

মুহাম্মদ জিয়াউল হক –
দুই দফায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ৭২,৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা মূলত একটা ঋণ প্যাকেজ। করোনা আগ্রাসনে সম্ভাব্য আর্থিক বিপর্যয় মোকাবেলায় তৈরি পোশাক খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার সাথে প্রধানমন্ত্রী নতুন করে ৬৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। যা জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।
কাদের জন্য এই প্রণোদনা ?
প্রণোদনায় পাঁচটি প্যাকেজ ঘোষণা করে বলা হয়েছে, প্যাকেজ-১: ব্যাংক-ক্লায়েন্ট সম্পর্কের ভিত্তিতে শিল্প ও সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রদান করা হবে ৩০ হাজার কোটি টাকা । এ ঋণসুবিধায় সুদের হার ৯ শতাংশ। সুদের অর্ধেক ঋণগ্রহীতা শিল্প বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং বাকিটা সরকার ভর্তুকি হিসেবে পরিশোধ করবে ।
প্যাকেজ-২: ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো পাবে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণসুবিধা। এতেও সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। ৪ শতাংশ সুদ ঋণগ্রহীতা শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।
প্যাকেজ-৩: বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) এ ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা যুক্ত হবে। ইডিএফের বর্তমান সুদের হার ২.৭৩ % থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হবে।
প্যাকেজ-৪: প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম নামে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণসুবিধা চালু করবে। এ ঋণের সুদের হার হবে ৭ শতাংশ।
প্যাকেজ-৫: রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন–ভাতা পরিশোধ করার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি আপৎকালীন প্যাকেজ ।
বড় শিল্পপতিদের সন্তোষ প্রকাশ :
পিএইচপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহসীন বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা ব্যবসায়ী মহলে স্বস্তি এনে দিয়েছে।” শিল্পপতিরা বলছেন, এই প্রণোদনা হচ্ছে আপদকালীন সুবিধা হিসেবে স্বল্প সুদে ঋণ। এই প্রণোদনার কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাবে। শ্রমিকদের বেতন দেওয়া যাবে। কারো চাকরি যাবে না।
অরপ্তানি খাত:
অরপ্তানি খাতের দেশীয় ব্যবসায়ীরাও এই করোনায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন । দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে ছোট ছোট দোকানি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অবদান অনস্বীকার্য । অথচ প্রণোদনায় তাদের কথা কিছু বলা হয়নি।
কৃষি ও কৃষিজাত শিল্প:
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান খাত কৃষি। এছাড়াও ডেইরি, পোল্ট্রি ও ফিসারিজ ইত্যাদি কৃষির উপখাতের সাথে দেশের আড়াই কোটি পরিবার সম্পৃক্ত। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রণোদনায় কৃষি ও কৃষির উপখাতের জন্য কোনো ঋণ সুবিধার পরিকল্পনা নাই ।
রেমিটেন্স যোদ্ধারাও বঞ্চিত:
করোনার প্রাদুর্ভাবে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় পোনে কোটি প্রবাসীর আয়-রোজগার হুমকির সম্মুখীন । তাদের পাশে দাঁড়ানো সরকারের দায়িত্ব। অথচ প্যাকেজে তাদের জন্য কোনো সুখবর নেই । বলাবাহুল্য বৈদেশিক মুদ্রা আহরনে এবং দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে প্রবাসীদের সীমাহীন ত্যাগ ও শ্রমসাধ্য অবদানের কথা কারোরই অজানা নয় । প্রবাসী ও তাদের পরিবারের কথা প্রধানমন্ত্রী ভুলে যেতে পারেন না।
প্রণোদনা প্যাকেজের সকল প্রত্যক্ষ সুবিধা কেবলমাত্র শিল্প, সেবা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা খাতের জন্যই সুনির্দিষ্ট । এর বাইরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, শিক্ষিত বেকার শ্রেণি , দুস্থজন , অসহায় , বিধবা , ভিক্ষুক , ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু , হকার, দিনমজুর সর্বোপরি অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক – কর্মচারীদের সুরক্ষায় সুস্পষ্টভাবে কিছুই বলা নাই ।
তদুপরি এই প্রণোদনার বাস্তবায়ন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে । প্রণোদনার পুরো অর্থ যোগান দেয়ার দায়িত্ব চাপানো হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের উপর । অর্থনীতির খোঁজখবর রাখেন এমন প্রত্যেকেই জানেন ব্যাংকগুলোর বর্তমান অবস্থা কি। এমনিতেই বিপুল পরিমাণে তারল্য সংকটে ভুগছে ব্যাংকগুলো। তার উপর ২ লক্ষ কোটি টাকার উপরে অনাদায়ী ঋণ আটকা আছে ঋণ জালিয়াত ও খেলাপি চক্রের হাতে। ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের তরফে আহরিত এবং অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা।
করোনার মহামারীতে গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে তাদের সঞ্চয় ও আমানত তুলে নিচ্ছেন ব্যাপক হারে। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোও যথেষ্ট সংকটের মধ্য দিয়ে পথ চলছে । এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক সমূহের পক্ষে ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনার ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার বিপুল পরিমাণ ঋণ সরবরাহ করা কতটুকু সম্ভব , সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে । এছাড়া ব্যাংকিং খাতের ঋণ জালিয়াতি , স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ এবং দুর্নীতির অভিযোগ হরহামেশাই ঘটছে । খোদ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে এমন আশঙ্কার আভাস পাওয়া যায় । প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেছেন, ‘সবাই যেন সততার সাথে কাজ করেন। এই সুযোগ নিয়ে কেউ যেন আবার কোনো রকমের দুর্নীতি-অনিয়ম না করেন।’
যেখানে প্রতিনিয়ত সংবাদমাধ্যমে গরিবের ত্রাণের চাল চুরি ও উদ্ধারের খবর বের হচ্ছে , তাতে জাতির এই দুর্যোগে সুবিধাবাদী লোভী রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট পরস্পরের যোগসাজশে প্রণোদনার অর্থ ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে যায় কিনা; জনমনে এমন আশঙ্কা বিরাজ করছে।
শেষ পর্যন্ত তেল যাবে কার মাথায়?
উন্নয়ন অর্থনীতি নিয়ে যারা ভাবেন তাদের ধারণা, প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এই অনিশ্চিত সময়ে বড় ধরনের ঋণ নিতে উৎসাহী হবেন না। যারা এই ঋণ যথাসময়ে পরিশোধে ইচ্ছুক তারা কিভাবে লোন ফেরত দেবে সে চিন্তাটা করবে সর্বাগ্রে। অপরদিকে যারা ঋণ খেলাপি এবং লোন ফেরত দিতে অনিচ্ছুক তারা এই প্রণোদনা প্যাকেজের সুযোগ গ্রহণ করবে।
একইভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা যাদের অধীনে ১০/২০/৫০ জন শ্রমিক কাজ করে তারা এই মুহূর্তে তাদের ব্যবসা কি করে টিকে থাকবে তা নিয়ে চিন্তিত। কোনো কারণে যদি তারা ঋণ ফেরত দিতে না পারে তাহলে ব্যাংক তাদের জামানত এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবে ।
যাদের ইতোমধ্যে হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে তাদের সম্পদে ব্যাংক হাত দেয়ার সাহস পায়না । এই ব্যবসায়ীক দৈত্যরাই পুনরায় ঋণের নামে হাজার কোটি টাকা লোপাটের সুযোগ পাবে । প্রণোদনায় বলা হয়েছে ব্যাংক-ক্লাইন্ট সম্পর্কের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা ঋণ সুবিধা লাভ করবে। ব্যাংকের সাথে সম্পর্ক ভালো তাদেরই যাদের পেছনে রাজনৈতিক মদদ এবং ব্যবসায়িক ক্ষমতা রয়েছে । ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার শর্ত ও প্রক্রিয়া এতটাই জটিল যে, তারা প্রয়োজনীয় কয়েক লাখ টাকার জন্য ব্যাংকে ধরনা দিতে দিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন ।
অন্যদিকে রাজনৈতিক যোগসাজশ রয়েছে এমন ব্যবসায়ীরা অনায়াসে ব্যাংক লোন পেয়ে যায় । শেষ পর্যন্ত কার তেল কার মাথায় যায় সেটা সময়ই বলে দিবে ।
তবে এই প্রণোদনা যাতে সম্ভাব্য আর্থিক ঝুঁকি মোকাবেলা করতে পারে সেজন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক- কর্মচারী এবং শিক্ষিত বেকারদের অন্তর্ভুক্তি করে পুনর্বিন্যাস করতে হতে পারে ।
জনগণের সকল আশঙ্কা নিরসনে উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ , সুশীল সমাজের প্রতিনিধি , এনজিও , উন্নয়ন সহযোগী , বিরোধী দলসমূহের রাজনৈতিক প্রতিনিধি , সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী , নারী ও ছাত্র – শিক্ষক প্রতিনিধি , ব্যাংকার , সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় , সাংবাদিক প্রমুখের সমন্বয়ে একটি ‘জাতীয় পর্যবেক্ষণ পরিষদ’ গঠন করতে পারলে প্রণোদনার কার্যকারিতা বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।
এই প্রণোদনা কোন স্বাভাবিক প্রণোদনা প্যাকেজ নয় । বরং করোনা মহামারীতে সৃষ্ট সম্ভাব্য জাতীয় অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় একটি বিশাল অংকের ঋণ প্যাকেজ । এই প্রণোদনা কোন কারনে ব্যর্থ হলে কিংবা একপেশে ভাবে ব্যবহৃত হলে, গোটা জাতিকে একটা বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়তে হবে, কাজেই এতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা , ও সুশাসন নিশ্চিত করা সরকারেরই দায়িত্ব ।
লেখক : আহ্বায়ক: সেন্টার ফর সোশ্যাল থট। সাবেক সভাপতি, ঢাকা আলিয়া ডিবেটিং ক্লাব।