

অবতরণিকা : শায়খ প্রফেসর ড. ইউসুফ আবদুল্লাহ আল-কারযাভী (১৯২৬-) মিশরীয় বংশোদ্ভূত একজন প্রভাবশালী আধুনিক ইসলামী তাত্ত্বিক ও আইনজ্ঞ। ইসলামী ধর্মতত্ত্বিকদের অভিজাত সংগঠন International Union of Muslim scholars এর চেয়ারম্যান। আধুনিক উদ্ভূত নানা জটিল সমস্যার সাবলীল ও গভীর ইজতিহাদী সমাধানমূলক শতাধিক গবেষণা গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। তার গ্রন্থগুলো প্রকাশের সাথে সাথেই পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে জ্ঞানী, গবেষক ও সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে ।
আকিদায় সুন্নি, আমলে সালাফি , ইজতিহাদে ভারসাম্যবাদী এবং ইসলামের পুনর্জাগরণে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমন্বিত পরিকল্পিত আন্দোলনকামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে শায়খ ইউসুফ আল কারযাভী বর্তমান দুনিয়ায় বে-মেছাল।
ইসলামী দুনিয়ার যে কজন প্রভাব বিস্তারকারী পন্ডিত শীর্ষস্থানে অবস্থান করছেন তাদের সাথে কারজাভীর পার্থক্য এখানে যে; তিনি ইসলামের ব্যাখ্যা ও প্রচারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন ‘সেফ জোনে’ আশ্রয় না নিয়ে বরং মানব জীবনের ও বিশ্বসমাজের রাজনীতি , অর্থনীতি , সংস্কৃতি , গণমাধ্যম , শিক্ষা , বিজ্ঞান ও শিল্পকলায় সমানভাবে কাজ করতে ভালোবাসেন । কোরআন ও সুন্নাহর দ্ব্যর্থহীন বক্তব্যগুলোকে যুগোপযোগী ব্যাখ্যার মাধ্যমে সামনে নিয়ে আসার ফলে তার ওপর নির্যাতন ও অপমানের খড়গ হস্ত নেমে এসেছে । তার জীবনে একাধিকবার কারাবরণের ঘটনা ঘটে , স্বৈরশাসন বিরোধী অবস্থানের কারণে মাতৃভূমি ছেড়ে তিনি চলে যেতে বাধ্য হন এবং কাতারে তিন দশকের নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন । যুক্তরাষ্ট্র , যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের কিছু দেশে তিনি নিষিদ্ধ।
হাফেজ ইউসুফের বিরল প্রতিভার মূল্যায়ন এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে অসম্ভব। তাঁর মতামতগুলোর সবিস্তার পর্যালোচনায় সময় ও স্থানের ব্যাপক সংকুলান আবশ্যক । শতবর্ষী ছুঁই ছুঁই বর্ষীয়ান এই ধর্মতাত্ত্বিকের বিস্তৃত জ্ঞান ভান্ডার নিয়ে কয়েক ডজন পিএইচডি অভিসন্দর্ভ লেখা যেতে পারে । বর্ণিল জীবনের গোধূলি লগ্নে এসেও জ্ঞান ও তথ্যের এই প্রদীপ্ত সূর্য পৃথিবীতে এখনো মধ্য বেলার তেজস্বী দিবাকরের ন্যায় জাজ্জ্বল্যমান।
জন্ম : ৯ সেপ্টেম্বর ১৯২৬ মিশরের ‘গারবিয়্যা’ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।
শিক্ষা : হিফজ সম্পন্ন করে আল-আজহার কারিকুলামে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করেন। উচ্চ মাধ্যমিকে জাতীয় মেধায় দ্বিতীয় হন। প্রাচীন ইসলামী বিদ্যাপীঠ আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উসুলুদ দ্বীন অনুষদ থেকে অনার্স, আরবি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবন : মিসরের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘Institute of Imams’ এর পরিদর্শক হিসেবে কর্মজীবনে পদার্পণ করেন। কিছুদিন তিনি আওকাফ মন্ত্রণালয়ের ‘Board of Religious Affairs’ এ কর্মরত ছিলেন । ১৯৭৭ সালে তিনি কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শরীয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের প্রতিষ্ঠাকালীন ডীন নিযুক্ত হন । ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি এখানে কর্মরত থাকেন এবং একই বছর তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সীরাত ও সুন্নাহ গবেষণা কেন্দ্র’। ১৯৯০-৯১ সালে আলজেরিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের Scientific Council এর চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন । ১৯৯২ সালে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সীরাত ও সুন্নাহ গবেষণা কেন্দ্রের ডিরেক্টর হিসেবে পুনরায় কাতার ফিরে আসেন । বর্তমানে সেখানে কর্মরত আছেন।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে : ডক্টর ইউসুফ তার অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন পান্ডিত্যের কারণে আরব- আজমের বিভিন্ন একাডেমিক সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় সম্পৃক্ত আছেন।তিনি জর্ডানের Royal academy for Islamic culture and research , ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (OIC), রাবেতা আল আলম আল ইসলামী, এবং ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টার, অক্সফোর্ড এর সম্মানীত সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শাইখ আল কারযাভী আয়ারল্যান্ড ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা European Council For Fatwa and Research এর প্রধান হিসেবেও কর্মরত।
বাংলাদেশের সাথেও ইলমী ও ঈমানী সম্পৃক্ততা রয়েছে ড. কারযাভীর। তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (IIUC) এর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। এছাড়াও তাঁর সুযোগ্য ভাবশিষ্য চট্টগ্রাম দারুল মাআ’রিফের সহকারী পরিচালক মরহুম ড. জসীমউদ্দীন নদভীর শায়খ ও পরামর্শক হিসেবে নদভীকে তিনি বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি প্রদান করেন। নদভী র. এর ঘনিষ্ঠ সূত্র মতে শায়খ ইউসুফ তাঁর সুপ্রিয় নদভীর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কথা জানতে পেরে যারপরনাই আনন্দিত ও কৌতুহলোদ্দীপ্ত হন এবং নদভী’র বাংলাদেশ ফ্লাইট বাতিল করে এক সপ্তাহ ধরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ খবর নেন এভাবে বাংলাদেশের সংস্কারপন্থী রাজনীতির প্রতি তাঁর দূরবর্তী কিন্তু আন্তরিকতাপূর্ন সমর্থন পাওয়া যায় ।
গণমাধ্যমে ইসলাম প্রচারে তার ভূমিকা: ড. কারযাভী অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও গণমাধ্যমকে ইসলাম প্রচারকার্যে ব্যবহারের পথিকৃৎ। ড. কারযাভীর ‘আশ শারীআহ ওয়াল হায়াহ্’ (শরীয়ত ও জীবন) শিরোনামের টিভি প্রোগ্রামটি বিশ্বের সর্বাধিক দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠানসমূহের একটি। আল জাজিরা টিভি সম্প্রচারিত এ অনুষ্ঠানটির বিশ্বব্যাপী নিয়মিত দর্শক সংখ্যা ৬০ মিলিয়ন (৬ কোটি) বলে অনুমান করা হয়। গণমাধ্যম মাত্রই ‘ক্ষতিকর’ তিনি এমনটা মনে করেন না। বরং অনেকক্ষেত্রেই জনসাধারণের কল্যাণে মিডিয়াকে ব্যবহার করা যায় বলে তিনি মনে করেন। এ বিষয়ে প্রদত্ত এক ফতোয়ায় তিনি বলেছেন:
“টিভি, রেডিও, ম্যাগাজিন এবং সংবাদপত্র বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে। এই মাধ্যমগুলো ভালো বা মন্দ, আইনসঙ্গত কিংবা আইনবিরুদ্ধ , আমরা এ রকম কোনো সংকীর্ণ অর্থ আরোপ করতে পারি না। এটি নির্ভর করছে এ সকল মাধ্যম কী উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে, প্রচারিত অনুষ্ঠানের মান কেমন, কী তথ্য তুলে ধরছে – এসবের উপর। যেমন, একটি অস্ত্র কেউ আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে, আবার কেউ কোনো অন্যায় কাজেও ব্যবহার করতে পারে। … সংক্ষেপে আমি বলতে পারি, টিভি এবং অন্যান্য সকল মিডিয়া ভালো-মন্দ এবং ন্যায়-অন্যায় – উভয়ই তুলে ধরতে পারে। এক্ষেত্রে মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে পরিস্থিতি বুঝে নিজের বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী কাজ করা। টেলিভিশনে যখন ভালো কিছু কিংবা ইসলামসম্মত কোনো আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় তখন কোনো মুসলিম তা দেখতে পারে। অন্যথায় টিভি বন্ধ করে রাখতে পারে।” গণমাধ্যম সম্পর্কে তিনি শুধুমাত্র এই মত প্রকাশ করেই তার দায়িত্ব শেষ করেননি; বরং গণমাধ্যমে তিনি সরব বিচরণ করে দেখিয়েছেন কিভাবে গণমাধ্যমের কল্যাণে বিভ্রান্তিকর পৃথিবীতে ইসলামের সঠিক ও প্রকৃত বার্তা পৌঁছানো সম্ভব ।
১৯৭০ সালে কাতারে প্রথম বেতার কেন্দ্র খোলা হলে কারযাভী তখনই এর মাধ্যমে ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করেন। কিছুদিন পর কাতারে টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হলে সেখানেও তিনি একই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। শুক্রবার ও রমজানে এই টেলিভিশনে সম্প্রচারিত বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে কাতার থেকে আল জাজিরা স্যাটেলাইট টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু করে। আর ১৯৯৬ সালেই কারযাভী সেখানে ‘শরীয়াহ ও জীবন’ শীর্ষক একটি সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান শুরু করেন। এই অনুষ্ঠানটিও ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। নব্বই দশকের শেষ দিকে কারযাভী দুটি ওয়েবসাইট চালু করেন। ১৯৯৭ সালে www.qaradawi.net এবং ১৯৯৯ সালে www.islamonline.net চালু করেন।
নানা দৃষ্টিভঙ্গি :
ইউসুফ আল কারযাভী শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি অর্থনীতি রাজনীতি সম্পর্কে তার অধিত গবেষণালব্ধ জ্ঞানের আলোকে বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেন । এ সংক্রান্ত কিছু আলোচনা পেশ করা হল।
শিক্ষার সংস্কার প্রস্তাব: “আরব এবং অন্যান্য মুসলিম দেশে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন পর্যন্ত কোনো কিছু বুঝা বা উপলব্ধি করার চেয়ে অনেক বেশি মুখস্তবিদ্যা নির্ভর।” আর তাই “আমাদেরকে অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে।”
বিজ্ঞান চর্চায় তার দৃষ্টিভঙ্গি : ইসলাম ও বিজ্ঞানের সামঞ্জস্যতার ব্যাপারে যে কোনো সন্দেহ নেই, তা তিনি বিভিন্ন ফতোয়ায় তুলে ধরেছেন। যেমন তিনি লিখেছেন,
ইসলাম বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও গবেষণাকে স্বাগত জানায়। ইসলামের ইতিহাসের কোথাও ইসলাম ও বিজ্ঞানের মাঝে বিরোধের কোনো প্রমান পাওয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে, ইসলামের দৃষ্টিতে, বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় উন্নতি অর্জন করা জাতির জন্যে ফরজে কেফায়া বা সামষ্টিক কর্তব্য। তবে এই অগ্রগতি অবশ্যই ধর্মবিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না।
রাজনৈতিক অবস্থান : তিনি সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের বিপরীতে আল্লামা ইকবালের মতই আন্তর্জাতিকতাবাদের একজন জোরালো সমর্থক।
ড. ইউসুফ আল কারযাভী সমাজ বিচ্ছিন্ন জ্ঞান সাধনায় বিশ্বাস করেন না। জীবনঘনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা স্পষ্ট। তিনি ইসলামকে চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করার পক্ষে একজন বহুমাত্রিক চিন্তাযোদ্ধা । ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন এবং উদারতাবাদের ছদ্মাবরণে শিথিলতা ও মৌলিক আদর্শচ্যুতি নীতিকে ভ্রান্ত মনে করেন। বরং রাসূলুল্লাহর (সা.) অনুসৃত দ্বীন কায়েমের মধ্যমপন্থী নীতিকে সঠিক ও একমাত্র উপায় বলে মত দেন ড. কারযাভী। নিজেকে তিনি ‘আধুনিক সংস্কারবাদী’ হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন । জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কে ইসলামপন্থার জন্য সহায়ক বলে তিনি মনে করেন না । জন্মভূমি মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমীনের সাথে তিনি উতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। সাইয়িদ কুতুবের পর তাকে ইখওয়ানের প্রধান তাত্ত্বিক নেতা মনে করা হয়। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই ইসলামী আন্দোলনে একনিষ্ঠভাবে সক্রিয় ছিলেন।
আন্তর্জাতিক ইংরেজি সাময়িকী person of the year the Muslim 500 জার্নালে ইউসুফ আল কারযাভীকে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং বলা হয়-
“Qaradawi is the intellectual leader of the Muslim Brotherhood. He has twice turned down offers to be their leader—in 1976 and 2004—preferring to be free of institutional restrictions.” (ব্রাদারহুডের কেন্দ্রীয় অবস্থানে থেকেও নেতৃত্বের প্রতি তিনি ছিলেন নির্মোহ। এজন্য ১৯৭৬ ও ২০০৪ এ দুই দফায় ব্রাদারহুডের প্রধান নেতৃত্ব গ্রহণের প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দেন)
ড. কারযাভী শুধুমাত্র মিসর নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচালিত ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের একজন উপদেষ্টা, পর্যালোচনাকারী এবং তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, মিন্দানাও সহ বিভিন্ন দেশের আজাদী আন্দোলনসমূহের জোরালো সমর্থক ।
রাজনৈতিক ফতোয়া : মুসলিম বিশ্বে জেঁকে বসা স্বৈরশাসনের অবসানকল্পে আরব বসন্তকে তিনি জোরালোভাবে সমর্থন করেন। এমনকি কর্নেল গাদ্দাফিকে হত্যার ফতোয়াও জারি করেন। সিরিয়ায় আসাদের শাসনকে তিনি অবৈধ ঘোষণা করেন। হাফেজ ডক্টর মুহাম্মদ মুরসি অপসারণের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন মুরসিকে সমর্থন করা ছিল জরুরী।
দেশদ্রোহীকে সমর্থনে প্রদেয় শায়খুল আজহার এর বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন এ সম্পর্কে দি মুসলিম ফাইভ হান্ড্রেড জার্নালে প্রকাশিত কারযাভী অধ্যায়ে বলা হয়, “Qaradawi vocally supported the ‘Arab Spring’ movements issuing fatwas for the killing of Colonel Gaddafi, and fatwas against the Asad regime in Syria. He also issued a fatwa condemning the overthrow of Morsi, saying that it was an obligation to continue to support Morsi. He advised Al-Sisi to remain neutral and protect the legitimate rule of government. Finally, he criticised the Sheikh AlAzhar for supporting a rebellion against the ruler of a country”.
বেশিরভাগ ধর্মীয় পণ্ডিত যেখানে রাজনীতিকে পাশ কেটে যান সেখানে কোন প্রকার রাখ-ঢাক না রেখেই কোরআন সুন্নাহ এবং সমসাময়িক বাস্তবতাকে সামনে রেখে তিনি সুস্পষ্ট কথা বলেন এবং এটা কে তিনি বলেন “সিয়াসি ফিক্বহ্”।
স্বৈরশাসনের স্পষ্ট বিরোধিতা: মুসলিম বিশ্বে স্বৈরতান্ত্রিক দমনমূলক শাসন নীতির সমালোচনা করে কারযাভী বলেন , যতদিন পর্যন্ত আমাদের দেশগুলোতে বলপূর্বক শাসন চলবে, স্বাধীন ব্যক্তিদের ডিটেনশন ক্যাম্প ও জেলখানায় নিক্ষেপ করা হবে, শাসকেরা লাঠি হাতে দেশ শাসন করবে, বিচারকদেরকে একের পর এক গ্রেফতার, কারারুদ্ধ ও অত্যাচার করা হবে এবং রাজনৈতিক দল গঠন ও সংবাদমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে; ততদিন পর্যন্ত আমাদের জাতি পশ্চাৎপদতার বেড়াজালে বন্দি থাকবে। স্বাধীন মানুষের নেতৃত্বেই একটি জাতির জন্ম হয়। তারাই জাতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমরা যদি দাসত্বের শেকলে আবদ্ধ থাকি, তাহলে এই জাতি প্রয়োজনীয় সময়ে কিছুই করতে পারবে না। জাতি সবসময়েই পেছনে পড়ে থাকবে।
আল-কারযাভীর দৃষ্টিতে ইসলামপন্থা : ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক RAND Corporation air ‘Civil democratic Islam: partners resources and strategies ‘ রিপোর্ট সম্পর্কে টিভি টকশোতে পশ্চিমাদের রাজনৈতিক ইসলাম ও গণতান্ত্রিক ইসলাম ধারণার বিরোধিতা করে ইউসুফ আল কারযাভী বলেন , ইসলাম হচ্ছে একটি সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা । ইসলাম শূরা পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, পরমত সহিষ্ণুতা, নারী অধিকার , দারিদ্র্যের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সামাজিক ন্যায়বিচার এর উপর প্রতিষ্ঠিত এই জীবন ও রাষ্ট্র দর্শন ।
RAND corporation এর প্রতিবেদনে উল্লেখিত ইসলামী চারটি ধারা ঐতিহ্যবাদী/traditionalist , চরমপন্থী/extremist , ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী /secularist, আধুনিকতাবাদী/modernist , বিষয়ে তিনি বলেন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মার্কসবাদী জাতীয়তাবাদী এরা কোনোক্রমেই ইসলামপন্থী নয় , তারা মুসলিম হতে পারে কিন্তু মুসলিম ইসলামপন্থীদের মধ্যে ব্যাপক তফাৎ রয়েছে ।
গণতন্ত্রের ব্যাপারে দৃষ্টি ভঙ্গি : ডঃ ইউসুফ আল-কারযাভী তাঁর Priorities of the Islamic Movement in the coming phase’ গ্রন্থের ‘The Movement and the Political Freedom and Democracy’ শীর্ষক আলোচনায় গণতন্ত্র সম্পর্কে বলেন, “Democracy is not seen as a danger anymore only when the majority of people are Muslim according to the tenets of Islamic Awakening. Off course, such a people would not be expected to pass a legislation that contradicts Islam and its incontestable principles and conclusive rules.”
“যখন অধিকাংশ জনগণ ইসলামের সামগ্রিক পুনর্জাগরণে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠতে সক্ষম হবে তখন গণতন্ত্র সর্বোতভাবে ভীতিপ্রদ ব্যবস্থা নয়। নিঃসন্দেহে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, এ সমস্ত মানুষজন ইসলামের প্রশ্নাতীত এবং চূড়ান্ত নীতিমালার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কোন আইন পাশ করবে । “
পশ্চিমা সভ্যতা সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি : আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, অতীতে আমরা জাহেলী যুগের রীতিনীতি প্রচলিত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকতাম। আর এখন আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতি নিয়ে বিচলিত। বৈশ্বিক সংস্কৃতি তথা বিশ্বায়নের অজুহাতে পাশ্চাত্য তাদের সংস্কৃতি, মতাদর্শ ও দর্শন আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। শায়খ ইউসুফ মনে করেন, আধুনিক সভ্যতা প্রশ্নাতীতভাবেই পশ্চিমা, কিন্তু এটিই একমাত্র কাম্য কিংবা সম্ভাব্য আধুনিক সভ্যতা নয়।”
বিরুদ্ধবাদীদের কঠোর সমালোচনা : ইউসুফ আল কারযাভী কে পশ্চিমা বিশ্বে একজন সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। চরমপন্থী মুসলিমদের কাছেও তিনি ঘৃণিত। স্বৈরতান্ত্রিক অগণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনা এবং দেশে দেশে ইসলামী গণবিপ্লবের প্রতি নৈতিক সমর্থন , গণতন্ত্রকামী মানসিকতার কারণে বিপরীত মতাবলম্বীদের কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হন ডঃ ইউসুফ আল কারযাভী ।
২০০৪ সালে তেইশটি দেশের প্রায় আড়াই হাজার মুসলিম বুদ্ধিজীবী একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করে। সেখানে ‘সন্ত্রাসবাদী ধর্মতাত্ত্বিক’দেরকে বিচারের মুখোমুখী করার জন্যে তারা জাতিসংঘের নিকট আহ্বান জানায়। এই পিটিশনে ইউসুফ আল কারযাভীর নাম রয়েছে এবং তাকে ‘sheiks of death’-এর একজন হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
ক্ষমতাসীনদের আক্রোশ: স্বৈরতন্ত্র বিরোধী রাজনৈতিক ফতোয়া, রাজনৈতিক ফিকহে তার দূরদর্শী সম্মোহনী লেখনি, এবং ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক ও ঈমানী সম্পৃক্ততার কারণে ১৯৪৭ সালে কিং ফারুক সরকারের আমলে তিনি প্রথমবার রাজবন্দী হন। ১৯৬১ সালে মাতৃভূমি মিসর ত্যাগ করে কাতার গমনের আগ পর্যন্ত কুখ্যাত জামাল নাছের সরকার তাকে তিন বার কারাবন্দী করে। আরব বসন্তের যে উত্তাল ঢেউ মিসরে আছড়ে পড়ে সে বিপ্লবের প্রধান রূপকারদের একজন ড. কারযাভী। ২০১১ সালে গণবিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে তিনি মিসর ফিরে আসেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি তাহরির স্কয়ারে ২০ লাখ জনতার সমাবেশে জুমার ঐতিহাসিক খুতবা দেন কারযাভী। অতঃপর তার ইমামতিতে জুমার সালাত আদায় করা হয়। মিসর বিপ্লবের সফলতায় তাঁর এ বক্তব্যের অনেকখানি ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। সামরিক জান্তা আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসির সরকার ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে গণঅভ্যুত্থানে ভূমিকার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। অবশ্য পরে বিশ্বজনমতের চাপে ইন্টারপোল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থেকে তার নাম বাদ দেয় । ২০১৫ সালে মিশরের একটি আদালত সহিংস আন্দোলনের দায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে ।
মিশর তিউনিশিয়া সহ সারা বিশ্বের আধুনিক ইসলামী রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন গুলোর কাছে ডঃ ইউসুফ আল কারযাভী একটি অপরিহার্য পাঠ। আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে সুপরিচিত তুলনামূলক রাষ্ট্রদর্শনের অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন একজন গবেষক হিসেবে কিছু বিতর্ক সত্ত্বেও শায়খ ইউসুফ আল কারযাভী ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। সারা বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনকে তাত্ত্বিকভাবে পথ প্রদর্শনের মাধ্যমে ইউসুফ আল কারযাভী সাংগঠনিক রাজনীতির বাইরে থেকেও ইসলামে রাজনীতির একজন প্রভাবশালী পথপ্রদর্শক । একইভাবে ইসলামী অর্থনীতির আধুনিক ব্যাখ্যা উপস্থাপনে, সমসাময়িক নানা জটিল শরঈ জিজ্ঞাসার ইজতেহাদী সমাধান পারঙ্গমতায় ইউসুফ আল কারযাভী তুলনাহীন । বাংলাদেশ ইসলামপন্থী সাধারণ জনশক্তির মাঝে ইউসুফ আল কারযাভী এখনো ততটা অনুশীলিত নয় । অথচ সমকালীন বুদ্ধিবৃত্তিক , অর্থনৈতিক , সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও তথ্য প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ইসলামের পুনর্জাগরণ ঘটাতে ইউসুফ আল কারযাভীর রচনাবলীর ব্যাপক অধ্যায়ন অনস্বীকার্য।
স্বীকৃতি ও সম্মাননা:
হাফেজ ইউসুফ আবদুল্লাহ ১৪১১ হিজরীতে ইসলামী অর্থনীতিতে অবদান রাখায় ব্যাংক ফয়সল পুরষ্কার লাভ করেন। ১৪১৩ হিজরীতে ইসলামী শিক্ষায় অবদানের জন্য মুসলিম বিশ্বের নোবেল খ্যাত কিং ফয়সাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন । ১৯৯৭ সালে ব্রুনাই সরকার তাকে ‘হাসান বাকলি’ পুরষ্কারে ভূষিত করে।
এছাড়াও তার বৈচিত্র্যময় পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি নিম্মোক্ত পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হন । আন্তর্জাতিক সম্মাননা :
১, কিং ফয়সাল ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ।
২, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পদক, মালয়েশিয়া
৩, আন্তর্জাতিক পবিত্র কোরআন সম্মাননা পুরস্কার, দুবাই ।
৪, সুলতান হাসান আল বলকিয়াহ সম্মাননা, ব্রুনাই ।
৫, আল ওয়াইস পদক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ।
৬, জর্ডানের মেডেল অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স ।
মৌলিক গ্রন্থ তালিকা: তিনি সুপ্রসিদ্ধ একজন আরবি সাহিত্যিক ও বাগ্নী। তার রচিত মৌলিক গ্রন্থাবলির ভাষা আরবি হলেও ইংরেজি সহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে।
আরবি ভাষায় রচিত তাঁর কিছু মৌলিক গ্রন্থসমূহ :
– الحلال والحرام في الإسلام –
– مئة سؤال عن الحج والعمرة والأضحية –
– كتاب فتاوى معاصرة –
– تيسير الفقه للمسلم المعاصر –
– فقه الجهاد –
– من فقه الدولة في الإسلام –
– فقه الزكاة –
– فقه الطهارة –
– فقه الصيام –
– فقه الغناء والموسيقى –
– فقه اللهو والترويح –
– دراسة في فقه المقاصد –
– في فقه الأقليات الإسلامية –
– الفقه الإسلامي بين الأصالة والتجديد –
– الاجتهاد في الشريعة الإسلامية –
– المدخل لدراسة الشريعة الإسلامية –
– الفتوى بين الانضباط والتسيب –
– عوامل السعة والمرونة في الشريعة الإسلامية –
– الاجتهاد المعاصر بين الانضباط والانفراط –
– دية المرأة في الشريعة الإسلامية –
– موجبات تغير الفتوى –
– الفتاوى الشاذة –
– زراعة الأعضاء في ضوء الشريعة الإسلامية –
– مشكلة الفقر وكيف عالجها الإسلام –
– بيع المرابحة للآمر بالشراء –
– فوائد البنوك هي الربا الحرام –
– دور القيم والأخلاق في الاقتصاد الإسلامي –
دور الزكاة في علاج المشكلات الاقتصادية وشروط نجاحها
– لكي تنجح مؤسسة الزكاة في التطبيق المعاصر –
– القواعد الحاكمة لفقه المعاملات –
– مقاصد الشريعة المتعلقة بالمال –
– الصبر في القرآن –
– العقل والعلم في القرآن –
– كيف نتعامل مع القرآن العظيم –
– تفسير سورة الرعد –
– كيف نتعامل مع السنة النبوية –
– المدخل لدراسة السنة النبوية –
– المنتقى من الترغيب والترهيب –
– السنة مصدرا للمعرفة والحضارة –
– في رحاب السنة –
– نحو موسوعة للحديث الصحيح مشروع منهج مقترح
– وجود الله –
– حقيقة التوحيد
– الإيمان بالقدر
– الشفاعة في الآخرة بين النقل والعقل
– الحياة الربانية والعلم
– النية والإخلاص
– التوكل
– التوبة إلى الله
– الورع والزهد
– المراقبة والمحاسبة
বাংলায় অনূদিত গ্রন্থাদি:
১। আধুনিক যুগে ইসলাম; কৌশল ও কর্মসূচী
২। ইসলাম ও চরমপন্থা
৩। ইসলাম ও শিল্পকলা
৪। ইসলামী পুনর্জাগরণ সমস্যা ও সম্ভাবনা
৫। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থাঃ তত্ত্ব ও প্রয়োগ
৬। ইসলামে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা
৭। ইসলামে এবাদতের পরিধি
৮। ইসলামে দারিদ্র বিমোচন
৯। ইসলামে হালাল হারামের বিধান
১০। ইসলামের যাকাতের বিধান
১১। জেরুজালেম বিশ্ব মুসলিম সমস্যা
১২। সুন্নাহ্র সান্নিধ্যে
১৩.ঈমান ও সুখ
১৪.বুদ্ধিদীপ্ত জাগরণের প্রত্যাশায়
১৫.ইসলামের বিজয় অবশ্যম্ভাবী
তথ্যসূত্র: Wikipedia, Al Jazeera, The New York Times, www.qaradawi.net, www.islamonline.net
সংকলক : মোহাম্মদ জিয়াউল হক। রিলিজিয়াস কনসালট্যান্ট, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।