

হামেদ বিন ফরিদ আহমদ
আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া জিরি’র প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম ক্ষণজন্মা মনীষী আধ্যাত্মিক পুরোধা আল্লামা শাহ আহমদ হাসান রহ.। সমগ্র বাংলাদেশের আলেম সমাজে এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের সর্বমহলে উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের নাম।
খোদাভীরু মুবাল্লিগ, সাচ্চা দ্বীনের দাঈ কাফেলার অবিরাম কর্মের দীপ্তিময় অগ্রপথিক। নিঃস্বার্থ দ্বীনি দাওয়াত ও তাবলিগের ফেরিওয়ালা।
বরেণ্য এই আলেমে দীন আল্লামা শাহ আহমদ হাসান রাহ. ছিলেন দীর্ঘদেহী, গৌরবর্ণ, স্পষ্টভাষী, নিষ্ঠাবান, সৎসাহসী ও মার্জিত চরিত্রের অধিকারী এবং আকাবিরে দেওবন্দের চেতনায় উদ্ভাসিত এক প্রোজ্জ্বল মনীষী।
জন্ম ও বাল্য জীবন : ১৮৮২ সালের কোন এক শুভ ক্ষণে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানাধীন জিরি গ্রামে এক ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় অনুভূতিসম্পন্ন দ্বীনদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই মহান মনীষী। পিতা অসিউর রহমান ছিলেন সমাজের ঐশ্বর্যশালী পরহেজগার আল্লাহওয়ালা ব্যক্তিত্ব।
মা-বাবার অদ্বিতীয় সন্তান হওয়ার সুবাদে সোনার চামচ মুখে নিয়ে নিতান্ত আদর-সোহাগের পরশে দ্বীনি পরিবেশে বেড়ে উঠেন তিনি।
শিক্ষা জীবন : পারিবারিক ঐতিহ্যানুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা-দীক্ষার হাতেখড়ি পিতার তত্ত্বাবধানে গৃহ শিক্ষকের কাছেই। ঘরে থেকেই বিশুদ্ধ উচ্চারণে কুর’আন তিলাওয়াত, প্রাথমিক কিতাবাদি, উর্দু, ফার্সি, মাতৃভাষা বাংলা এবং ইংরেজি ভাষার মৌলিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৩১৫ হিজরি সনে ১৫ বছর বয়সে চট্টগ্রাম শহরের মোহসেনিয়া মাদ্রাসায় (বর্তমান : মুহসিন কলেজ) ভর্তি হন। তিন বছর এখানে ইলম অন্বেষণে কাটিয়ে পারিপার্শ্বিক কিছু কারণে ১৩১৮ হিজরি সনে উম্মুল মাদারিস হাটহাজারী মাদ্রাসায় চলে যান। সেখানে খ্যাতিমান, যুগশ্রেষ্ঠ বরেণ্য আলেমেদ্বীন, বুজর্গ, আল্লাহভীরু উস্তাদদের সান্নিধ্যে থেকে ইলমে ওহীর অবিমিশ্র পীযূষ পান করে ১৩২৭ হিজরিতে কুর’আন, হাদিস, ফিকহে ইসলামি এবং দর্শনশাস্ত্রে সুগভীর পাণ্ডিত্য নিয়ে শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করেন।
তিনি মাধ্যমিক স্তরে অধ্যয়নকালে ঢাকার নওয়াব সলিমুল্লাহর দাওয়াতে বাংলাদেশে আগমন করেন হাকিমুল উম্মাত মুজাদ্দিদে মিল্লাত আল্লামা শাহ আশরাফ আলী থানভী রহ.। শাহ আহমদ হাসান রহ. স্বীয় উস্তায ও মুরব্বি, বুজুর্গ আলেম মাওলানা হাবিবুল্লাহ রহ. সাহেবের সাথে ঢাকায় থানভী রহ. এর সাক্ষাতে মিলিত হলে তাঁর হৃদয় নিঃসৃত নসীহতে প্রভাবিত হয়ে তাঁর হাতে বাইয়াত হয়ে যান।
শিক্ষাজীবনের শেষদিকে জামাতে উলার বছর নিজ এলাকা পটিয়াতে শিরক, বিদ’আত,কবর পূজা, মাজার পূজা এবং ধর্মীয় কুসংস্কার দূরীকরণ, মুসলমান সন্তানদের বিশুদ্ধ ইসলামি আক্বীদা-বিশ্বাসের সবক দিতে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ার চিন্তাভাবনা করেন।
বাবা অসিউর রহমান এবং লজিং শিক্ষক মাস্টার আশরাফ আলীর পরামর্শে প্রথমে কৈয়গ্রাম অঞ্চলে একটি মাদ্রাসার ভিত্তি রাখেন। কিন্তু নানা প্রতিকূল প্রতিবেশে সেটি বেশিদিন স্থায়ীত্ব হয়নি।
ঐতিহ্যবাহী জিরি মাদরাসার প্রতিষ্ঠা : শাহ আহমদ হাসান দাওরায়ে হাদিস (বর্তমান : মাস্টার্স) শেষ করে ১৩২৮ হিজরি/১৯১০ ইংরজি মোতাবেক প্রতিষ্ঠানটি জিরি এলাকায় স্থানান্তরিত করে প্রথমে “মাদ্রাসা হামিয়্যাতুল ইসলাম, জিরি” নাম দিয়ে “বাদাম” বৃক্ষের নীচে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে থাকেন। (ইতোপূর্বে দেওবন্দ মাদরাসার কার্যক্রম ‘আনার’ গাছের নিচে শুরু হয়েছিল।) পরবর্তীতে তা “আল-মাদ্রাসাতুল আরাবিয়্যা জিরি” এবং সময়ের আবর্তনে বর্তমানে যা “আল জামিয়া আল ইসলামিয়া জিরি” নামে সর্বমহলে পরিচিত।
প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিমের ঐকান্তিক চেষ্টা, শেষ রাতের কান্না, ইখলাসপূর্ণ ত্যাগের নজরানা পেশের ফসল আজকের এই বটবৃক্ষ সদৃশ প্রতিষ্ঠান দেশের অন্যতম বৃহৎ মাকবুল এদারা “জামিয়া ইসলামিয়া জিরি”। যুগের স্রোতধারায় এখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন উপমহাদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুরব্বি, আধ্যাত্মিক পুরোধা মুফতি আজিজুল হক রহ.,অত্যাশ্চর্য ধীমান মুফতি নুরুল হক রহ., শাইখুল হাদিস আল্লামা ইহসানুল হক সন্দ্বীপী রহ., মুফতি ইব্রাহিম চুনতওয়ী রহ., আল্লামা ইসহাক গাজী রহ., আধ্যাত্মিক সম্রাট আলী আহমদ বোয়ালভী রহ., হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রধান মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী, পটিয়া মাদ্রাসার প্রধান মুফতি হাফেজ আহমদুল্লাহ, হাফেজ মাওলানা ফরিদ আহমদ আনসারি, মাওলানা ক্বারি নুরুল্লাহ সাহেব প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত বহুমাত্রিক প্রতিভাশালী আলেম মনীষী।
ইসলাম প্রচারে ভূমিকা : কৈশোর থেকেই ওয়াজ-নসীহত করে মানুষকে সঠিক পথের দিশাদানে অভ্যস্ত ছিলেন শাহ আহমদ হাসান রহ.। হৃদয়গ্রাহী, মুগ্ধকর, চিত্তাকর্ষক ও দরদমাখা উপদেশমালা দিয়ে মানুষকে শিরক, বিদ’আত, কবর পূজা, মাজার পূজা এবং প্রচলিত কুসংস্কার ছেড়ে বিশুদ্ধ আক্বীদা-বিশ্বাস এবং সঠিক উপায়ে আল্লাহর ইবাদতের প্রতি ডাকতেন তিনি। তাঁর দাওয়াতী কাজের ছিল অনন্য বৈশিষ্ট্য। বর্তমান সময়ে বক্তারা যেমন হেলিকপ্টার, বিমান কিংবা নামিদামি গাড়ি হাঁকিয়ে ওয়াজ করতে যান- শেখ আহমদ হাসান রহ. এদের ঠিক উলটো প্রকৃতির ছিলেন। তিনি খুব সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। ওয়াজ করতে যেতেন পায়ে হেঁটে। চট্টগ্রামের বাইরের সফর হলে ট্রেন কিংবা স্বাভাবিক বাহন নিয়ে যেতেন। সাথে করে নিজের খাবারও নিয়ে যেতেন। ওয়াজ-নসীহত করার পর বলে দিতেন আমাকে কোন টাকা-পয়সা দেওয়া যাবে না। তাঁর স্বভাবজাত উচ্চকণ্ঠ দিয়ে মধুর দরদী ভাষায় শিরক, বিদ’আত আর কুসংস্কারের ভয়াবহতা থেকে সমাজের মানুষকে সচেতন করতেন। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলিকে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নিরলস প্রচেষ্টা চালাতেন। বাতিলের অনুক্ষণ চক্রান্ত থাবায় রক্তাক্ত ও বিচ্ছিন্ন স্বজাতিকে রাজপথে তুলে আনবার কী যে আকুলতা ছিল মনে।
বিভিন্ন শাখায় অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী এই আলোকিত হৃদয়ের মানুষটি হাজারো হৃদয়ে সহীহ ফিকিরের বীজ বপন করেছেন। অনেক ছাত্রকে চিন্তা ও গবেষণা, দাওয়াত ও তাবলিগের জন্য তৈরি করে গেছেন। সাধারণ মানুষ ও বিশেষভাবে তালেবানে উলূমে নবুওয়াতের কাছে কুরআন ও হাদীসের আলো বিতরণের মানসে চট্টগ্রাম অঞ্চলসহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় নিজের তত্ত্বাবধান ও পৃষ্ঠপোষকতায় শাগরিদদের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।
আজকের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম শহরের মোজাহেরুল উলুম মাদ্রাসা, শাহমীরপুর মাদ্রাসা, ঝাপুয়া মাদ্রাসা মহেশখালী, দারুল উলুম দেওবাগ নারায়ণগঞ্জ, দারুল উলুম গেরাখালী পটুয়াখালী মাদ্রাসাসহ দেশের অসংখ্য মক্তব এবং মাদ্রাসা আল্লামা শাহ আহমদ হাসান রহ. কর্তৃক বপিত বীজের ফলিত মহীরুহ।
ব্যক্তিগত জীবন : ব্যক্তিগত জীবনে তিনি চার স্ত্রীর পাঁচ কন্যা সন্তানের বাবা ছিলেন। অনেক চেষ্টা তদবিরের পরও তাঁর ঔরসে কোন পুত্র সন্তান বেঁচে না থাকায় তিনি আনোয়ারা থানাধীন গহিরার সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে এক সন্তানের মাতা রশিদা খাতুনকে বিয়ে করেন। তিন বছরের সেই শিশু হাফেজ ইউসুফ রহ.কে আপন সন্তানের স্থান দিয়ে অত্যন্ত স্নেহ-মায়ায় বড় করে তুলেন। পরবর্তীতে নিজের ছোট মেয়ে রুকাইয়াকে তার সাথে শাদি দেন। তাঁর এই পুত্র-জামাতা জিরি মাদ্রাসায় হিফজ বিভাগের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘ ৪৮ বছর কুর’আনের খেদমত আঞ্জাম দেন। শাহ আহমদ হাসান রহ. এর পরবর্তী প্রজন্মে বহু যোগ্য আলেমেদ্বীন তৈরি হয়ে বর্তমানে দেশেবিদেশে উচ্চপর্যায়ে দ্বীনের খেদমত ও দাওয়াতি কাজ করে যাচ্ছেন।
মৃত্যু : শেষ বয়সে এসে দ্বীনের এই দরদী মুবাল্লিগ, কর্মবীর খ্যাতিমান আলেমেদ্বীন বার্ধক্যজনিত জটিল রোগ এবং হাত-পা অবশ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ ছয়মাস কষ্ট ভোগ করে ১৩৮৬ হিজরি/১৯৬৭ খ্রি. মোতাবেক ১১ শাওয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের সময় মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে না ফেরার জগতে পাড়ি জমান। মুহাদ্দিসে জমান আল্লামা আব্দুল ওয়াদুদ সন্দ্বীপী রহ. এর ইমামতিতে জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়ে মাদ্রাসা মসজিদের পূর্বদিকস্থ সমাধিস্থলে তিনি চির শান্তির নিদ্রায় শায়িত হন।
উন্মুক্ত আকাশ চিরকাল তাঁর সমাধিতে কুয়াশা বর্ষণ করুক আর নব উত্থিত দুর্বা-পত্র-পল্লব তাঁর অন্তিম আবাসকে পাহারা দিয়ে রাখুক- এটাই মুনাজাত।
লেখক : মুহাদ্দিস ও আরবি সাহিত্যের শিক্ষক: ইমাম মুসলিম রহ. ইসলামিক সেন্টার, কক্সবাজার।