

পাবলিক ভয়েস: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মচারী পদে ৬০ লাখ টাকার নিয়োগ বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে শাখা ছাত্রলীগের কোন্দল বড় আকার ধারণ করেছে। এর জেরে ঝুঁকিপূর্ণ মেরুকরণ হয়েছে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে।
ছাত্রলীগের একটি অংশের নেতা-কর্মীরা সাধারণ সম্পাদক আবু সুফিয়ান চঞ্চল বনাম সহ-সভাপতি নিয়ামুল তাজ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম মোল্লা এই দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। ছাত্রলীগ সূত্র জানায়, সম্প্রতি আবাসিক হলগুলোতে আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র ঢুকেছে। ফলে যে কোনও সময় সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
বিপরীত মেরুর নেতাদের অভিযোগ, চঞ্চল নিয়োগ বাণিজ্যের টাকা সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহমেদ রাসেলকে দেওয়ার কথা বলে নিজে আত্মসাৎ করেছেন। চঞ্চলের তদবিরে গাড়ি পোড়ানো মামলার আসামি এবং ছিনতাইকারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তবে চঞ্চলের দাবি, নিয়োগ বাণিজ্যের প্রায় ১৫ লাখ টাকা তিনি রাজিব আহমেদ রাসেলকে দিয়েছেন।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন ছাত্রলীগ নেতা দাবি করেন, চঞ্চলের যৌন নিপীড়নে শিকার হয়ে অন্তত দু’জন নেত্রী রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারলে তারা অভিযোগ করবেন। এছাড়া চঞ্চলের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাস ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় মাদক ব্যবসায় মদতের অভিযোগ রয়েছে বলেও জানান তারা।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে চঞ্চল বলেন, ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কেউ এমন মিথ্যা অভিযোগ করে থাকতে পারেন।’
২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর মো. জুয়েল রানাকে সভাপতি এবং আবু সুফিয়ান চঞ্চলকে সাধারণ সম্পাদক করে জাবি ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের একাধিক শীর্ষ নেতার দাবি, সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর চঞ্চলের তদবিরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন পদে ৯-১০ জনকে নিয়োগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
শহীদ সালাম-বরকত হল, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেচ্ছা হল, নতুন প্রশাসনিক ভবন, প্রকৌশল বিভাগ এবং নিরাপত্তা শাখায় সেসব নিয়োগ দেওয়া হয়। তৃতীয় শ্রেণির পদে ব্যক্তিভেদে ১২-১৪ লাখ এবং চতুর্থ শ্রেণির পদে ৫-৭ লাখ টাকা করে নেন চঞ্চল।
ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদের দৌড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম ব্যাচের চারজন নেতা ছিলেন। তারা প্রত্যেকেই জাবি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি রাজিব আহমেদ রাসেলের অনুসারী ছিলেন। এদের মধ্য থেকে ঘনিষ্ঠ আবু সুফিয়ান চঞ্চলকে সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য মনোনীত করেন রাজিব। তার অনুসারী সবার মতামতের ভিত্তিতে রাজনীতি পরিচালনার প্রতিশ্রুতি নিয়েই চঞ্চলকে এ পদে আনেন রাজিব।
ছাত্রলীগ নেতারা জানান, সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর প্রথম কয়েকমাস সবার মতামতের ভিত্তিতে চললেও ধীরে ধীরে প্রতিশ্রুতি ভাঙতে থাকেন চঞ্চল। ৬০ লাখ টাকার নিয়োগ বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে রাজিবের অনুসারী বাকি নেতাদের সঙ্গে চঞ্চলের রেষারেষি বাড়তে থাকে। এ নিয়ে একাধিকবার হাতাহাতিতে জড়ান রাজিব ও চঞ্চল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে ঘটে সংঘর্ষের ঘটনা। দ্বন্দ্ব মেটাতে দু’পক্ষের সঙ্গে ছাত্রলীগের সাবেকরা একাধিকবার বসেও সুরাহা করতে পারেননি।
ছাত্রলীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘চঞ্চল নিয়োগ বাণিজ্যের সব টাকা ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের দেয় বলে আমাদের জানাতো। আর সাবেকদের জানাতো বর্তমান নেতাদের মধ্যে টাকা ভাগ করে দিচ্ছে। ব্যক্তি স্বার্থে অন্যদের বিতর্কিত করা দুঃখজনক।’
জানতে চাইলে আবু সুফিয়ান চঞ্চল বলেন, ‘তিন মেয়াদে রাজিব ভাইকে প্রায় ১৫ লাখ টাকা
দিয়েছি। দলীয় নেতাকর্মীদের পেছনেও বড় অংশ ব্যয় হয়েছে। সাবেক হওয়ার পরও রাজিব ভাই ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে নিয়োগ বাণিজ্য, চাঁদাবাজি করছেন।’
রাজিব আহমেদ রাসেল বলেন, ‘অভিযোগ পুরোটাই মিথ্যা। চঞ্চল আমাকে টাকা দেয় বলে অন্য নেতাদের কাছে মিথ্যা ছড়াতো। বিষয়টি নিয়ে চঞ্চলসহ শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনায় বসেছি। প্রত্যেকবার সে আমাকে কোনও টাকা দেয়নি বলে স্বীকার করে। তাকে একাধিকবার শোধরানোর সুযোগ দেই। সাবেক হিসেবে সবসময় ছাত্রলীগের একাত্মতা চেয়েছি।’
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের আগস্টে ক্যাম্পাস সংলগ্ন আমবাগান থেকে ২৫০ বোতল ফেনসিডিলসহ তাসকিন নামের এক মাদককারবারি ডিবি পুলিশের হাতে আটক হয়। সেসময় তার কাছ থেকে চঞ্চলের ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ছাত্রলীগ নেতা বলেন, ‘তাসকিন ও কাঠগড়া এলাকার মানিক সরকারসহ একাধিক মাদক কারবারির ব্যবসায় চঞ্চলের মদত রয়েছে। চঞ্চল ৬ লাখ টাকা দামের একটি প্রাইভেট কার ও দুটি মোটরসাইকেলের মালিক।’
এ বিষয়ে চঞ্চল বলেন, ‘অভিযোগ মিথ্যা। মাদকের বিরুদ্ধে আমি জিরো টলারেন্স অবস্থানে রয়েছি।’
সার্বিক বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আসন্ন হল কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়নের জন্য আমি দিনরাত পরিশ্রম করছি। ছাত্রলীগের একজন সাবেক নিজের স্বার্থে ছাত্রলীগে নিয়ন্ত্রণ রেখে ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করে তোলার পাঁয়তারা করছে। এজন্যই ভিত্তিহীন নানা অভিযোগ তোলা হচ্ছে। ছাত্রলীগকে সুশৃঙ্খল রাখাকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।’