

এক.
জোবায়ের আহমাদ আনসারী সাহেব এমন একজন ব্যক্তি, যার জন্য শুধু আলেমসমাজেরই নয়, সাধারণ মানুষেরও রয়েছে বিস্তৃত এক আবেগ ও ভালোবাসায় জায়গা। এটা তাঁর প্রাপ্যও বটে। দীনের এই মহান খাদেম সারাটি জীবন মানুষের দ্বারেদ্বারে গিয়ে পৌঁছে দিয়েছেন হেদায়াতের বার্তা।
হাজারো পথভোলা মানুষ তাঁর বয়ানের মধ্য দিয়ে পেয়েছে পথের দিশা। তাঁর বয়ান মানুষকে অন্যরকম টানত। সহজসরল উপস্থাপনা ও সুরের মূর্চ্ছনায় অতি সহজেই সাধারণ মানুষ তার কথা গ্রহণ করত। ছিলেন খুব বিনয়ী। সদা হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত এ মানুষটি দীর্ঘদিন রোগশোকে ছিলেন শয্যাশায়ী। গতকাল (শুক্রবার) সন্ধ্যায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। লক্ষ-কোটি মানুষকে কাঁদিয়ে রওয়ানা হন অনন্তকালের উদ্দেশ্যে।
দুই.
তিনি এমন এক সময়ে ইন্তেকাল করেছেন, যখন গোটা দেশই নয়; পুরো বিশ্ব অবরুদ্ধ। স্তব্ধ হয়ে আছে পৃথিবীর চিরচেনা জনপদ। মানুষ আছে ঠিকই। মানুষের প্রাণচাঞ্চল্য নাই। সাড়াশব্দহীন এক ভূতুড়ে অবস্থা বিরাজ করছে মানুষের পৃথিবীতে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো আমাদের দেশ ঠিক এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থার শিকার। প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনাক্রান্তের সংখ্যা। দীর্ঘায়িত হচ্ছে লাশের মিছিল। প্রতিনিয়ত গুনছি মৃত্যুর প্রহর। সবখানে বিরাজমান এক চাপা শঙ্কা। পুরো দেশ কার্যত অচল।
তিন.
আজ (শনিবার) সকাল ১০টায় জানাজা সম্পন্ন হলো নন্দিত এই মুফাসসিরে কোরআনের। লাখো মানুষের ঢল নামে জানাজাজুড়ে। লকডাউনকে একপ্রকার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, সামাজিক দূরত্বের পরোয়া না করেই বেরিয়ে আসে আমজনতা। এককথায় জনসমুদ্রে পরিণত হয় জানাজার স্থান।
চার.
ইসলামের দৃষ্টিতে জানাজা হলো ‘ফরজে কেফায়া’ তথা কেউ এই ফরজ আদায় করলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে আর কেউ আদায় না করলে সবাই গোনাহগার হবে। দেশের বর্তমান অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে, মসজিদের জামাতে নামাজ আদায়ের ব্যাপারে শিথিলতা আনা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট মুসল্লিসংখ্যা করা হয়েছে নির্ধারণ। করণীয় বিষয়েও করা হচ্ছে বারণ।
ঠিক এমন পরিস্থিতিতে একজন মানুষের জানাজায় এভাবে মানুষের হুমড়ি খেয়ে পড়াটা নিঃসন্দেহে এক আজানা হুমকি সৃষ্টি করেছে। এই অতি আবেগই হয়তো থামিয়ে দিতে পারে অসংখ্য জীবনের গতিবেগ। যেমনটি আমরা লক্ষ করেছি পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলঙ্কায়।
সেখানে তবলিগ জামাতের সামান্য অসচেতনতার কারণে হয়েছে অসামান্য ক্ষতি। ঠিক একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এই অসতর্কতার দায় এড়াতে পারে না প্রশাসন থেকে নিয়ে জানাজাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আল্লাহই জানে এই বেপরোয়া রীতিনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়!
পাঁচ.
এদেশে আলেমসমাজের গ্রহণযোগ্যতা ছিল যুগযুগ ধরে। এখনো আছে। এই গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখার দায়িত্বও তাদের। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করলাম অনেক জ্ঞানীগুণী আলেম: যাদেরকে মানুষ আশাভরসার প্রতীক মনে করে, যাদের এক ডাকে লক্ষ মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারাও এব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। উল্টো যেন মানুষকে জানাজায় শরিক হয়ে মৃত্যুর মিছিলকে বেগবান করার মতো অবস্থান ছিল তাদের। ব্যাপারটা দুঃখজনক।
ছয়.
আমরা যেচে সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছি সুযোগসন্ধানীদেরকে। নিজেদেরকে হাসির পাত্র বানাচ্ছি প্রতিনিয়ত। অথচ উচিত ছিল প্রশাসন থেকে নিয়ে সর্বক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সহায়তা করা। আসলে বাঙালি জাতির রক্তে হুজুগ আর রন্ধ্রে রন্ধ্রে অযাচিত আবেগ। এই আবেগই কাল হয়ে দাঁড়াবে না, তা-র নিশ্চয়তা কী? সবশেষ কথা হলো যে-মানুষগুলো আবেগের বশবর্তী হয়ে জানাজায় গেল, কেউ করোনাক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তাদের জানাজায় লোক পাওয়া যাবে তো!
লেখক: মাহদী হাসান মুর্তযা
তরুণ আলেম ও এক্টিভিটিস্ট
বিদায় আনসারী: সব বাধা উপেক্ষা করে জানাজায় লাখো মানুষের উপস্থিতি
জানাজায় জনস্রোত ঠেকাতে না পারায় সরাইলের ওসি প্রত্যাহার
/এসএস