

বাংলাদেশে কৃষক বিদ্বেষেরই আরেকটা রূপ ‘ইসলাম বিদ্বেষ’ – ফারুক ওয়াসিফ।
- কথা ছিল উপকূলীয় বাঁধ বানানোয় সাগরপ্রমাণ দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার হওয়ার। সুন্দরবনের পক্ষে দাঁড়াবার। কিন্তু তা না, এদের ইস্যু হয়েছে ‘ধর্ম’।
- যখন ডা. মঈনুদ্দিনকে ঢাকায় আনার জন্য হেলিকপ্টার পাওয়া গেল না, তখন ইস্যু হলো হেফাজত। অথচ সঠিক প্রশ্নটা ছিল, সিলেটের মতো জায়গায় উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না কেন?
- বিদ্যানন্দ নিয়ে প্রশ্ন ছিল না তেমন, কিন্তু মুসলমানদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে খুঁচিয়ে ইস্যুটাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ করে তোলা হলো।
- ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত জনপদের মানুষের পাশে থাকার কথা ছিল, সেটা না করে কেন তারা পানিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়লো সেই নিয়ে বিষের বোতল উজাড়।
সব ব্যাপারে ধর্মকে টেনে আনা ধর্ম ব্যবসায়ীর আকাজ, কিন্তু হুমায়ূন আজাদের শিষ্যদের ধর্ম নিয়ে বানিয়াগিরির কারণ কী?
না, আমার এদের এসব কাজিয়া তোলাকে নিরীহ মনে হয় না। পাশে একটা ঢিবি থাকতে কেন তারা পানিতে নেমে নামাজ পড়লো? আরে বেকুব, পাশের ওই ঢিবিটা কাদার স্তূপ, নির্মীয়মাণ বাঁধ।
আমপানে তলিয়ে যাওয়া গ্রামের মানুষের ঈদ–চাঁদের সময় ছিল না। বাংলাদেশের কৃষকের ফসল তোলার মাস এটা। এই মাসেই তার ভয় বেশি: ঝড়–বৃষ্টির, দাম না পাওয়ার। এই মাসেই তারা বছরের সেরা খাটুনিটা দেয়। করোনা আর আমপানের দিনে কৃষকেরা কী বিপদে আছে, সেসবের কোনও খোঁজ আমরা কতজন রাখতে পারি? না পারি তো কী, ব্যর্থতা ঢাকার জন্য ফুটোস্কোপে ছিদ্রান্বেষণ পরীক্ষিত কৌশল। এই কৌশল আমরা ভালই জানি।
আমপান না হয় গেল, প্রতিদিন কয়েকবার জোয়ারের ঢল আসে, মে মাসে আরও ঝড়ও আসন্ন। এখন দরকার ছিল ওয়াপদাকে ধরার; তারা তো চুরি করে, আইলা–সিডরের ভাঙ্গা বাঁধ আমপানে তাই নিশ্চিহ্ন হয়। কিন্তু না, জাতির মহান ভটভটিগুলোর কাছে পানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ পড়াই দোষের হলো। এটা নির্জলা ভিক্টিম ব্লেমিং। শুধু ভিক্টিম বলি কেন, এই কৃষকেরা তো এ সময়ের সত্যিকার বীর।
ভিক্টিম ব্লেমিং হলো ধর্ষণের শিকারের দোষ খোঁজার মতো, এই কায়দায় মানুষকে কনফিউজ করা যায়। সেটাই করা হলো। বাংলার কৃষকেরা বিপদে–আপদে শহুরে এই বুদ্ধিজীবীদের পায় না, সরকার তো তাদের বিরুদ্ধেই, তাই তারা আল্লাহকে ডাকে। তার শরণ চায়। যে মানুষেরা সকালবেলা দল বেঁধে মাটি কেটেছে কাদায় মাখামাখি হয়ে, তারাই উরুডোবা পানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজটাও পড়েছে। তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা থাকলে সরকারকে বলতেন, বাঁধ বানায়ে দাও যেভাবে পারো।
মাটি, পানি ও আকাশের পদার্থে গড়া কৃষক জীবন। ওই মাটিতে সে চষবে, ওই পানিতে জীবন পাবে আর আকাশের কাছে প্রার্থণা করবে। টলমল পানিতে কঠিন জিদের মানুষেরা সিজদার ভঙ্গিতে দুহাত ছোঁয়াচ্ছে এর থেকে সুন্দর মানবিকতার ছবি আমি কম দেখেছি। এক অপূর্ব মেহনতি কাব্য। ওই নামাজ শেষেই তারা ফিরে যাবে আবার বাঁধ তৈরির এজমালি কাজে। কৃষকের জায়নামাজ তার গামছা, চাষের জমি তার পবিত্র ভূমি, যৌথ জীবন তার ভরসা। কয়েকশ বছরের বঞ্চনার বিরুদ্ধে এটুকুই তার সম্বল, এটা আপনি কেড়ে নিতে পারেন না। আমার বিশ্বাস, সুন্দরবন ও খুলনা অঞ্চলের হিন্দু কৃষকেরাও একইভাবে ভুমি ও পানিতে মিশেই বন্দনা করে। খুঁজলে পশ্চিমবঙ্গের আম্পান–বিধ্বস্ত গ্রামগুলিতে অনুরূপ হিন্দুয়ানি আচরণ দেখা যাবে। এটাই স্বাভাবিক।
কৃষির মানুষের সঙ্গে পরজীবী মানুষের দ্বন্দ্বটা সেই জমিদারি আমলের। বিবর্তিত হতে হতে তা এখন প্রগতিশীলতা বনাম ইসলামের চেহারা নিয়েছে। এই পরজীবীদের জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র কিংবা ইসলামতন্ত্রে কৃষকের মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা নাই। বঙ্গে কৃষির বিস্তারের সঙ্গে ইসলামের বিস্তারের নাড়ির সম্পর্ক। এই নাড়ি কিন্তু কাটা যায়নি। কাটতে গেলে আর কিছু হবে না, বিশাল জনগোষ্ঠীকে ধর্মাশ্রয়ী ফ্যাসিবাদের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। তাতে শক্তিশালী হয় শাসকশ্রেণীর ফ্যাসিবাদ। আমেরিকার নিষ্ঠুরতা যেমন ইরানের কট্টর খোমেনিদের হাত শক্তিশালী করে, তেমনি এইসব ফোড়নজীবীরা একাট্টা করে তোলে দেশীয় ধর্মাশ্রীয় ফ্যাসিবাদীদের।
না দ্বন্দ্বটা ইসলামের সঙ্গে অ–ইসলামের না। বিশুদ্ধতাবাদী ‘ইসলাম’ও বিশুদ্ধতাবাদী ‘আধুনিকে’র মতো কৃষিবৈরী দ্বন্দ্বের হোগাটা কৃষির সঙ্গে রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী শ্রেণীর আর তাদের অর্থনীতির। ফালতু কথাগুলো সেসব হোগা থেকেই আসে।
আমাদের দাদা–পরদাদারা তো সব কৃষকই ছিল। এত বুদ্ধিজীবী, শ্রমিকের কথা বলার বুদ্ধিজীবীও আছে, কিন্তু কৃষকের বুদ্ধিজীবী কই তোমাগো? নাই নাই নাই। নাই বলেই জনপ্রিয় বাংলা আওয়াজ ওয়াজকারীদের কাছ থেকে আসে, আমাদের মতো উন্মূলদের কাছ থেকে আসে না। এইসব ‘হুজুরেরা’ পরজীবী হলেও কৃষকের সুখদুখের সঙ্গে তাদের চিনপরিচয় ভাল। সে সুবাদে তারাই এখন কৃষকের বুদ্ধিজীবী। বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তির এই নতুন বিন্যাস আহমদ ছফা দেখে যেতে পারেননি, আমরা দেখলাম। দেখলাম ষাট থেকে আশি অবধি চলা বুদ্ধিবৃত্তির পরাজয়ের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও সীমা।
লেখক : সাংবাদিক, সহকারী সম্পাদক, দৈনিক প্রথম আলো।