

মানুষ সৃষ্টির প্রধান উদ্দেশ্য আল্লাহর ইবাদত করা, ইবাদতের মাধ্যমে পৃথিবীতে তার প্রতিনিধিত্ব করা। ইবাদতই মানবজীবনে সাফল্য ও ব্যর্থতার পরিমাপক। কিন্তু মহামূল্যবান এই ইবাদত অর্থহীন হয়ে যায় বান্দার সামান্য ভুলের জন্য। পরকালের নেক আমলের যথাযথ মূল্য লাভের প্রধান শর্ত হলো ইবাদত, আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ হওয়া, তাতে জাগতিক কোনো উদ্দেশ্য ও স্বার্থ জড়িয়ে না ফেলা, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ ত্রুটিমুক্ত হওয়া। আল্লাহ বলেন, ‘তাদের কেবল একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর ইবাদতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ (সুরা বাইয়িনাহ, আয়াত : ৫)
ইবাদতের বাহ্যিক ত্রুটি হলো, তা রাসুল (সা.)- এর সুন্নত অনুযায়ী না হওয়া, পূর্বশর্তগুলো পূরণ না করা। আর ইবাদতের অভ্যন্তরীণ ত্রুটি হলো নিয়তের অসততা অর্থাৎ, আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ইবাদত করা। যেমন মানুষের প্রশংসা, সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি, কারও দৃষ্টি আকর্ষণ। ইসলামের পরিভাষায় একে ‘রিয়া’ বা ‘লোক দেখানো’ বা ‘প্রদর্শনপ্রিয়তা’ বলা হয়।
প্রদর্শনপ্রিয়তা ও নিয়তের অসততা ইবাদতকে মূল্যহীন করে দেয়। নিয়ত ঠিক না হলে আল্লাহর কাছে বান্দার কোনো কাজই গ্রহণযোগ্য নয়। নিয়ত শুদ্ধ হলে আল্লাহ জাগতিক কাজকে ইবাদতের মর্যাদা দেন। আবার নিয়ত শুদ্ধ না হলেও ইবাদতসমূহ প্রত্যাখ্যান করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১)
মানুষের ভেতর প্রদর্শনপ্রিয়তা বিচিত্র রূপে প্রকাশ পায়। কেউ ইবাদতের সময় প্রত্যাশা করে মানুষ তার ইবাদত দেখে প্রশংসা করুক। কেউ আশা করে মানুষ বিস্মিত হোক। কারও ইচ্ছা থাকে মানুষ তার ইবাদত দেখে তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করুক। কারও উদ্দেশ্য থাকে ইবাদতের কারণে মানুষের ভেতর তার প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাক। প্রদর্শনের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, তার পরিণতি ভয়াবহ। এমন ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
পরকালে এসব ইবাদত ব্যক্তির জন্য বোঝা ও আক্ষেপের কারণ হবে। মুসলিম শরিফে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) কিয়ামতের দিন লোক দেখানো আমলকারীদের বিচারের একটি চিত্র তুলে ধরেছেন, যাতে একজন শহীদ (আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গকারী), একজন কোরআনের শিক্ষক ও একজন দানবীরের আলোচনা এসেছে।
যারা খ্যাতি ও সুনামের মোহে জিহাদ, কোরআন শিক্ষা ও দান-খয়রাত করত। তারা তাদের আমলের প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হয়। আল্লাহ তাদের বলেন, ‘তোমরা যা চেয়েছ পৃথিবীতেই তা পেয়েছ। সুতরাং আজ আমার কাছে তোমাদের কোনো প্রাপ্য নেই।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৫২৭)
রাসুলুল্লাহ (সা.) রিয়াকে ছোট শিরক বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি তোমাদের ব্যাপারে ছোট শিরক নিয়ে যতটা ভয় পাচ্ছি, অন্য কোনো ব্যাপারে অতটা ভীত নই।’ তারা (সাহাবি) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, ছোট শিরক কী? তিনি বলেন, রিয়া বা প্রদর্শনপ্রিয়তা। আল্লাহ কিয়ামতের দিন বান্দার আমলের প্রতিদান প্রদানের সময় বলবেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে যাদের দেখাতে তাদের কাছে যাও। দেখো তাদের কাছে তোমাদের কোনো প্রতিদান আছে কি-না?’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২২৫২৮)
পবিত্র কোরআনেও আল্লাহ লোক দেখানো ইবাদত থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি তার প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের আশা রাখে, সে যেন সৎ কাজ করে এবং তার প্রভুর ইবাদতে কাউকে অংশীদার না করে।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত : ১১০)
অন্য আয়াতে যারা লোক দেখানো ইবাদত করে তাদের নিন্দা করে বলা হয়েছে, ‘ধ্বংস সেসব নামাজির জন্য, যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে উদাসীন, যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে এবং, গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় ছোটখাটো বস্তু দান করা থেকে বিরত থাকে।’ (সুরা মাউন, আয়াত : ৪-৭)
উল্লিখিত আয়াত ও হাদিসের আলোকে ইসলামি আইনবিদরা রিয়াকে কবিরা গুনাহ ও হারাম সাব্যস্ত করেছেন। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম কবিরা গুনাহের তালিকার প্রথমে রিয়ার আলোচনা করেছেন। ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেছেন, ‘জেনে রেখো, নিশ্চয়ই প্রদর্শনপ্রিয়তা হারাম। প্রদর্শনকারী আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়। আয়াত, হাদিস ও পূর্ববর্তী আলেমদের বক্তব্য দ্বারা তাই প্রমাণিত হয়।’ (ইহয়াউ উলুমিদ্দিন ২/৪৮০)
বান্দার আমলে রিয়া যদি ইচ্ছাকৃত হয়, তবে তা যত গৌণই হোক, সে আমল আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য নয়। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি শরিককারীদের শরিক থেকে অমুখাপেক্ষী। যে ব্যক্তি কোনো আমল করল এবং তাতে আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করল, আমি তাকে ও যাকে সে শরিক করল তাকে প্রত্যাখ্যান করি।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৫২৮)
তবে রিয়া যদি অনিচ্ছায় হয়, বান্দা তা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করে এবং এ জন্য অনুতপ্ত হয়, তবে গ্রহণযোগ্য মত হলো, এমন ইবাদত আল্লাহর দরবারে প্রত্যাখ্যাত হবে না। ব্যক্তি ইবাদতের দায় থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। তবে তার প্রতিদান কী হবে, তা আল্লাহই ভালো জানেন।
রিয়া বা লোক দেখানো মনোভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য ইসলামে মহান সাধকরা কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলেছেন।
এক. ইবাদতের সময় আল্লাহর অস্তিত্বের স্মরণ করা। এটা চিন্তা করা যে আল্লাহ আমার মনের খবর জানেন; আমি কেন করছি, কী করছি সব তিনি দেখছেন। হাদিসে যেমন বর্ণিত হয়েছে, ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করো যেন তুমি তাকে দেখছ। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে এমনভাবে ইবাদত করো যেন তিনি তোমাকে দেখছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১)
দুই. রিয়ার ভয়াবহতার কথা স্মরণ করা। লোক দেখানো মনোভাব আল্লাহর ক্রোধের কারণ, তা সব সময় মনে রাখা। তিন. রিয়ামুক্ত আমলের পুরস্কারের কথা স্মরণ করা এবং তা অর্জনের প্রত্যয় গ্রহণ করা। চার. আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাওয়া, যেন তিনি অনুগ্রহ করে আমলটি কবুল করে নেন। পাঁচ. রিয়ামুক্ত আমলের তাওফিক চেয়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা।