

শেখ মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম
আরএসএস রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, সংক্ষেপে ‘সংঘপরিবার’ বলা হয়। কট্টর হিন্দুত্ববাদ ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে মূলভিত্তি করে ১৯২৫ সালে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মূলত ১২ শতক থেকে ১৮ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন চলে এসেছে, তারাই ধারাবাহিকতায় নবচিন্তায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
এর প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষিত উদ্দেশ্য হচ্ছে, ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশিকতা ও মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করা। মূল শ্লোগান হল জন্মভূমির প্রতি নিঃস্বার্থ সেবা। এর বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৭০-৮০ লাখ। যে কেউ এর সদস্যপদ লাভ করতে পারে না। অনেক শর্ত পূরণের মধ্য দিয়ে মনোনিত ব্যক্তিই এর সদস্যপদ লাভ করতে পারে। আরএসএসের অধীনে অনেকগুলো সংগঠন আছে। এ সংখ্যা শতাধিক। এরা আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে কাজ করে। এদেরকে সামগ্রিকভাবে ‘সংঘপরিবার’ বলা হয়। কিষাণ সংঘ, মজদুর সংঘ, মহিলা সমিতি-এভাবে সমাজের প্রতিটি স্তরের আলাদা আলাদা সংগঠন আছে। দলিত, আধিবাসী, বনবাসীসহ ভারতের সকল ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের মাঝে কাজ করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছে। এমনকি যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের এত ক্ষোভ, সেই মুসলিমদের উন্নয়নে কাজ করার জন্যও ‘মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ’ নামে আলাদা সংগঠন গড়ে তোলে।
সংঘপরিবার সারা ভারতে জালের মতো বিস্তৃত সংগঠন গড়ে তুলেছে। ‘আরএসএস’ সমাজের বিভিন্ন স্তরে নানা সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এমনকি সবচেয়ে বড় এনজিও হিসেবে তারা ভারতে কাজ করে। তারা হাজার হাজার দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামীদামী কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আরএসএস কর্তৃক পরিচালিত সেবাসংস্থাগুলোতে কোটি কোটি ডলার অর্থায়ন করে। ইন্টেল ও মাইক্রোসফটের মত প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত তাদের অর্থায়ন করে। এগুলো হিন্দুত্ববাদ প্রসারে তারা ব্যয় করে। ‘
আরএসএস’-এর বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের জন্য আছে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান । ভারতীয় গবেষণা কেন্দ্র ভারতীয় ইতিহাস সংকলন যোজনা, দীনদয়াল রির্সাচ ইনস্টিটিউট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আরএসএস-এরর শিক্ষাকার্যক্রমও অনেক বিস্তৃত। সারা ভারতে প্রায় লক্ষাধিক স্কুল তারা প্রতিষ্ঠা করেছে। শুধু আদিবাসী এলাকাগুলোতে বিনা খরচে পড়াশোনার জন্য ২৭ হাজার স্কুল গড়ে তুলেছে। বর্তমানে দলিত, মুসলিম, ও ছিন্নমূল লক্ষাধিক শিশুকে নিজেদের তত্বাবধানে আশ্রমে রেখে লালন পালন করছে। এভাবে ভারতে মিডিয়া শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বাণিজ্যসহ সকল সেক্টরে অনেক কার্যকর সংগঠন ও ধর্ম প্রচারের জন্য ক্লাব গড়ে তুলেছে।
আরএসএসের কাজের ব্যাপকতা এর দ্বারা অনুধাবন করা যায় যে, প্রতিরক্ষা বাহিনীতে অধিক সংখ্যায় যোগ দিতে উৎসাহী করার লক্ষ্যে ‘সেন্ট্রাল হিন্দু মিলিটারি এডুকেশন সোসাইটি’ নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে।
আরএসএস সেবামূলক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হলেও এর রয়েছে নিয়মিত বেতনভূক্ত আধা সামরিক বাহিনী ও ধর্ম প্রচারের জন্য শক্তিশালী প্রচারক দল। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে কাজ করার জন্য আছে সুশৃঙ্খল ‘সাইবার বাহিনী। এই আধা সামরিক বাহিনী প্রধানত ত্রাণ, পুনর্বাসন ও সমাজ কল্যাণমূলক কাজ করলেও এর রাজনৈতিক দিকটি গুরুত্বপূর্ণ। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ভারত-চীন যুদ্ধে এ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী অনেক কৃতৃত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ‘সংঘপরিবার’ মূলত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিয়ে ভারতে নিজের অবস্থান তৈরি করে। প্রায় শতাব্দীকালের পথ পরিক্রমায় আরএসএস তিনবার নিষিদ্ধ হয়। প্রথমত ১৯৪৮ সালে আরএসএস সদস্য নাথুরাম বিনায়ক গডসে কর্তৃক গান্ধীজীকে হত্যা করার পর। দ্বিতীয়বার ইন্ধিরাগান্ধী কর্তৃক জারি করা জরুরী অবস্থার সময়। আর তৃতীয়বার ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর। কিন্তু প্রতিবারই তারা স্বরুপে বহালভাবে ফিরে এসেছে।
বিজেপি : বিজেপি (ভারতীয় জনতা পাটি) কে বলা হয় প্রাথমিক সদস্যের দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। এর সক্রিয় সদস্য ৮০ লাখের ওপর। এটা আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা। আরএসএসকে বিজেপির আতুঁড়ঘর বলা হয়। অর্থাৎ আরএসএস এর ঘরে বিজেপির জন্ম। এটি আরএসএস এর ছত্রছায়ায়, তার তৈরি করা জমিনে, তার সরবরাহ করা নেতৃত্বে তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তোলে। অর্থাৎ বিজেপির নেতৃত্ব সরবরাহ করে RSS । ২) বিজেপির রাজনৈতিক জমিন তৈরি করে RSS। ৩) বিজেপির তৃণমূল পর্যায়ে কর্মীদল সরবরাহ করে RSS। বাজপেয়ি, আদভানী, নরেন্দ্রমোদি, অমিতশাহ, রাজনাথ সিংহ সহ বিজেপির এসকল নেতা RSS এর তৈরি ও সরবরাহকৃত।
বিজেপি একটি কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সংগঠন। ১৯৮০ সালের ৬ এপ্রিল এর প্রতিষ্ঠা। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, রক্ষণশীলতা ও একাত্ম মানবতাবাদ এর মতাদর্শ। বিজেপি একটি ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন। এর ছাত্র, যুব, শ্রমিক, নারীসহ অনেকগুলো অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন রয়েছে। বিজেপি একই আদর্শের অন্যান্য সংগঠনের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয় রেখে চলে। তবে বিজেপিই প্রথম সংগঠন তা নয়, বরং এর উৎস ‘ভারতীয় জনসংঘ দল’। যা ১৯৫১ সালে ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের প্রাধান্যের বিরোধিতা করে প্রতিষ্ঠিত হয়। জনসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। জনসংঘের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল, ভারতের ‘হিন্দু সাংস্কৃতিক পরিচয়’ রক্ষা করা। জনসংঘ ‘আরএসএস’-এর ছত্রছায়ায় গড়ে উঠে এবং ১৯৫২ সালের লোকসভায় নির্বাচনে ৩টি আসন পায়। ১৯৭৫ সালে ভারতে জরুরী অবস্থা জারি হলে জনসংঘ ‘জনতাপার্টি’ নামে জোট গঠন করে। JP এর সাথে সম্পর্ক রাখা না রাখা নিয়ে মতবিরোধের জেরে জনসংঘের সদস্যরা মিলে জোট থেকে বেরিয়ে ১৯৮০ সালে বিজেপি গঠন করে। ৮৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি মাত্র ২টি আসন পায়। ১৯৯৬ সালে জোটগতভাবে সরকার গঠন করে। তবে তা ১৩ দিন স্থায়ী হয়। এরপর ১৯৯৮ সালে আবার সরকার গঠন করে। সর্বশেষ ২০১৪ সালে সাবেক আরএসএসের প্রচারক ও কর্মী নরেন্দ্র দামোদার দাস মোদীর নেতৃত্বে ভূমিধ্বস বিজয়ের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করে।
বিজেপির রাজনীতির বিকাশ : বিজেপি গোড়ার দিকে কংগ্রেসি রাজনীতির প্রাবল্যের মাঝে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদী সম্পর্ক মধ্যপন্থা অবলম্বন করে। তবে তাতে সুবিধা না হওয়ায় কট্টর হিন্দুত্ববাদী অবস্থানে ফিরে যায়। বিজেপির রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট ছিল রামমন্দির নির্মাণের দাবীতে ১৯৯০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া ‘রথযাত্রা’ কর্মসূচি। দলটির বিকাশে এবং জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে সর্বোপরি ভারতীয় সমাজে হিন্দুত্ববাদের প্রভাব সৃষ্টিতে এ রথযাত্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এলকে আদভানীর নেতৃত্বে শুরু হওয়া এ রথযাত্রার মূল উদ্দেশ্য ছিল, ভারতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মনে বিজেপির প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করা। প্রায় ১৩ হাজার কিলোমিটার ব্যাপী এ রথযাত্রার মূলদাবী ছিল অযোধ্যায় রাম মন্দিরের পক্ষে জনমত সংগঠিত করা। এর ফলে বিজেপির জনপ্রিয়তা হু হু করে বেড়ে যায়।
বিজেপির পথচলায় চ্যালেঞ্জ : হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় বিজেপির চলার পথ কখনোই মসৃণ ছিলো না। কারণ প্রথমত, ভারত বহুভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির লীলাভূমি। বহুত্ববাদ ভারতীয় সমাজের বৈশিষ্ট্য। ভারত ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ধারণ করে। ৪৭ সালে ভারত ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হলেও ভারত সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধারণ করে। এদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী কংগ্রেস ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এমন একটি বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষ দেশে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করা সত্যিই দুরূহ। দ্বিতীয়ত, যে হিন্দু ধর্মকে কেন্দ্র করে এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়, সে হিন্দু ধর্ম কিছু আচার-অনুষ্ঠানের নাম। এর কোন শক্তিশালী রাজনৈতিক আবেদন নেই। মানুষের জীবন সমস্যার সমাধানে এর সুস্পষ্ট ও কার্যকরী কোন দিক-নির্দেশনা নেই। বরং তা মানব সমাজকে জাত-পাতে বিভক্ত করে রাখে। এমন একটি দর্শনের ওপর দাঁড়িয়ে আধুনিক যুগে আদর্শবাদী রাজনীতি করা জটিলই বটে। কিন্তু সে মুশকিলকেই আসান করেছে বিজেপি।
আদর্শ প্রতিষ্ঠায় বিজেপির কৌশল:
১। সর্বব্যাপী আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটানো: কোন দেশে রাজনীতি কেবল রাজনৈতিক দলের মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয়না। বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে তার জমিন ও অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। শিক্ষা ও গণমাধ্যম সমাজের গভীরে সেই রাজনীতিকে স্থান করে দেয়। ভারতে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় বিজেপি এ পথেই অগ্রসর হয়। আরএসএস প্রতিষ্ঠার পর অর্থাৎ ১৯২৫-৮০ সন পর্যন্ত ভারতে হিন্দুত্ববাদ ছিল একটা প্রান্তিক মতাদর্শ। এ সময় রাজনৈতিকভাবে আশানুরূপ অগ্রগতি না হলেও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে তারা একটা অবস্থান তৈরি করে ফেলে এবং এর পক্ষে জোরালো বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলে। বিভিন্ন ধরণের ধর্মীয়, সামাজিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রমের মাধ্যমে আরএসএস ভারতীয় সমাজের গভীরে হিন্দুত্ববাদের পক্ষে প্রচন্ড ঢেউ তোলে। সেই ঢেউয়ের প্রকাশ ঘটেছে বিজেপির রাজনৈতিক বিজয়ের মধ্য দিয়ে। যেমন সমুদ্রের উপরিভাবে আমরা যে ঢেউ দেখতে পাই তার উৎপত্তি ঘটে সমুদ্রের নিচের অংশ। সংঘ-পরিবার মূলত হিন্দুত্ববাদকে মার্কেটিং করেছে এবং তার উত্থান ঘটিয়েছে। এই হিন্দুত্ববাদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বিজেপির উত্থান ঘটে। অর্থাৎ বিজেপি হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটিয়েছে তা নয়, বরং হিন্দুত্ববাদ বিজেপির উত্থান ঘটিয়েছে। তবে হ্যাঁ, বিজেপি হিন্দুত্ববাদকে রাজনৈতিক পন্থায় জোরালোভাবে তাকে তুলে ধরে এবং তা রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করে।
২। দলে ও নেতৃত্বে পেশাদারিত্ব আনা: হিন্দুত্ববাদের ব্যাপক প্রসারের জন্য সংঘপরিবার লাখ লাখ সার্বক্ষণিক প্রচারকদল গড়ে তোলে। যারা হিন্দুত্ববাদের জন্য উৎসর্গীকৃত। এরা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আদর্শ প্রচারে দেশময় চষে বেড়ায়। তাদের নেশা ও পেশা একটাই, তা হলো হিন্দুত্ববাদের প্রসার। এরা বিশেষত নিম্ন শ্রেণির মানুষকে টার্গেট করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আরএএসের এমনই একজন প্রচারক ছিলেন। এই প্রচারকেরাই বিজেপির জমিন প্রস্তুত করেছে। বিজেপি ধর্মভিত্তিক সংগঠন হলেও রাজনীতিতে এবং সংগঠন পরিচালনায় পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে। সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে দক্ষ সংগঠক গড়ে তুলেছে। অনেকটা কমিউনিষ্ট আদলে। এক্ষেত্রে বিজেপির ‘‘ত্রিপুরা মডেলকে’’ বিশ্লেষণ করতে পারি। ত্রিপুরায় সিকি শতাব্দী বাম শাসন ছিল। উপজাতিদের মাঝে সিপিএম শক্ত সাংগঠনিক ভিত তৈরি করেছে। সেখানে বিজেপির অবস্থা খুব নাজুক ছিল। ২০১৩ সালের নির্বাচনে তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিল মাত্র দেড় শতাংশ এবং একজন ছাড়া সব প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। সেই ত্রিপুরায় ১৫ সালে আরএসএসের প্রচারক সুনীল দেওধরকে বিজেপি ত্রিপুরায় প্রেরণ করলে তিনি প্রথমে উপজাতি ও সমতল জনগোষ্ঠির ভাষা আয়ত্ব করেন। এরপর রাজ্যে সিপিএমের স্টাইলে ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন গড়ে তোলেন। রাজ্যের সর্বত্র আরএসএসের ‘ফুলটাইমার’ প্রচারকদের প্ররণ করলেন। এমনকি রেল প্রচারকও নিয়োগ করলেন। যাদের কাজ ছিল রেলে থেকে থেকে দলের আদর্শ প্রচার করা। এভাবে সর্বত্র সংগঠনকে ছড়িয়ে দিলেন। ফলে ১৮ সালের নির্বাচনে বেজেপি বাম ও কংগ্রেসকে হটিয়ে সেখানে ভূমিধ্বস বিজয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছে।
৩। বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রম জোরদার এবং অনলাইনে শক্তিশালী প্রচারক দল গঠন: বিজেপির সাইবার টিম অত্যন্ত দক্ষ। এ টিমে প্রায় চার লক্ষাধিক সাংগঠনিক কর্মী রয়েছে। যারা স্যোশাল নেটওয়ার্কে কাজ করে। এরা ভারতের এবং ভারতের বাহিরে অবস্থানরত ভারতীয় নাগরিকদের নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসে। তারপর ভোটারদের মনস্তত্ব বিশ্লেষণ করে কর্ম-কৌশল তৈরি করে।
সামাজিক কাজে গুরুত্ব প্রদান বিজেপি মডেলের আলোকে কিছু প্রস্তাবনা :
বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যে কর্মপ্রচেষ্টা চলছে তাকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়া দরকার।
১. সমাজের গভীর থেকে ইসলামপন্থার উত্থান : বাংলাদেশের মানুষ গত হাজার বছর থেকে মুসলমান। ইসলামের সাথে এদেশের মাটি, মানুষ ও সংস্কৃতির সম্পর্ক অনেক গভীর। অতএব এদেশে সমাজের গভীর থেকে ইসলামপন্থার উত্থান ঘটাতে হবে। এর মাধ্যমে ইসলামের রাজনৈতিক বিজয়ের জমিন তৈরি হবে। এ লক্ষ্যে একদল ধর্মীয় দাঈ তৈরি করে সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া দরকার। যারা মানুষের ধর্মীয় চেতনাবোধ জাগ্রত করবে।
২. দলে ও নেতৃত্বে পেশাদারিত্ব আনা : রাজনৈতিক সফলতার জন্য ‘রাজনৈতিক আকাঙ্খা’ থাকা চাই। রাজনৈতিক আকাঙ্খা ও ভিশন না থাকলে সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি দলে ও নেতৃত্বে পেশাদারিত্ব আনা চাই। ‘পার্টটাইমার’ দিয়ে আর যাই হোক রাজনীতি হয় না। লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে একদল দক্ষ, নিবেদিতপ্রাণ ‘ফুলটাইমার’ সংগঠক তৈরি করতে হবে। আত্মতুষ্টি নয়, আত্মবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। অন্যের চেয়ে নয়, বরং আমরা লক্ষ্যের আলোকে আমি কতটুকু অগ্রসর হলাম, তার বিশ্লেষণ করা দরকার।
৩. উন্নত থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠা করা : সংগঠন যত এগিয়ে যাবে তার বুদ্ধিবৃত্তিক নির্দেশনা ততবেশি প্রয়োজন হবে। সেজন্য দলের বৃদ্ধিবৃত্তিক সাপোটের জন্য উন্নত থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। রাজনৈতিক দলের ‘থিংক ট্যাংক’ আধুনিককালে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়।
৪. দলকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা : শুধু দল নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। যেখান থেকে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে বহুমুখী সামগ্রিক কর্মতৎপরতা গ্রহণ করা হবে।
উপসংহার : ভারতের মতো বহুমাত্রিক জটিল সমাজে হিন্দু ধর্ম, যারা কোন রাজনৈতিক আবেদন নেই , তার ভিত্তিতে হিন্দুত্ববাদের মতো একটি প্রান্তিক মতাদর্শ যদি কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে যদি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের মতো এক ভাষা ও এক ধর্মের সমাজে এবং যেখানে গত হাজার বছর ধরে ইসলাম গণ মানুষের চিন্তা-চেতনা ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা কেন সম্ভব হবে না? ইসলামী বিপ্লবপ্রত্যাশী প্রতিটি মানুষের কাছে এ প্রশ্নটি রাখতে চাই।
লেখক : সংগঠক ও গবেষক ইসলামী রাজনীতি বিশ্লেষক