চরমোনাই তরিকা এবং জিকিরের লাফালাফি

প্রকাশিত: ২:৫৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ৩, ২০২০

চরমোনাইর ফালগুনের মাহফিল শেষ হয়েছে। এবারের মাহফিলে নিকট অতীতের প্রায় সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ব্যাপক ধর্মপ্রাণ মুসল্লির সমাগম ঘটেছে। লাখ লাখ মানুষ ধর্মীয় এবং আধ্যাতিক চেতনার সরবরে অবগাহন করেছেন। তিনদিন ব্যাপী রুহানিয়াত এবং জিহাদের সজীবতা নিয়ে সবাই গন্তব্যে ফিরেছেন।

শরীয়তের মাপকাঠিতে চরমোনাই তরিকার বিশুদ্ধতা নিয়ে দেশ বিদেশের নির্ভরযোগ্য কোনো আলেমকে আপত্তি তুলতে দেখা না গেলেও কিছু খুচরা আলেম ইদানিং এই তরিকার বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার। তারা বলেন, চরমোনাই তরিকার বাতানো ‘ইল্লালাহ’ জিকির জায়েজ নেই। ভেদে মারেফত বইতে ভুল আছে। শুধু ভুল না, মারাত্মক ভুল। শিরক তুল্য ভুল।

আরেকটি অভিযোগ হলো এই তরিকার অনুসারীরা জিকির করতে গিয়ে লাফালাফি, ঝাপাঝাপি করেন। যা নিয়ে একজন প্রবাসী সাংবাদিক ভিডিও ক্লিপ বানিয়েছেন। তিনি সেখানে দেখানো চেষ্টা করেছেন, চরমোনাইর পীর সাহেবের মুরিদরা জিকিরের সময় বা বয়ানের সময় যেভাবে লাফালাফি করেন তা সরাসরি হিন্দু সংস্কৃতি থেকে এসেছে।

মাহফিলের এক বয়ানে এসব অভিযোগের পুংখানু উত্তর দেয়ার চেষ্ট করেছেন মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম। তিনি কোরআন হাদীসের আলোকে বিস্তর ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু তার ব্যাখ্যা শুনে সমালোচকরা থেমে যাবেন বা থেমে গেছেন বলে মনে হয় না। তারা তাদের কুৎসিত বাদ্য বাজানো অব্যাহত রেখেছেন।

আমি আলেম নই। কোরআন হাদীসের আলোকে এগুলোর ব্যাখ্যা করা আমার কাজ নয়। তবে সহজভাবে যা বুঝি- অভিযোগগুলো গ্রহণযোগ্য করতে হলে গ্রহণযোগ্য আলেমদের থেকে অভিযোগ আসতে হবে। দেশ বিদেশের যেসব আলেমদের সবাই গ্রহণযোগ্য, নির্ভরযোগ্য মনে করে তাদের কাছ থেকে যৌক্তিক আপত্তি উঠতে হবে।

নির্ভরযোগ্য ফতোয়া বোর্ড বা ফতোয়া কাউন্সিল থেকে জায়েজ, না জায়েজের ফতোয়া আসতে হবে। নয়তো হিসু করে কাঁথা ভেজানো ছেলেদের অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না। বড়জোর সাধারণ মানুষকে সাময়িক বিভ্রান্ত করা যাবে।

মার্কিন প্রবাসী সাংবাদিকের ভিডিওটি আমাকে আহত করেছে। আমি মনে করি চরমোনাই তরিকার অনুসারীদের লাফালাফি ঝাপাঝাপির সাথে হিন্দু সংস্কৃতির তুলনা করা কোনোভাবেই সঠিক হয়নি। এতটা নিচে নেমে বিদ্বেষ ছড়ানো তার উচিৎ হয়নি। কথিত লাফালাফি যদি এতই খারাপ কিছু হতো, শরীয়ত বিরোধী হতো তবে দেশ বিদেশের হক্কানি আলেমরা নিশ্চই চুপ থাকতেন না। তারা খোলাখুলি এর বিরুদ্ধে কথা বলতেন, ফতোয়া দিতেন। হিসুর ছেলেদের এত কসরত করতে হতো না।

আমি কাছ থেকে তাদের লাফালাফি দেখেছি এবং ওই লাফালাফির ব্যাখ্যা করার ভাষা আমার জানা নেই। এটা সম্পূর্ণ আধ্যাতিক ব্যাপার। এর রহস্য উদঘাটন করতে হলে এর মধ্যে প্রবেশ করতে হবে। ভিডিওতে বাঁশ বাওয়া দেখে কোনোভাবেই সঠিক বিষয়টা বোঝা যাবে না, ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে না।

‘ইল্লালাহ’ জিকির বিষয়ে আমি যা বুঝি- কোনো বিদেশি ভাষা সরাসরি অনুবাদ করলে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বোধগম্য হয় না, অর্থবোধক হয় না। সুতরাং ‘ইল্লালাহ’র সরাসরি বঙ্গানুবাদ ধরলে একটু গোলমেলে মনে হতেই পারে। কিন্তু যদি এর আধ্যাতিকতা বিবেচনা করা হয়, এর মৌলিক দিক বিবেচনা করা হয়, এই জিকিরের ধ্যান বা খেয়াল বিবেচনা করা হয় তবে মোটেও গোলমেলে মনে হওয়ার কথা নয়। আর যদি সত্যিই ‘ইল্লালাহ’ জিকির না জায়েজ হতো তবে দেশ বিদেশের গ্রহণযোগ্য আগেমগণ অবশ্যই মুখ খুলতেন, ফতোয়া দিতেন বলে মনে করি।

পীর বা শায়েখতন্ত্রের মাধ্যমে বাতানো জিকির আজকার মূলত সাধনার একটা মাধ্যম। আল্লাহর নৈকট্য লাভের সাধনা করার জন্য একেক জন পীর সাহেব একেক পদ্ধতিতে এসব জিকিরের সবক দিয়ে থাকেন। যেমন, কেউ জোরে জিকির করতে বলেন, কেউ আস্তে করতে বলেন, কেউ মিডিয়াম করতে বলেন, কেউ আস্তে এবং জোরের সংমিশ্রণে করতে বলেন, ইত্যাদী। এসব পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। এগুলো একেবারেই আধ্যাত্মিক বেপার। ধারণা করার ব্যাপার। দূর থেকে বোঝার বিষয় নয়।

এগুলোর আধ্যাতিক গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, সাইনটিফিক প্রভাবও বেশ মজার। যেমন চরমোনাই তরিকার আলেমরা বলেন, ‘ইল্লালাহ’ বলার সময় বুকের বাম পাশে মাথা ঝুকিয়ে ধাক্কা দিতে হবে, যেনো কলবের ময়লা দুর হয়ে যায়।

বিজ্ঞান বলে যদি কোনো মানুষ সকাল বিকাল অন্তত কিছু সময় ডানে বায়ে মাথা ঘুরিয়ে জিকির করে তার হার্টে কোনোদিন ব্লক সৃষ্টি হবে না। তার ব্যাক পেইন হবে না। সারভিক্যাল পেইন হবে না। শরীরে এবং মস্তিস্কে রক্ত সঞ্চালন বাড়বে, যা অন্তত ২১ পদের রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হবে। বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধির জন্য কাজ করবে।

আমরা খুব সহজে সমালোচনা করে ফেলতে পারি, কিন্তু একটু তলিয়ে দেখি না, চিন্তা করি না। এসব পদ্ধতি একদিনে তৈরী হয়নি। হুট করে কেউ চাপিয়ে দেয়নি। এগুলো সাধক মানুষদের যুগযুগ ধরে সাধনার ফল। এক ফুৎকারে ফেলে দেয়ার বিষয় নয়। যদি তাই হতো তবে যুগযুগ ধরে সত্যিকারের সাধক এবং গ্রহণযোগ্য আলেমরা এগুলোর ব্যাপারে চুপ থাকতেন না। তারা নিজেরা এসব পদ্ধতি চর্চা করতেন না।

যারা এগুলোর প্রচলন ঘটিয়েছেন তারা আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো নন। তারা ধর্মীয় সাধক মানুষ। আধ্যাত্মিক চেতনার মানুষ। তারা হয়তো এগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেননি, কিন্তু একটু মাথা খাটালেই বোঝা যায় এগুলো কোনো বায়বিয়ো বিষয় নয়। এর ভেদ, এর মারেফত অনেক গভীরে।

ভেদে মারেফতসহ মোট ২৭টি বই লিখেছেন চরমোনাই তরিকার প্রতিষ্ঠতা পীর সাহেব মাওলানা সৈয়দ ইসহাক (রহ)। তার লেখা বইগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়লে বোঝা যায় তিনি কতো বড় মাপের সাধক ছিলেন। কিন্তু কেউ যদি উদ্দেশ্য প্রণদিত হয়ে পড়েন, আগে থেকে কোনো সিদ্ধান্ত ঠিক করে পড়তে বসেন তার কাছে অনেক কিছুই অসঙ্গত মনে হতে পারে। এ সীমাবদ্ধতার জন্য কোনোভাবেই এসব বই বা বইয়ের লেখককে দায়ী করা যুক্তিযুক্ত হবে না।

সাধক, সংস্কারকদের চিন্তার জায়গা আর দশজন সাধারণ মানুষের চিন্তার জায়গা কখনো এক হয় না। একজন সাধক মানুষ যখন তার সাধনালব্ধ কোনো বিষয়ে লেখেন বা বলেন তখন তা সর্বসাধারণের কাছে বোধগম্য নাও হতে পারে। এর জন্য ওই সাধক বা তার প্রতিনিধির ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে হয়। মনগড়া কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করলে তা সঠিক হয় না। সুবিচার হয় না।

সাধকরা অনেক সময় সাধারণ মানুষের কাছে সহজ করে তুলতে অনেক উদাহরণ ব্যাবহার করেন, কিন্তু সেটাকে যদি কেউ মূল উপজিব্য ধরে বসে থাকেন সে দায় কোনোভাবেই ওই সাধকের হতে পারে না।

যেমন আল্লামা আহমদ শফি সাহেব নারীকে তেঁতুলের সাথে তুলনা করে বক্তব্য রেখেছিলেন। যার মস্তিস্ক সামান্য কাজ করে তারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে তিনি নারীকে ছোট করার জন্য ওকথা বলেননি। তিনি মানুষের কাছে সহজবোধ্য করার জন্য উদাহরণ হিসাবে তেঁতুলের প্রসঙ্গ টেনেছেন।

কিন্তু কেউ যদি এর অপব্যাখ্যা করে সে দায় কোনো ভাবেই শফি সাহেরে উপর বর্তায় না। একই ভাবে চরমোনাইর পীর সাহেবরা অনেক সময় জাহাজ, বয়রা জাতীয় উদাহরণ ব্যাবহার করেন মানুষকে সহজে বোঝাতে, কারণ তারা নদী প্রধান এলাকার মানুষ। এসব উদাহরণ তাদের কাছে বেশি সহজ মনে হতে পারে, কিন্তু এসব সাধারণ বিষয় যদি কারো বুঝতে অসুবিধা হয় তবে তার মানষিক চিকিৎসা করা উচিৎ বলে মনে করি।

সৈয়দ ইসহাক (রহ) একজন সাধক আলেম ছিলেন। যে সময় তিনি ওই বইগুলো লিখেছেন তখন আলেম সমাজের মধ্যে বাংলা চর্চার প্রচলন খুব বেশি ছিল না। সুতরাং তার উপস্থাপন, শব্দ চয়ন, ভাষার গাথুনিতে ত্রুটি থাকতে পারে, তাই বলে একেবারে শিরক বেদাতের পর্যায় নিয়ে যাওয়া কোনো যুক্তিতেই সঠিক হয় না।

আমি মনে করি এসব বিষয়ে বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিৎ। যেমন আলাদা প্রশ্ন উত্তর সেল গঠন করা। কারো যদি কোনো আপত্তি থাকে, অভিযোগ থাকে, প্রশ্ন থাকে তারা ওই সেলের সাথে যোগাযোগ করবে। সেলের আলেমগণ কোরআন হাদীস এবং বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা প্রদান করবেন। প্রয়োজনে দেশ বিদেশের বিজ্ঞ আলেমগণের মতামত গ্রহণ করবেন। প্রতি মাহফিলে অপব্যাখ্যাকারীদের কথার উত্তর দিতে গিয়ে সময় নষ্ট করার কিছু নেই।

অনেক সময় উপস্থাপন বা ভাষাগত কারনে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। একটা পজেটিভ বিষয়ে দুই একটা শব্দ ঘুরিয়ে দিলে নেগেটিভ ব্যাখ্যা দাঁড়িয়ে যায়। যে কারনে পৃথিবীর সকল বিখ্যাত লেখকদের বই সম্পাদনা করা হয়। সুতরাং ভাষাগত বা উপস্থাপনগত কারনে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছে কীনা সেদিকে নজর দেয়া দরকার। হয়তো মৌলিক বিষয় ঠিক রেখে সামান্য সম্পাদনা করলে, কিছু শব্দে পরিবর্তন আনলে অপব্যাখ্যার সুযোগ সংকুচিত হয়ে যাবে। এ বিষয়গুলো ভাবা দরকার।

পলাশ রহমান
লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক

মন্তব্য করুন