু করেছিলাম ততটা আগ্রহ নিয়েই বইটি শেষ করতে হয়েছে। কোথাও একটুও উত্তেজনা কমেনি। আর অনুবাদকের শব্দমালার তরঙ্গে ভাসতে লাগলাম আর ডুবতে লাগলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম বইটি যে অনুবাদ করা।
অনুবাদক সম্পর্কে বেশি বলার দরকার মনে করছি না। পাঠকগণ তাঁর অন্যান্য বই পড়ে তাঁর অনুবাদ সম্পর্কে জেনে গেছেন। আর এ বইটি অনুবাদক এত সুন্দর সাবলীল ও সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেছেন যে , পাঠ করামাত্রই হৃদয়ঙ্গম হয়ে যেতে বাধ্য। প্রায় প্রতিটি বিষয়েই টীকা ব্যবহার করা হয়েছে। প্রচুর প্রয়োজনীয় টীকা অনুবাদক বা সম্পাদক সংযোজন করেছেন। এগুলো ব্যবহার না করলে অনেক জায়গা আমাদের মত সাধারণ পাঠকদের বোঝা দুঃসাধ্য হয়ে যেত। প্রয়োজনীয় টীকা দেওয়ার কারণে বিষয়গুলো বুঝতে অনেক সুবিধা হয়েছে।
বোর্ড বাধাই কভার লেমিনিটিংসহ আলাদা মলাট ১৫০ গ্রাম আর্ট পেপারে লেমিনিটিং, ফয়েল এ্যামবুশ সহ ১০৭২ পৃষ্ঠার বইটির মূদ্রিত মূল্য মাত্র ১,০০০ টাকা। ৬৫০ টাকায় প্রি-অর্ডার নেওয়া হয়েছে। সাথে একটি বইও গিফট! এখানেই শেষ না, কুরিয়ার ফি-এর খরচটাও তাঁরা বহন করেছেন। এটা সত্যিই এক্সিলেন্ট। এটার জন্য কালান্তর প্রকাশনী সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
যাক আসল কথা হলো, উমর রা.-এর শাসন, রণকৌশল, ইনসাফ, বদান্যতা, দূরদর্শিতা, ইখলাস, বীরত্বসহ তাঁর সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে হলে আপনাকে পড়তে হবে বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক, ইসলামি চিন্তাবিদ ও গবেষক ড. শায়খ আলি মুহাম্মদ সাল্লাবি রচিত, আমিরুল মুমিনিন উমর ইবনুল খাত্তাব রা.- এর পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থটি।
বই : আমিরুল মুমিনিন হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা.
লেখক : ড. শায়খ আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি
অনুবাদ : কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক
প্রকাশনী : কালান্তর প্রকাশনী
পৃষ্ঠা : ১০৭২ (দুই খণ্ড)
মুদ্রিত মূল্য: ১,০০০/- (দুই খণ্ড)
বইটি খুচরা ২৫% ছাড়ে সারাদেশেই পাওয়া যায়।
অনলাইন বুকশপগুলোতেও বইটি পাওয়া যায়।