কথিত জঙ্গিবাদ ও আমাদের আলেমদের ভূমিকা

প্রকাশিত: ৩:৪২ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৯, ২০১৯

পলাশ রহমান

জঘন্যতম গুলশান হামলার বিচার হয়েছে। অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিক এই খবর পেছনে ফেলে সামনে উঠে এসেছে দুই অপরাধীর মাথায় আইএস টুপি। জনমনে জেগে উঠেছে হাজারো প্রশ্ন। অপরাধীদের মাথায় কোথা থেকে এলো ওই বিশেষ টুপি? সাধারণত এ ধরণের অপরাধীদের আদালতে আনা নেয়ার সময় মাথায় হেলমেট, গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরানো হয়, তাদের বেলায় হয়নি কেনো? তাদের হাতে হ্যান্ডকাপ থাকার কথা। একজনকে দেখা গেছে ক্রাচে ভর করে হাটছে, সে কী ভাবে মাথায় ওই টুপি পরলো বা কে তাদের মাথায় পরিয়ে দিলো? আদালত চত্ত্বরে অপরাধীদের এত কাছে কেনো সাধারণ জনগণকে যেতে দেয়া হলো? আদালত পাড়া তো সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, কোনো ক্যামেরায় কী ধরা পড়লো না কে তাদের মাথায় ওই টুপি পরিয়েছে? এমন হাজারও প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু উত্তর নেই। উত্তর দেয়ার মতো দায়িত্ববান কেউ নেই। সবাই দায় এড়াতে ব্যস্ত। অথচ সরকার এতদিন বড় গলায় বলে এসেছে ওরা আইএসের কেউ না। ওরা দেশি জঙ্গি।

অপরাধীদের মাথার আইএস টুপির বিষয়ে আমাদের মিডিয়াও কান্ডজ্ঞানহীন ভূমিকা রেখেছে। সব খবর যে ফলাও করে প্রচার করতে হয় না সে শিক্ষা তারা কাজে লাগায়নি।

যমুনা টিভি আল্লামা আজিজুল হক (রহ) কে জঙ্গি নেতা বানিয়েছে। তারা দেখিয়েছে, সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম আজিজুল হক কথিক জঙ্গি দল হুজির প্রতিষ্ঠতা ছিলেন। অথচ আজিজুল হকের ছেলের নেতৃত্বে খেলাফত মজলিশ জাতীয় পার্টির সাথে নির্বাচনী ঐক্য করেছে। এই দলের সাথে আওয়ামীলীগও একবার নির্বাচনী চুক্তি করেছিল। (যদিও প্রতিবাদের মুখে তারা পরে ক্ষমা চেয়েছে)

রসাত্মক ব্যাপার হলো যমুনা টিভির মালিক জাতীয় পার্টির একজন প্রভাবশালী নেত্রী। সরকারী দলের অন্যতম সহযোগী। প্রশ্ন হলো জঙ্গিবাদ কী খুব খারাপ কিছু বা জঙ্গিবাদ বলে কী সত্যিই কোনো মতবাদ আছে? নাকী শুধুমাত্র ইসলামপন্থীদেরই জঙ্গি বলে বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করা হয়? যারা ডানতন্ত্র বা বামতন্ত্রের জন্য লড়াই করে, যুদ্ধ করে তাদের কেনো জঙ্গি বলা হয় না?

আসল বিষয় হলো যারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে মূলত ইসলামি আদর্শের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে তারাই ইসলামপন্থী যোদ্ধাদের বা রাজনীতিকদের বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করতে জঙ্গি শব্দের আবিরভাব ঘটিয়েছে। তারা এমন ভাবে এই শব্দটা উপস্থাপন করেছে যে মানুষ ভাবেতে শুরু করেছে জঙ্গিবাদ নামে হয়তো আলাদা কোনো মতবাদ আছে বা জঙ্গিরা হলো পৃথিবীর সব থেকে খারাপ মানুষ। তাদের এই প্রচারের পক্ষে সহায়ক হয়েছে আইএস এর মতো কিছু চরমপন্থী সংগঠনের কর্মকান্ড, যারা সত্যিকারার্থে ইসলামের আদর্শে আছে কীনা সেটাই এখন মোটা দাগের প্রশ্ন।

এসব প্রশ্নে সঠিক উত্তর যারা দিতে পারবেন তারা হলেন আলেম সমাজ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমাদের দেশের আলেমদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো কাজ নেই। তারা এই বিষয়গুলো খোলাসা করে বলেন না। আমাদের জনসাধারণের বড় অংশ জানে না ইসলামি আদর্শের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শর্ত কী? ইসলামি আদর্শের রাষ্ট্রে অর্থনীতি কি হবে? পররাষ্ট্রনীতি কি হবে? বিচার বিভাগ কি ভাবে চলবে? সংসদ কি ভাবে চলবে? কি ভাবে নেতা বা নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে? খেলাফত রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা কি হবে? নারী অধিকার কেমন হবে? নাটক সিমেনা চলবে কিনা, দেখা যাবে কিনা? মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে কিনা? থাকলে তার মাপকাঠি কি? নারীরা শিক্ষা গ্রহণের, ঘরের বাইরে কাজ করার অধিকার পাবে কিনা? খেলাফত রাষ্ট্রে অন্য ধর্মের মানুষ বসবাস করতে পাবে কিনা? তাদের সাথে কি আচারণ করা হবে? তারা তাদের ধর্ম পালনের অধিকার পাবে কিনা? ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ থাকবে কিনা? কলমের স্বাধীনতা থাকবে কিনা? ব্যবসা বাণিজ্য কেমন হবে?

এসব বিষয়ে আমাদের আলেমরা ওয়াজ নসিহত করেন না। পরিস্কার ধারনা দিতে পারেন না। দুই একজন বলার চেষ্টা করলেও গোজামিল দিয়ে কথা বলেন। গণমানুষের কাছে তারা বিষয়টি সহজ করে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে গণমানুষ প্রচলিত আদর্শের সাথে ইসলামি আদর্শের তুলনা করার সুযোগ পায় না। পক্ষান্তরে ইসলামি আদর্শ বিরোধীরা, বিশেষ করে গোটা দুনিয়ার শাসক শ্রেণী এবং মিডিয়াগুলো ফেলাফত বা ইসলামি শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে এতটাই সোচ্চার যে মানুষ এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে খেলাফত বা ইসলামের আদর্শ সত্যিই একটা জঘন্য, মানবতা বিরোধী মতবাদ।

আমাদের দেশের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোয়ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ হয় না। শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং শ্রমিকদের মধ্যে তাদের উল্লেখ করার মতো কোনো কাজ নেই। ফলে কথিত জঙ্গিদের দারা মানুষ বিভ্রান্ত হয়। যুবকের রক্তে প্রবাহিত বারুদ ভিন্ন পথে বিস্ফোরিত হয়। ইসকনের মতো কুৎসিত সংগঠন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যাবস্থা দখল করে নেয়ার সুযোগ পায়। ইসলাম বিরোধীরা খেলাফতের মডেল হিসাবে মানুষের সামনে তুলে ধারে আইএস এবং তাদের অধ্যুষিত অঞ্চল বা দেশগুলোকে।

এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হলো আইএস সম্পর্কে আমরা পরিস্কার কিছু জানি না। এদের কার্যক্রম এবং উদ্দেশ্য লক্ষ অনেকটা রহস্যঘেরা। এদের সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের প্রধান সূত্র হলো পাশ্চত্য মিডিয়া। অন্য বিষয়ে যা’ই হোক, অন্তত এ বিষয়ে আদর্শিক কারনেই চিন্তাশীল মানুষরা পাশ্চত্য মিডিয়ার উপর আস্থা রাখতে পারে না। তবে যতোটুকু যা জানা যায় তা একদম গ্রহণযোগ্য নয়। খেলাফতের জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। উধাহরণ হিসাবে গুলশান হামলার কথা বলা যেতে পারে- ওই হামলার ভালো দিক কি ছিল? কি অর্জন হয়েছিল? যাদের হত্যা করা হয়েছে, যে ভাবে হত্যা করা হয়েছে এ বেপারে ইসলাম কি বলে? ইসলাম কী এমন জঘন্য হত্যাকান্ড অনুমোদন করে?

এইসব বিষয়ে আমাদের আলেমদের খোলাখুলি কথা বলা দরকার। কিন্তু তারা প্রচন্ড রকম আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগেন। সেল্ফ কনফিডেন্সের বড়ই অভাব তাদের মধ্যে। আমাদের আলেমরা কি একবারও ভেবেছেন জঙ্গিবাদ বলে আদৌ কোনো বাদ বা মতোবাদ আছে কিনা? তারা কি তলিয়ে দেখেছেন কথিত জঙ্গিবাদের বিরোধীতার নামে ইসলামি আদর্শের বিরোধীতা করা হচ্ছে কীনা? যেমন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যারা নিষেদ্ধের কথা বলেন তাদের মূল উদ্দেশ্য ইসলামি আদর্শের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা যা এতদিনে পরিস্কার হয়ে গেছে।

বুদ্ধিবৃত্তিক এসব কাজ না করে আমাদের আলেমরা নিজেদের মধ্যে বাদানুবাদে জড়াচ্ছেন। পরস্পরের গায়ে কাঁদা ছিটাচ্ছেন। ওয়াজের বাজারে সিন্ডিকেট তৈরী করছেন। প্রকাশ্যে বলছেন ঐক্য চাই। গোপনে বলছেন, অমুক থাকলে আমি থাকবো না। কেউ কেউ টাকার অংক নিয়ে দেনদরবার করছেন। বিশেষ করে বর্ষিয়ান আলেমরা এমন পর্যায়ে নেমে কথা বলছেন যা কোনো ভাবেই তাদের জন্য সম্মানজনক নয়। বর্ষিয়ানদের কথায় নতুন প্রজন্মের আলেমদের মধ্যে স্থায়ী ভাবে বিরোধের বীজ রোপিত হচ্ছে। যা ভয়াবহ বার্তা বহন করে।

আমাদের আলেমদের আত্মসম্মানবোধ এতটাই নিচে নেমে গেছে যে কোনো এক ‘বদের হাড্ডি’ যদি বিপদে পড়ে বা মুখ ফসকে বলে ফেলে- ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম ছাড়া মানব জাতীর মুক্তি নেই, এতেই তারা গদগদ হয়ে যান। ওই ব্যক্তির অতীত বর্তমানের আমলনামা বিবেচনা না করে ‘হযরত ওমরের’ সাথে তুলনা করতেও দ্বিধা করেন না। অথচ নিজেদের মধ্যে পান থেকে চুন খসলেই আর রক্ষে নেই। ঝাপিয়ে পড়েন সোশ্যাল মিডিয়ায়। পরস্পরের কাপড় ধরে টানাটানি করেন। ষড়যন্ত্রমূলক ফোনাফুনি করেন। যা শুধু মূর্খতাই নয়, চরম হতাশাজনক।

আমাদের আলেম ওলামাদের উচিৎ নিজেদের মধ্যে বাদানুবাদ না করে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে মনোযোগ দেয়া। তাদের বোঝা উচিৎ আল্লাহ সবাইকে সমান যোগ্যতা দিয়ে দুনিয়াতে পাঠাননি। সুতরাং নিজ নিজ জায়গা থেকে সঠিক কাজটা করা উচিৎ। কে ছোট আলেম, কে বড় আলেম এসব অবান্তর প্রশ্ন না তুলে যোগ্যতা বিবেচনা করা উচিত। যোগ্যতা অনুসারে জায়গা ছেড়ে দেয়া উচিত। যে ভালো বক্ততৃতা করে তাকে বক্তব্যের মাঠে ছেড়ে দেয়া উচিত। যে ভালো পড়ান তাকে শিক্ষকের চেয়ারে বসানো উচিত।

আপনারাই তো বলেন, আল্লাহ কাকে দিয়ে কখন কী খেদমত নেবেন তা আল্লাহ’ই ভালো জানেন। যদি এ কথা আপনারা বিশ্বাস করে বলে থাকেন তবে কেনো এতো বাদানুবাদ? এত ষড়যন্ত্র? এত ফোনাফুনি?

এসব রেখে সঠিক কাজে মনোযোগ দিন। ইসলামের সঠিক নির্দেশনা সহজ করে মানুষের কাছে তুলে ধরুণ। কথিত জঙ্গিবাদের নামে ইসলাম বিরোধীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। ইসলামি আদর্শের রাষ্ট্র ব্যাবস্থা কেমন হবে তা সহজ করে মানুষের কাছে তুলে ধরুণ। নয়তো আপনাদের শিক্ষক, সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম আজিজুল হকের মতো আপনাদেরও একদিন কথিত জঙ্গিনেতা বানানো হবে। পরের প্রজন্ম জানবে আপনারা ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী মানুষ ছিলেন।

লেখক : কলামিস্ট, বিশ্লেষক, সমালোচক, ইতালী প্রবাসী সাংবাদিক।

মন্তব্য করুন