কাউকে আপনজনের মৃত্যুর সংবাদ জানানোর চেয়ে পৃথিবীতে কঠিন কোনো কাজ নেই

প্রকাশিত: ৫:২৮ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২১, ২০১৯

কাউকে আপন স্বজন বা নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর সংবাদ জানানোরচে কঠিন কোনো কাজ আছে বলে মনে হয় না।

ছোট বোন অসুস্থ কয়েকদিন ধরে। স্বামী, শশুর-শাশুড়িসহ নর্দ্দায় থাকে। আমিও নিজে অসুস্থতার কারণে দেখতে যেতে পারছিলাম না। লাস্ট দু’তিন ধরে কথা হয়নি। কল করবো করে করে করা হয়নি। কালকে রাতেও কল করবো-করছি করে রাত বেশি হয়ে যাওয়ায় আর কথা হয়নি। সকালে ঘুমে ছিলাম। ওর কল পেয়ে ঘুম ভাঙে। কল কেটে দেই এই ভেবে যে, পরে কথা বলবো। কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তা করলাম এখনই কথা বলে গত দু’দিনের প্রায়শ্চিত্ব করি। কল ব্যক করলাম। যথারীতি কল রিসিভ করে আমাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ একেবারে বন্ধ করে দিয়ে বললো আব্বা মারা গেছে।

আব্বা মারা গেছে তুই বললেই বিশ্বাস করমু নাকি! চট করে এমন ভাবনা জমাট বাঁধে মস্তিস্কে। নিজেকে সংবরণ করে জিজ্ঞেস করি কোন আব্বা? ও বলল, আমার শশুর মারা গেছে সকালে। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইলাম অফিসের সোফায়। সকাল বেলা যেখানে ঘুমিয়েছিলাম।

জীবন মরণের আসা যাওয়ার মিছিলে আমিও চলে যেতে পারি যেকোনো দিন। হয়তো পরিবারের অন্য সব সিনিয়র সদস্যদের আগেই; কিংবা পরেও। অথবা মানুষের বাহ্যিক হিসেবে স্বাভাবিকতার অস্বাভাবিক দোলাচলে চলে যেতে পারেন বাবা-মা, ভাই, বোন কিংবা আমার পরিবারেরই অন্য কেউ। হয়তো সেদিন অন্য কারো ফোনকলে কেঁপে উঠবে অন্তরাত্মা। মানুষ বলে থাকে, পৃথিবীতে সব থেকে কঠিন কাজ হলো বাবা হয়ে সন্তানের লাশ কাঁধে বহন করা। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এরচে কঠিন কাজ হলো- ‘বাবা হয়ে সন্তানের কিংবা সন্তান হয়ে বাবার বা মায়ের মৃত্যুর সংবাদ অন্য কাউকে জানানো’। এর কারণ হলো, কারো মৃত্যুর পর লাশ বহন করার জন্য নিজেকে তৈরি করতে প্রত্যেকেই নূন্যতম কিছু সময় পায়; কিন্তু মৃত্যুর সাথে সাথে সংবাদটি নিকটজনদের কাছে পৌঁছানোর জন্য নূন্যতম সময় কেউই পায় না। এই কাজটা তৎক্ষণাৎ করতে হয়।

কোনো পরিবারের একজন সদস্যের মৃত্যু হলে ওই পরিবারের অনেক হিসেব নিকেশ পাল্টে যায়। আর গত হওয়া মানুষটি যদি হন পরিবারের স্বর্বমান্যজন বাবা! তাহলে গোটা পরিবারের চেহারাটাই আমুল বদলে যায়।

আমি আমার কাছের কিংবা দেশের বিশিষ্টজন অনেকের মৃত্যুর আগে প্রায় সময় স্বপ্ন দেখি। (প্রায়ই এরকম দেখেছি)। এমন ইঙ্গিতবাহী কোনো স্বপ্ন দেখলে ওইদিন (দিন হোক অথবা রাত হোক) ঘুম থেকে উঠে কিংবা ঘুমের মধ্যে কারো ফোনকল পেলে ঘাবড়ে উঠি। আজকে তেমনটি হয়নি।

মাত্র সপ্তাহ তিনেক আগে বাড়ি যাওয়ার সময় ওদের বাসায় গিয়েও মানুষটির সাথে দেখা হয়নি। ছোট বোন বাড়ি যাবে আমার সঙ্গে; সেজন্য আনতে গিয়েছিলাম। রাতযাপন করে সকালে যখন বের হবো তখন শুনি ও যেতে পারবে না। মন খারাপ করে, অনেকটা রাগ করে সকালে আর কারো সাথে দেখা না করে ওদের বাসা থেকে সেদিন চলে আসি। সেদিন যদি দেখা হতো তাহলে সেটাই হয়তো দুজনের শেষ দেখা হতো। সেদিন সেটা না হলেও আজকে শেষ দেখা হয়েছে তবে এই দেখাটা শুধু আমার একার।

কিছু মানুষের সাথে তার দেখা হয়েছিলো আজ সকালেও। মসজিদে ফজরের নামাজ জামাতের সাথে পড়ে তাসবীহ তাহলীল করছিলেন। ওই সময় শরীর ঘর্মাক্ত হলে ততক্ষণ মসজিদে থাকা মুসুল্লি কিংবা ইমাম সাহেবকে ফ্যান ছাড়তে বলতে বলতে এও বলছিলেন, আমার ভালো লাগছে না। আমি চলে যাবো, আমার সময় শেষ হয়ে গেছে। একটা নিরব শান্তির লক্ষণ। মসজিদে বসে ইবাদাতরত অবস্থায় পূণ্যময়ী মৃত্যু। যেন মালিকের সাক্ষাতের অপেক্ষায় তার বাংলোতে বসেছিলেন আর মালিকের ডাক পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দিদারে প্রবেশ করলেন। আশা করি ওপারে ভালো থাকবেন।

এমন মৃত্যু প্রভু আমাকে দিও, মসজিদের সাথে দিল লেগে থাকা আমার বাবাকে দিও, অন্যান্য স্বজনদের দিও।

আমাদের পরিবারের বলা চলে আমরা দুজন থাকি ঢাকায়। ছোট বোন থাকে ওর সংসারসূত্রে আর আমি! জীবনের তাগিদে। এছাড়াও অন্যান্য স্বজনরা থাকেন। হয়তো কোনোদিন হঠাৎ কোনো ফোনকল পেয়ে পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া এভাবেই বাড়ির পানে ছুটতে হবে এখন যেমন ছুটছি…..

শাহনূর শাহীন: যুগ্ম সম্পাদক পাবলিক ভয়েস
(লেখকের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে)

আই.এ/

মন্তব্য করুন