বেঁচে থাকার আকুতি মানুষের জীবনশক্তি বৃদ্ধি করে

প্রকাশিত: ৫:০১ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৪, ২০১৯

-সালাহুদ্দীন মাসউদ

অনেক সময় শরীরের দুর্বলতাকে দায়ী করে মানুষ জীবন থেকে হতাশ হয়ে যায়।হতাশ সেই ব্যক্তির মনোজগতে তার শারীরিক দুর্বলতার বিষয়টি ঘুরপাক খেতে থাকে এবং নিজের কাছে তার জীবনটা অভিশাপ হয়ে দেখা দিতে আরম্ভ করে। আবার কখনো এক শ্রেণির মানুষের কাছে তার অজ্ঞতা বড্ড ভারী বোঝা হয়ে দেখা দিতে থাকে। সে ভাবতে থাকে, আজ যদি আমি জ্ঞানার্জন করতাম তবে জীবনে অনেক কিছুই করে ফেলতাম।

আমার অজ্ঞতা আজ আমাকে পঙ্গু করে রেখেছে। আরেক শ্রেণির মানুষ তো সকাল বিকাল নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করতে থাকে। সে মনে করতে থাকে যে, আমার কপাল খারাপ বলেই আমার সম্পদ নেই, আমার চাকরি নেই, আমার সন্তান নেই; ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছু মানুষ এই ভেবে নিজেকে তুচ্ছা-তাচ্ছিল্য করতে থাকে যে, আজ যদি আমার বাবার অনেক সম্পদ থাকতো তবে আজ আমিও অনেক কিছু করে দেখাতাম।

কী আর করবো, গরীব ঘরে জন্ম হয়েছে আমার। সত্যিই কি উপরুক্ত বিষয়গুলোর বিবেচনায় মানুষ অসহায় হয়ে থাকে? শারীরিক দুর্বলতা, জ্ঞানের প্রতুলতা, ভাগ্য আর গরীব ঘরে জন্ম নেয়ার কারণেই কি মানুষের জীবনটা তার কাছে অভিশাপ হয়ে চেয়ে আসে? আমাদের সমাজের ব্যর্থ মানুষগুলোর কাছে গল্প শুনতে গেলে অনেকেই এই ধরনের গল্প দিয়ে নিজেদের অকর্মন্যতাকে ঢাকতে চেষ্টা করে থাকে।

প্রকৃতপক্ষে উপরোক্ত কোনো কারণ যে মানুষের জীবনোন্নয়নের পথে বাধা নয়, তা এই বৃদ্ধের ছবির মাধ্যমে ফুটে ওঠে। এই বৃদ্ধের শরীরে কি প্রচন্ড শক্তি বিদ্যমান? সে কি অনেক জ্ঞানের অধিকারী? তার বাবা কি প্রচুর সম্পদ রেখে গেছে? তাই বলে বৃদ্ধ কি বস্তির চিপায় শুয়ে শুয়ে বুভুক্ষ অবস্থায় দিনাতিপাত করছে? সে কি এক মুঠো খাবারের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে? না। বৃদ্ধকে তার বয়স কখনোই তাকে অকর্মন্য ভাবতে শেখায়নি।

বৃদ্ধ সত্তোরোর্ধ বয়সেও হালাল ব্যবসার মাধ্যমে নিজের এবং পরিবারের রোজগারের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয়ী। একজন পরিশ্রমী বৃদ্ধের ছবির মাধ্যমে এ কথাটিই স্পষ্ট হয় যে, মানুষের দৃঢ় প্রত্যয় তাকে দমিয়ে রাখতে পারে না। একজন দৃঢ়প্রত্যয়ী মানুষকে তার বয়স, তার আর্থিক দৈন্যতা, তার অসুস্থ্যতা, কোনো কিছুই যেনো থামিয়ে রাখতে সক্ষম হয় না। রাজধানীর বুকে প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় বৃদ্ধকে এভাবেই জীবনযুদ্ধে লিপ্ত দেখতে পেয়ে এগিয়ে যাই।

কথা বলার ফুরসত নেই তবু হাঁটতে হাঁটতে কথা হয় বৃদ্ধের সাথে।

: আসসালামু আলাইকুম

: ওয়সসালাম

: আজ কেমন কামাই হলো বাবা?

: আল্লাহর রহমতে দিন রাতের খাবারের ব্যবস্থা হয়েই যায় বাবা

: এই বয়সে কাজ করতে কষ্ট হয় না?

: কষ্ট না করলে খাবো কী বাবা?

তিনটা ছেলের কেউ দেখে না। যে যার মতো থাকে। আমার ঘরে আমার অসুস্থ্য স্ত্রীর জন্য ঔষধ কিনতে হয়। আমাদের দুইজনের জন্য খাবারের বন্দোবস্ত করতে হয়। এতো কিছু কার কাছে চাইবো বলেন বাবা? এজন্য নিজের হাতে একেক সময় একেক জিনিস ফেরি করে বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালাই।

: অনেকেই তো এই বয়সে ভিক্ষা করে বেড়ায়। তাতে তো ভালো আয়ও হয়। আপনি কষ্ট করে কাজ করছেন কেন? : কি বলো বাবা। ভিক্ষা করতে কষ্ট হয় না? ভিক্ষা করতেও তো মানুষের দ্বারে দ্বারে যেতে হয়। মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে হাত পেতে টাকা চাইতে হয়। আর আমি যে কাজ করি, সেই কাজ করতেও কষ্ট করতে হয়। তাই আমি দেখলাম যে, কষ্ট তো করতেই হয়। ভিক্ষা করলেও কষ্ট করতে হয়, কাজ করে খেলেও কষ্ট করতে হয়।

তবে আমি কেন মানুষের সামনে নিজেকে ছোট করবো? তাই আমি কষ্টের কাজটাই করে খাবার জোগার করি। বৃদ্ধের শেষের কথায় আমি থ মেরে যাই। কতো দামি কথা। বৃদ্ধের কী এক দৃঢ় প্রত্যয়। আমি ভাবতে ভাবতেই বৃদ্ধ চলে যায় অনেক দূরে।

আমার সঙ্গে কথা বলার ফুরসত কোথায়? পরিশ্রমের মাধ্যমে তার জীবিকা উপার্জন করতে হবে। দৃঢ়প্রত্যয়ী এই বৃদ্ধের ছবিতে ফুটে ওঠে একটি পরিশুদ্ধ ও পরিশ্রমী জীবনের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। মানুষ যখন জীবনে কিছু করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়, তখন তার সামনে ঐ কাজ এবং সফলতার চিন্তা ছাড়া অন্যকিছু বাধাগ্রস্ত হয়ে উঠতে পারে না।

মন্তব্য করুন