

কাদিয়ানী সম্প্রদায় বা আহমদীয়া জামায়াতের পরিচয়, তাদের ব্যাপারে ধর্মীয় অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা এখানে দিতে যাবো না। গোলাম আহমদ কাদিয়ানী প্রতিষ্ঠিত ইহুদী লবিষ্টদের এই দলটি মুসলমানদের ঈমান আকিদা নষ্টের কাজ করেছে বিভিন্ন ভাবে। এই উপমহাদেশের ওলামায়ে কেরামদের সকল অংশই কাদিয়ানীদের অমুসলিম মেনে আসছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন প্রতিথযশা আলেম আল্লামা আশরাফ আলী (রহ.) মৃত্যুবরণ করার কিছুদিন আগেও হাসপাতালের বেডে অসুস্থ অবস্থায়ও বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছিলেন কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করার জন্য। আল্লামা আশরাফ আলী রহ. এর সেই আবেদনের ভিডিও অনেককেই চমকে দিয়েছিলো এবং এদেশের ওলামায়ে কেরাম কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে কতটা সোচ্চার তার প্রমান তৈরি করেছিলো।
কাদিয়ানীদের পরিচয় সম্পর্কে বললে বলতে হয়, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নামের একজন ভ্রান্ত ব্যাক্তি ১৮৮৯ সালে আহমদিয়া মতবাদের এর প্রবর্তন করেন। তিনি ছিলেন পূর্ব পাঞ্জাবের অমৃতসর এলাকার কাদিয়ান গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর অনুসারীরা আহমদিয়া এবং কাদিয়ানী উভয় নামেই পরিচিত। এই ভ্রান্ত ফেরকাটি সর্বপ্রথম বাংলায় আসে ১৯১২ সালে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার মীর সৈয়দ আবদুল ওয়াহেদ নামের একজনের হাত ধরে। তাঁর হাতেই কয়েকশত লোক এ ভ্রান্ত ফেরকায় যোগ দেয়। ১৮৮৯ সালে মির্জা গোলাম আহমদ ঘোষণা করেন যে, তিনি একটি দৈববাণী বা ওহী পেয়েছেন, যাতে তাঁকে এ মতবাদে বিশ্বাসীদের আনুগত্য গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। পরবর্তীকালে তিনি নিজেকে ইমাম মেহেদি এবং ঈসা (আ.) বলেও ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীরা নুরউদ্দিনকে তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচিত করেন। নুরউদ্দিনের মৃত্যুর পর ১৯১৪ সালে সম্প্রদায়টি ভাগ হয়ে যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুসারীরা কাদিয়ানে থেকে যায় এবং তারা গোলাম আহমদকে নবী বলে মানে। ১৯৪৭ সাল থেকে এ শাখা ‘জামাত-ই-আহমদিয়া’ নামে পাকিস্তানের রাবওয়াহ থেকে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকে। অন্য শাখাটি গোলাম আহমদকে একজন সংস্কারক বলে স্বীকার করে এবং তারা লাহোরে ‘আহমদিয়া আঞ্জুমান ইশাত-ই-ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা বাংলাদেশেও তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ইসলামের মৌলিক অসংখ্য চিন্তা-ধারাকে তারা তাদের মত করে ভ্রান্তবাদের সাথে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে এবং মুসলমানদের ঈমান হরণের কাজটি করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতা অনেক বড়। এ দেশের ওলামায়ে কেরাম সব সময়ই কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশের প্রথম সারীর সকল রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ওলামায়ে কেরাম যেমন, হাফেজ্জী হুজুর রহ., শাসসুল হক ফরিদপুরী রহ., শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ., চরমোনাইর মরহুম পীর সাহেব সৈয়দ ফজলুল করীম রহ., মুফতী আমিনী রহ. এমনকি বর্তমান হেফাজতের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী সাহেব পর্যন্ত সকল ওলামায়ে কেরামই কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে সরব ভূমিকা পালন করে এসেছেন। কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিটি সকল ইসলামপন্থীদের প্রাণের দাবি। এমনকি ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের জাগরণী সেই গণবিস্ফোরণ ও ঐতিহাসিক ১৩ দফাতেও একটি দফা ছিলো কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করা নিয়ে। হেফাজতের ১৩ দফার ৬ নং দফাটি ছিলো কাদিয়ানীদের নিয়ে। সেখানে দাবি করা হয়েছিলো ; “সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতত্পরতা বন্ধ করা”।
একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তারা তাদের স্বাধীন কার্যক্রম পরিচালনা করুক কিন্তু ইসলামের নাম দিয়ে নয় এমনটাই সকলের দাবি। বাংলাদেশে কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় অনেক ঘটনাই ঘটেছে। মুখোমুখি সংঘর্ষও হয়েছে তাদের সাথে। সর্বশেষ গত বছরের (২০১৯ সালে) ফেব্রুয়ারী মাসে পঞ্চগড়ে কাদিয়ানীদের কথিত ইজতেমা বন্ধের দাবিতে সরব হয়েছিলেন ওলামায়ে কেরাম। যেখানে বেশ বাধা বিপত্তি ও প্রতিবাদের মুখে ইজতেমা বন্ধ করা হয়েছিলো। কিন্তু সেই কাদিয়ানী সম্প্রদায় তাদের কার্যক্রম বন্ধ করেনি বরং গতকাল (১৪ জানুয়ারী ২০২০ ইং) বি-বাড়িয়ার খতমে নবুওয়াত মাদরাসা নামের একটি মাদরাসায় কাদিয়ানীরা হামলা করে তাদের দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছে। এই হামলার বিপক্ষে ওলামায়ে কেরামদের কঠোর হওয়া এখন একান্ত প্রয়োজনীয়।
ওলামায়ে কেরামদের কাদিয়ানী বিরোধী এই অবস্থানে দেশের সকল ইসলামপন্থী দলগুলো থাকলেও জামায়াতে ইসলামী নামের দলটি এই আন্দোলনের সাথে নেই! অথচ তারাও নিজেদেরকে ইসলামী দল দাবি করে থাকে। এক্ষেত্রে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর আলেম ওলামাদের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে ধারণা করে সেই সময় দেশে কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিলেন ওলামায়ে কেরাম – যার সাথে চরমোনাইর মরহুম পীর সাহেব রহ. প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনসহ (বর্তমানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ) অনেকেই জড়িত ছিলেন প্রকাশ্যেই। এমনকি তখন মানিক মিয়া এভিনিউতে কাদিয়ানী বিরোধী মহাসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিলো। সেখানে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান বিশ্বাসের প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকার ঘোষনা ছিলো। কিন্তু পর্দার আড়ালে কোন একটি গোষ্ঠির অপতৎপরতায় শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট সেই কর্মসূচী বাতিল করেন। সেই ভাবেই কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলন স্থিমিত হয়ে যায়। অনেকেই এই আন্দোলন স্তিমিত করে ফেলার পেছনে জামায়াতকে দায়ী করেন।
কাদিয়ানী এবং জামায়াতে ইসলামীর কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাবলী আছে। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আবুল আলা মওদুদী একজন কাদিয়ানীবিরোধী লোক হলেও তার দল জামায়াতে ইসলামী উদার ইসলামের দোহাই দিয়ে কাদিয়ানী বিরোধী অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছে এবং যুগপৎ কোন কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলনে তাদের দলীয় অবস্থান নেই। অথচ ঐতিহাসিকভাবে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মওদুদী কাদিয়ানী বিরোধী ছিলেন এবং পাকিস্তানে তিনি কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলনেও শরিক ছিলেন। যে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান সরকার সংসদে আইন পাশ করে আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করে।
কিন্তু বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে কোন কঠোর অবস্থান প্রকাশ করেনি অজানা কোন কারণে এমনকি উইকিলিকসের এক তারবার্তা থেকে জানা যায়, ‘উইকিলিকসে প্রকাশিত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৪ সালে এক মার্কিন তারবার্তায় দেখা যায়; মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলার বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে গিয়ে তৎকালীন জামাতের সহযোগী সাধারণ সম্পাদক আ. রাজ্জাক আহমদিয়া সম্প্রদায় নিয়েও মন্তব্য করেন। রাজ্জাক বলেন, শিবির কখনো কখনো বাড়াবাড়ি করে থাকে। তবে তাদের সব ধরনের সহিংস কার্যকলাপ বন্ধ করতে বলা হয়েছে। রাজ্জাক ইঙ্গিত করেন যে, জামায়াতে ইসলামী শিবিরকে সংখ্যালঘু আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংস কর্মকাণ্ড বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছে। এছাড়া বিএনপি জামায়াতের আমলে আহমদিয়াদের বই নিষিদ্ধের কথাও তারবার্তা থেকে জানা যায়। তারবার্তায় আরো জানা যায়, ইসলামী ঐক্যজোটের প্রধান মুফতী আমিনীকে (রহ.) যখন জিজ্ঞেস করা হয়-আহমদিয়াদের মতন ছোট একটা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তাদের কেন বড় অভিযানে তারা মেনেছে। এর জবাবে আমিনী রহ. বলেন-ওরা অমুসলিম। আহমদিয়ারা প্রকৃত মুসলিমদের বিপথগামী করার চেষ্টা করে।
উইকিলিকসের এই তারবার্তা বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যায়, জামায়াতে ইসলামী কাদিয়ানীবিরোধী অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছে এমনকি এখন তা প্রকাশ্য বিষয়। গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে পঞ্চগড়ে কাদিয়ানীদের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষ ও কাদিয়ানীদের আস্ফালনের বিপক্ষে সকল ইসলামী দল ও ইসলামী ব্যাক্তিত্বরা প্রতিবাদমুখর হলেও জামায়াতকে টু-শব্দটিও করতে দেখা যায়নি। বিগত এক দেড় যুগেও জামায়াতকে পাওয়া যায়নি কোন কাদিয়ানীবিরোধী আন্দোলনে। তাদের দলীয় কোন এজেন্ডা বা ম্যানুফেস্টেও নেই কাদিয়ানীবিরোধী কোন অবস্থান। বরং কোনক্ষেত্রেই এই কাদিয়ানীবিরোধী আন্দোলনে তাদের কোন ভূমিকাই নেই যা খুবই রহস্যজনক বিষয়।