

চলছে মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। আবারও আমাদের সামনে হাজির হয়েছে মহান বিজয় দিবস। বিজয় আনন্দে উচ্ছ্বসিত লাল সবুজের এ মাটি ও মানুষ। ১৯৭১ সনের ২৫ শে মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের ওপর শুরু হয় কামানের গোলাবর্ষণ। নিরস্ত্র বাঙ্গালী আতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা প্রায়। মুক্তির লক্ষ্যে শুরু বীর বাঙালীর মুক্তি সংগ্রাম।
দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, অসংখ্য প্রাণের আত্মদান, অত্যাচার-নির্যাতন ও কারাভোগের মাধ্যমে অবশেষে অর্জিত হয় এ মহান বিজয়। আজকের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফসল। এই বিজয়ের মাধ্যমেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জুলুম-নির্যাতন থেকে মুক্ত হই আমরা এবং আমাদের এই দেশ; সোনার বাংলাদেশ। এই দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকেই লাল সবুজের পতাকা হাতে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন লাখো বাঙ্গালি। শহিদ হয়েছিল লাখো মায়ের সন্তান। যাদের বিনিময়ে আজকে আমাদের এ বিজয়। এ দেশ আমাদের গৌরবের মিনার। ভালোবাসার গোলাব। সুতরাং দেশের প্রতি প্রতিটি নাগরিকের ভালোবাসা থাকা আবশ্যকীয়। এ ক্ষেত্রে কোরআন-সুন্নাহ আমাদেরে দেশপ্রেমের প্রতি উৎসাহ দেয়।
ইসলামেও রয়েছে দেশপ্রেমের গুরুত্ব অত্যাধিক। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের ন্যায়পরায়ণ শাসকের আদেশ মেনে চলো’ (সূরা নিসা : ৫৯) আরও ইরশাদ হয়েছে- ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। আর তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচে মর্যাদাবান সে যে আল্লাহকে সর্বাধিক ভয় করে। (সূরা হুজুরাত, আয়াত : ১২) হাদিসে এসেছে; হযরত আনাস রা. বলেন, ‘আমি খেদমতের নিয়তে রাসুলের সাথে খায়বার অভিযানে গেলাম। অতঃপর যখন অভিযান শেষে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে এলেন, উহুদ পাহাড় তাঁর দৃষ্টিগোচর হলো তিনি বললেন, এই পাহাড় আমাদেরকে ভালবাসে, আমরাও একে ভালবাসি। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৮৮৯)
এছাড়াও হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায়হজ্বের ভাষণে বলেন, ‘‘হে লোকসকল! জেনে রেখো! তোমাদের প্রতিপালক একজন, তোমাদের পিতা একজন। জেনে রেখো, অনারবের উপর আরবের, আরবের উপর অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সাদার উপর কালোর, কালোর উপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তবে তাকওয়ার ভিত্তিতে একজন আরেকজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারবে।’’ (মুসনাদে আহমদ, ৫/৪১১; বাইহাকির সূত্রে দুররে মানসুর ৬/১২২) । ইসলামের ইতিহাস পাঠে আমরা দেখতে পাই, পূর্বসূরি মনীষীরা স্বদেশ ও স্বজাতিকে নিজের সন্তান-পরিজনের মতো ভালোবাসতেন। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) তার পরিবারের অনেক সদস্য, ওমর বিন আবদুল আজিজ (র.), মুহম্মদ বিন কাসিম, সাইয়্যেদ আহমদ শহিদ, ইসমাঈল শহিদ, মীর নিসার আলি তিতুমির, টিপু সুলতানসহ অসংখ্য মুসলিম নেতা দেশের স্বাধীনতা, মানুষের ধর্মীয় ও জাগতিক অধিকারের জন্য জীবন দান করে গোটা উম্মতের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আরবিতে একটি বাণী স্বতঃসিদ্ধ আছে ‘হুব্বুল ওয়াতান মিনাল ইমান’। ‘দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ’।
জন্মভূমি মক্কা মোকাররমার প্রতি মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অপরিসীম ভালোবাসার কথা কে না জানে। তাঁকে যখন প্রতিপক্ষের প্রভাবশালী লোকরা হিংস্রতা ও চরম নিষ্ঠুরতায় মক্কা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করল। তিনি যখন পবিত্র মদিনার উদ্দেশে যাচ্ছিলেন তখন পেছন ফিরে প্রিয় মাতৃভূমির দিকে তাকাচ্ছিলেন আর বলেছিলেন, ‘‘ভূখন্ড হিসেবে তুমি কতই না উত্তম, আমার কাছে তুমি কতই না প্রিয়। যদি আমার স্বজাতি আমাকে বের করে না দিতো তবে কিছুতেই আমি অন্যত্র বসবাস করতাম না।’’ (জামে তিরমিযি, হাদিস : ৩৯২৬)
এ দিবসে আনন্দ উদযাপন ও সেমিনার ইসলামে করি আমরা। এ ক্ষেত্রে আমাদেরে অনেক বাড়াবাড়ি দৃষ্টিগোচর হয়। এটা কখনো ঠিক না। আমরা যে আয়োজনই করব; তা কোরাআন-সুন্নাহের বিপরীত হবে কেন? বরং ইতিহাস বিকৃত না করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে এ দিবসটিকে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে উদযাপন করা জরুরি। পাশাপাশি দেশের বিজয়ের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে আত্মদানকারী সব শহিদদের স্মরণ ও দোয়া-মুনাজাত করা দেশের প্রতিটি নাগরিকের ঈমানের একান্ত দাবি।
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয়ের আনন্দে প্রথমেই তিনি ৮ রাকাআত নামাজ আদায় করেছিলেন। আর তিনি এত অধিক পরিমাণে আনন্দ লাভ করেছিলেন যা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়। তাইতো মক্কা বিজয়ের আনন্দে তিনি সেদিন ঘোষণা করেছিলেন, ‘যারা কাবা ঘরে আশ্রয় নিবে তারা নিরাপদ। এভাবে মক্কার সম্ভ্রান্ত কয়েকটি পরিবারের ঘরে যারা আশ্রয় নিবে; তারা যত অত্যাচার নির্যাতনকারীই হোক তারাও নিরাপদ। এ ছিল প্রিয়নবীর মক্কা বিজয়ের আনন্দ উৎসবের ঘোষণা।
লেখক- অনুবাদ, সম্পাদক ও প্রাবন্ধিক
nazmulislamqasimi@gmal.com