

পাবলিক ভয়েস : সেতু আছে, রাস্তাও আছে। কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে নেই। রাস্তা গেছে খালের মুখ বন্ধ করে। সেতু আছে খালের ওপর, তার দুই পাড়ে নেই সংযোগ সড়ক। শূন্যে মাচার মতো দাঁড়িয়ে থাকা সেতুটা কারোই কাজে আসছে না। মাঝখান থেকে বন্ধ হয়ে গেছে পানিপ্রবাহ। যোগাযোগের সেতুটা যোগের বদলে বিয়োগের সেতু হয়ে আছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মসুরী গ্রামে।
বছর ১৮ আগের কথা। বিএনপি সরকার তখন ক্ষমতায়। এলাকার উন্নয়নে বানানো হয় মাটির উঁচু সড়ক। কিন্তু তখন সেতু বানানোর বরাদ্দ না থাকায় খালের মুখ বন্ধ করে তৈরি হয় রাস্তা। এর পরে সরকারে আসে আ.লীগ। সেবার বরাদ্দ হয় সেতুর বাজেট। কিন্তু রাস্তাটা তাঁর ব্যক্তিগত জমির ওপর বানানো বলে অভিযোগ তোলেন আওয়ামী লীগের এক নেতা। তাঁর বাধায় সেতুটা রাস্তার ওপর না করে করা হয় খালের ওপর। কিন্তু সংযোগ সড়কের বরাদ্দ নেই বলে সেতুটা দাঁড়িয়ে থাকে শূন্যে।
বিএনপির রাস্তার সঙ্গে আ.লীগের সেতুর এই বনিবনা না হওয়ার ইতিহাস প্রায় ১০ বছরের। সড়কটা শুয়ে এবং সেতুটা দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ কারও কোনো কাজেই আসছে না। মাঝখান থেকে খরচ হয়ে গেছে লাখো টাকা। স্থানীয় মানুষের কথায়, সেতু ও রাস্তা উভয়ই ‘ভিলেজ পলিটিকসের’ শিকার।
৪ পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট সেতু বা কালভার্টটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫ হাত, আর প্রস্থ প্রায় ৮ হাত। পথচারীরা যেতে যেতে নিঃসঙ্গ সেতুটাকে দেখে। খালের পানি সেতুর তলা দিয়ে ধাক্কা খায় রাস্তার ভিতের গায়ে। বইতে পারে না।
১২ জানুয়ারি দুপুরে সেতুর ধারে পাওয়া গেল পেশায় শিক্ষক স্থানীয় এক ব্যক্তিকে। পরিচয় জেনে হাসতে হাসতে বললেন, ‘নিশ্চয়, আপনারা দেখতে এসেছেন এই সেতুটা। অনেকেই আসে। দেখে আর শুধু হাসে।’ নাম প্রকাশে তাঁর ভয়। আক্ষেপের সুরে তিনি বললেন, ‘ভিলেজ পলিটিকস আছে না ভাই? এটা সেই পলিটিকসের ফল।
যারা রাস্তা বানাইছে আর যারা কালভার্ট বানাইছে, হ্যারা চাচাতো-জ্যাঠাতো ভাই। অ্যাগো (এদের) বিএনপি শক্তি আর হ্যাগো (তাদের) আ.লীগ শক্তি। বিএনপি বরাদ্দ করাইছে এই রাস্তা একভাবে, আর আ.লীগাররা সেতু করছে আরেকভাবে। কইছে, এইডা আমাগো ব্যক্তিগত জায়গা, তোরা সরকারি হালটের (হাঁটার কাঁচা রাস্তা) ওপর দিয়া রাস্তা নে আগে।’
পাওয়া গেল স্থানীয় এক কৃষক এবং আরও দুজনকে। নাম প্রকাশে মানা করলেন তিনজনই। ভয় কিসের? বললেন, সেতুর পশ্চিম পাশের জমির মালিক মালেক মাস্টার। তিনি আ.লীগের নেতা, এলাকায় প্রভাবশালী। তিনি চাচ্ছেন না তাঁর জমির ওপর রাস্তা থাকুক।
সড়কের দক্ষিণ পাড়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুল জলিল মিয়ার বাড়ি। সেতুটি কোনো কাজে আসছে না, লোকে হাসাহাসি করছে—এমন কথা জানানোর পর জলিল মিয়ার সাফ জবাব, ‘বাধার কারণে আমরা রাস্তার ওপর সেতু করতে পারি নাই। এখন বরাদ্দ পাইলে সেতুর লগে রাস্তা জোড়া দিমু। অথবা হ্যারা যদি জায়গা দিত, তাইলে হেইখানেই সেতু হইত। হাসার কোনো কারণ নেই।’
জলিল মিয়ার বাড়ির কাছে মালেক মাস্টারের (৯৬) বাড়ি। এলাকায় ‘মালেক মাস্টার’ নামে পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক এখন বেশির ভাগ সময় ঘরেই থাকেন। সেতুটি অকেজো থাকা নিয়ে বললেন, ‘সরকারি জায়গায় রাস্তা বানানোর কথা। কিন্তু বিএনপির লোকেরা আমার জমির ওপর দিয়ে রাস্তা বানাইছে।’
অভিযোগ মালেক মাস্টারের কণ্ঠে, ‘আমি তো আ.লীগার। তাই আমার একটু ক্ষতি তো করণ লাগব হ্যাগো। তাই শত্রুতা কইরা আমার জমি কাইট্টা রাস্তা করেছে। অথচ সরকারি জমি পইড়া রইছে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, রাস্তাটা সোজা এসে খালের কাছে বাঁক নিয়ে ঘুরে আবার অন্য পাড়ে সরল রেখাতেই এগিয়েছে। অর্থাৎ রাস্তা ও সেতু সরল রেখাতেই নির্মিত। সড়ক নির্মাণের সময় সেতু ছিল না বলে ধনুকের মতো কিছুটা বাঁক নিয়েছে রাস্তাটা। সেতুটা নির্মিত হয়েছে রাস্তা বরাবর।
এখন সংযোগ সড়ক বানালেই রাস্তা আর সেতু মানানসইভাবে মিলে যায়। কিন্তু মাঝখানে রাজনৈতিক বিভেদের গর্ত। বিভেদের কারণে সংযোগটা হয়নি। মানুষ চলছে বিএনপির রাস্তায়, আ.লীগের সেতু একা পড়ে আছে।
নিজ বাড়ির জানালা দিয়ে মালেক মাস্টার বাইরে ইশারা করে দেখান, ‘হালটের (কাঁচা মাটির চিকন সড়ক) ওপর দিয়া রাস্তা নিবার কথা। তা না কইরা আমার জমির মাটি কাইট্যা রাস্তা নিছে। ব্রিজ তো খালের ওপরই রইছে, এহন ব্রিজ বরাবর রাস্তা নিক, আমার জায়গা ছাইড়া দিক।’
গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্ষমতার পালাবদল হলে মালেক মাস্টার রাস্তার তলা থেকে জমি উদ্ধারের উদ্যোগ নেন। তাই কয়েক বছর আগে সরকারি জমিতে ওই খালের ওপর বানানো হয় ছোট্ট এই ‘সেতু’। স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুল জলিল মিয়া জানান, ‘বাজেট পেলে রাস্তার সঙ্গে সেতুর সংযোগ দেওয়া যাবে।’
রূপগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু হোসেন ভূঞা শনিবার এলাকায় ছিলেন না। সেতু-সড়ক জটিলতা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আগে সেতু হয়েছে, পরে রাস্তা।’ পুনরায় মেম্বার জলিল মিয়া ও মালেক মাস্টারের দেওয়া তথ্য জানানো হলে তিনি বক্তব্য বদলান, ‘অনেক আগের ঘটনা তো। অপ্রয়োজনীয় সেতু সব ভেঙে ফেলা হবে।’ রূপগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের সচিব হাবিব উল্লাহ মুঠোফোনে জানান, মসুরী এলাকায় আগে রাস্তা পরে সেতু হয়। সরকারি টাকায় এই সেতু বানানো হয়।’
সেতুটি বানানোর খরচ জানতে চাইলে হাবিব উল্লাহ বলেন, কাগজপত্র না দেখে সঠিক করে বলা যাবে না। তবে আনুমানিক দেড় লাখ টাকার ওপরে খরচ করা হয়। সেতুর ঠিকাদার আমিনুল হক জানান, ‘দেড় থেকে দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে সেতুটি বানাতে।’ এভাবে সেতুটি কেন বানালেন? তাঁর জবাব, ‘রাস্তার পাশেই সেতুটি করতে গিয়েছিলাম। এলাকার লোকজনও বলেছিল, রাস্তা পরে ঘুরায় দেবে। ওইভাবে করেছিলাম।

সেতু ঠিকই আছে খালের ওপর কিন্তু তার দুই পাড়ে নেই সংযোগ-সড়ক।
কোন্দলের কারণে এলাকার লোকজন রাস্তা আর ঘুরায়নি।’রূপগঞ্জের মসুরী খালের ওপর এমন ‘সেতু’ বানানোর বিষয়টি মুঠোফোনে রূপগঞ্জ উপজেলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলামকে জানানো হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে কেউ বিষয়টি তাঁকে জানায়নি। জানার পর সেতুটি দেখতে লোক পাঠিয়েছেন। সোমবার দুপুরে জানালেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে প্রতিবেদন আকারে সমস্যাটি সমাধানের জন্য জানাবেন।
সেতু ঠিকই আছে খালের ওপর কিন্তু তার দুই পাড়ে নেই সংযোগ-সড়ক।সড়ক বানানোর সময় সেতু না থাকায় রাস্তা বানানো হয় একটু ঘুরিয়ে, আর সেতু বানানোর সময় স্থান বাছাই করা হয় রাস্তা থেকে দূরে। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রায় ১০ বছর। খালটা বুজে এসে কচুরিপানায় ভরাট নালার দশা পেয়েছে। একসময় সেচসুবিধা দেওয়া খালটি সংযোগ হারিয়েছে শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে।