অবৈধ পথে ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া গমন

প্রকাশিত: ২:১৭ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৯, ২০১৯
ছবি: গোলাম রাব্বি


জাহেদ আহমদ  অ্যাথেন্স , গ্রীস থেকে


কোন ভুমিকা লিখছিনা। শুধু একটি কথা বলি। বাঁচার জন্য মানুষ প্রবাসের স্বপ্ন দেখে, কিন্ত যদি সেই প্রবাস যেতে মরে যাওয়াটা নিশ্চিত হয়? নিশ্চিত মৃত্যু জেনে কেও যাবে? যাবেনা। দালালের খপ্পরে পড়ে অধিকাংশরাই পাড়ি ধরে।


ইউরোপ অবৈধভাবে তিনটি পথে ইউরোপ ঢুকে মানুষ। লিবিয়া, মরক্কো, তুরস্কো।

লিবিয়া

লিবিয়া থেকে প্লাস্টিকের বোটে করে ভূমধ্য সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি। যা অত্যান্ত বিপদজনক।বোটে কম্পেশার দিয়ে ছাড়া হয়। যেখানে বাতাস শেষ সেখানেই আপনার গন্তব্য।কখনো সাগরে ঢেউ থাকা অথবা বোটের কম্পেশার শেষ হওয়ায় শতসহস্র মানুষ সাগরের অতল গহীনে মারা যায়। ইতালি যখন লিবিয়ান স্মরনার্থী গ্রহন করে তখন বাংলাদেশি কিছু মানুষ ইতালি গিয়েছিল। সে সময় সাগরে ভেসে আসা লাশও কম দেখেনি বিশ্ব।বাংলাদেশিও কম মরেনি। Libya to Italy লিখে ইউটুউবে সার্চ দিলেই সেই সব করুন দৃশ্য দেখতে পারবেন। এখন আর কোন দেশ স্মরনার্থী গ্রহন করছেনা। সুতরাং এই পথে যেন কেও পা না বাড়ায়।


মরক্কো

মরোক্কো থেকে ভূমধ্য সাগর পাড়ি দিয়ে স্পেন।স্পিটবোর্ড দিয়ে মরক্কো থেকে স্পেনে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায় অনেক দালাল। অথচ স্পেন সীমান্তে তাদের সীমান্তরক্ষীর কড়া টহল থাকে। অবৈধভাবে ঢুকার চেস্টা করলে সীমান্তরক্ষী গুলি করে। মরক্কো রয়েছে মাফিয়াদের ভয়ঙ্কর চক্র। দালালের খপ্পরে পড়ে কেও যদি মরক্কো আসে, বাস্তবতা দেখে যখন সা গরপথে না যাবার কথা বলে,দালাল তখন তাকে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে ফেলে। মাফিয়ার পিঠা খেয়ে বাড়ি থেকে টাকা এনে যখন মুক্তি পায় আবার কোন না কোন মাফিয়া ধরে নিয়ে যায়। এভাবে মানুষের জীবন নিয়ে চলে জাহেলী যোগের পৈশাচিক খেলা।


তুরস্ক

তুরস্ক। থেকে সাদাখাল নামক নদী ও ভয়ঙ্কর জঙ্গল ও পাহার পর্বত পাড়ি দিয়ে গ্রীস। এপথে দালাল আপনাকে বলবে ২/৩ ঘন্টা হাটা লাগবে। কিন্ত ১৫/১৮ ঘন্টা হাটতেই হয়। হাটা নয়, দৌড়তে হয়।কখনো ৫/৭ দিন জঙ্গলে থাকতে হয়। গ্রীস ঢুকতে কপাল লাকী হলে ২/১ বারে গ্রীসে ঢুকা যায়। অন্যথায় ১০/১১ বারও লাগতে পারে।কারন, কখনো গ্রীসের পুলিশ কখনো তুর্কির পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। জঙ্গলে পাহাড়ে নদীতে পানি শূন্যতা, বরফে আটকে পড়া, গরমে স্ট্রোক করা সহ মরে যাওয়ার নানাবিধ কারন রয়েছে। গ্রীসের বর্ডারে অনুপ্রবেশ রোধ করার জন্য ১৮’র নভেম্বর থেকে ফ্রান্স জার্মানি ও গ্রীসের যৌথ সীমান্তরক্ষী নিয়োগ করেছে ইউরোপিয় ইউনিয়ন।


এই দুর্গমপথে কি বিনা পয়সায় আসা যায়? মোটেও না।দালাল আপনাকে ৫/৭ লাখ টাকায় ইউরোপে পৌছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখাবে। কিন্ত ঠিকই আপনার ১৩/১৪ লাখ টাকা গুনতে হবে। ধরে নিন দালাল আপনার সাথে চুক্তি করবে এক লাখ টাকা। কিন্ত আপনাকে জিম্মি করে তিন লাখ টাকা নেওয়াটা অসম্ভব নয়। অহরহ এমনই হয়ে থাকে।


কিভাবে? আপনাকে আটকিয়ে পিটিয়ে আইএস স্টাইলে বিডিও করে আপনার বাড়িতে বিডিও দিবে। তখন? বাড়িতে ওরা ভিটা বিক্রি করে হলেও আপনাকে মুক্তি করাতে চাইবে। মুক্তিপণ আসার আগ পর্যন্ত নির্মম সেই যাতনা সহ্য করে যেতে হবে। পিটা খেয়ে মরে গেলে কোন সমস্যা নেই। নিরাপদে যে কোন জঙ্গলে ফেলে আসলেই হলো। উন্নত এই দেশগুলোতে পাহাড় আর জঙ্গলের অভাব নেই।বাংলাদেশের মত এত ঘনবসতিও নয় যে জঙ্গলে লাশ নিয়ে যেতে কেও দেখে ফেলবে।


এখন আসি তুরস্কে কিভাবে অবৈধপথে মানুষ আসে। দুবাই এবং ওমান থেকে সাগরপথে স্পিটবোর্ডে ইরান।স্পিটবোর্ডের গতি প্রতি মিনিটে সাড়ে তিন কিলোমিটার। যত শক্তিধর পয়লোয়ান হোক বমিতো করবে করবে, মুখ দিয়ে পেটের নাড়িবুড়ি বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। কেও কেও মারা যায়। সাগেরই ফেলে দেওয়া হয়। সাগরে দুবাই ওমান ও ইরানের সীমান্তরক্ষীর টহল থাকে সর্বক্ষণ। ওদের চোখে ফাঁকি দেওয়াও সহজ কথা নয়। ধরলে খবর আছে। কখনো হেলিকপ্টার দিয়েও ধরে নিয়ে যায়।
ইরান ঢুকতে পারলে ইরান থেকে তুরস্ক। ইরাক থেকেও তুরস্ক ঢুকা যায়। ইরান হোক বা ইরাক হোক দালাল আপনাকে বলবে দেড় দুই ঘন্টা হাটা লাগবে।কিন্ত ১২/১৫ ঘন্টার কম তুরস্কের গ্রানও পাবেন না। আবার কখনো দিনের পর দিন। এমন কি পাঁচ সাত দিনও হাটা লাগতে পারে। আর শুধু হাটা নয়। দৌড়তে হয় সর্বক্ষণ। ইরান ইরাক তুরস্ক সীমান্তে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম উঁচু পাহাড়সমূহ রয়েছে। হিমালয়ের পরে ইরানের পর্বতগুলোর স্থান।৩/৪ হাজার ফুট উচ্চতা সাধারন ব্যাপার।ইরান বা ইরাক থেকে তুরস্ক ঢুকতে এমন কত পাহার বেঁয়ে উঠা লাগে সে হিশাব না-ই দিলাম। উঠা নামা। উঠা নাম।দিনের পর দিন। রাতের পর রাত। খাদ্যশূণ্যতা পানিশূন্যতা ও স্ট্রোক করে অনেকে মারা যায়।
আমার এলাকার (সিলেট সদর পুরান কালারুকা গ্রামের) একভাই দেড় বছর হয়ে গেলো এখনো কোন হদিস নেই। শেষ বার শুধু বলেছিল সে ইরান আছে, তুরস্কো যাবে।


আরেকটি কথা বলে রাখি, এই পথের পথপ্রদর্শককে বলা হয় ডঙ্কার। দালালের ভাড়াটে চাকর। ডঙ্কার পাকিস্তানি, ইরানি, কুর্দি হয়ে থাকে। মানুষ খুন তাদের কাছে পান্তা ভাত। ডঙ্কারের কাছে ধারালো ছুরি থাকে। এই ভয়ঙ্কর পথে কেও যদি ক্লান্ত হয়ে নুয়ে পড়ে। পায়ের নলায় আঘাত করে মাঠিতে ফেলে দেয়। এর পর বুকের বাম পাশে ছুরি ঢুকিয়ে আপনাকে খতম করে দিবে। কালিমা পড়ার সুযোগ পাবেন না।প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার শক্তি থাকেনা। সাথের কেও প্রতিবাদ করেনা। চাচা যার যার জান বাঁচা।
মানুষ মারার কারন হলো ৫০/১০০ জন মানুষ নিয়ে একজন ডঙ্কার ছুটে। একজন পিছনে পড়লে পুরো গ্রুপ ধরা খেতে পারে। তুরস্কে না ঢুকাইলেতো আর টাকা পাবেনা। একজনকে খতম করাই তার জন্য নিরাপদ। যত আগে পৌছবে সেটি ডঙ্কারের জন্য প্লাস পয়েন্ট।


ইরানের অন্য সীমান্ত থেকে তুরস্ক সীমান্তে অথবা ইস্তাম্বুল শহর থেকে গ্রীস সীমান্তে তথা পাহাড়ের পাদদেশ নিয়ে আসা হয় ছোট্ট কার দিয়ে। খুব আরামে? মোটেই নয়। ছোট্ট কারে করে ১০/১২ জন মানুষ নিয়ে আসে। কারের পিছনের বক্সে ৪/৫ জন মানুষ ঢুকিয়ে লক করে ফেলে। মরলে ওখানেই মরো।
তুরস্কে আসতে পারলে সেখান থেকে গ্রীস। গ্রীসেও এমন হয়। ডঙ্কার মানুষ খুন করে। যত তাড়াতাড়ি পৌছবে ডঙ্কারের লাভ। একজনের কারনে পুরো গ্রুপ পাকড়াও হতে পারে। কেও এমনিতেই মারা যায়। কখনো টান্ডায়। কখনো বরফের পাহাড়ে আটকে। জঙ্গলে পাহাড়ে মরদেহ পঁচে গলে যায়।চিল কাকও হয়ত খোঁজে পাবেনা। দেও দানবও ঐসব রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করেনা এমন ভয়ঙ্কর রাস্তা।


এই ডিসেম্বরে হবিগঞ্জে বানিয়াচংয়ের একভাই গ্রীস ঢুকতে বরফে আটকে মারা গেলো। এরকম শত শত উদহারন দেওয়া যাবে। তবুও বাঙালিরা ঝুঁকি নিবে! এমন ঝুঁকি থেকে নিজে বাঁচুন, অন্যকে বাঁচান।
আমেরিকা। কলম্বিয়ার পানামা ‘ড্যারিয়ান গ্যাপ’ জঙ্গল হয়ে মেক্সিকোর হাজার হাজার মাইল মরুভূমির উত্তপ্ত রোদে বা বরফগলা টান্ডায় পায়ে হেটে পাড়ি দিতে পারলে আমরিকা।সহজ ব্যাপার না? দালাল বলবে ২/৪ দিন লাগবে। কিন্ত ২৫/৩০ দিন লাগাটা স্বাবাভিক। কয়জন বাঁচে!সেপথেও ডঙ্কার সাথে থাকে। ডঙ্কার অনেককেই খুন করে। অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে এমনিতেই। নিচের লিংকগুলো দেখে নিবেন, প্রমান পেয়ে যাবেন।


অস্ট্রেলিয়া

মালয়েশিয়া বা ইন্দোনিশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার গুঞ্জনও আছে। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্য মালয়েশিয়া থেকে বিমানে বা নৌযানে ইন্দোনিশিয়ায় নিয়ে যায় দালাল। ইন্দোনিশিয়ায় রয়েছে ৫ হাজার দ্বীপ। অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে নৌযানে করে যে কোন এক দ্বীপে নিয়ে যায় দালাল। সেখানে গিয়ে বলে তোমাদের স্বপ্নের দেশ অস্ট্রেলিয়া চলে এসেছো! টাকা পেমেন্ট করাও। টাকা পেয়ে দালাল উদাও হয়। ওদের ভাগ্যে যা হবার হয়। ভাগ্য ভালো থাকলে ইন্দোনিশিয়ায় ৬/৮ মাস জেলে খেটে দেশে আসেন কেও কেও। না হয় জেলেই পঁচতে হয় বছরের পর বছর।


আবার কোন কোন দালাল সাহস করে সাগর হয়ে নৌযানে করে অস্ট্রেলিয়ার পথ ধরে। একটু একটু বলে বলে ১২/১৫ দিন সময় যায় সাগরেই! খাদ্য পানি সবই শেষ হয়ে যায় যাত্রীদের। শীতের মৌসুম হলে টান্ডায় মরে যায় অনেকে। সাগরেই ওদের মরদেহ ফেলে দেয়া হয়। গরমের মৌসুমে এই দুর্গম পথে যখন খানি পানি শেষ হয়, শরীরের ঘামই হয় তাদের খাবার! পেটের যন্ত্রনায় কেও কাপড় ছিড়েও খায়।
ভাগ্যক্রমে যদি কেও এই ভয়ঙ্কর পথ অতিক্রম করে অস্ট্রেলিয়ায় পৌছে যায় তাহলে সেখানকার সীমান্তরক্ষীর গ্রেপ্তারি কোন ক্রমেই এড়ানো সম্ভব নয়। গ্রেপ্তারির পর ফিরিয়ে দিবে ইন্দোনিশিয়া বা মালয়েশিয়ায়। অথবা জেলে খেটে বাড়ি থেকে টিকেটের টাকা নিয়ে ফেরত আসতে হবে। কোন অবস্তাতেই অস্ট্রেলিয়ার মুক্ত আকাশের বাতাস গ্রহন করতে পারবেন না।


এত কষ্ট! এত ভয়ঙ্কর! কিন্ত যারা ভাগ্যক্রমে অবৈধ পথে ইউরোপে আসলো তারা কেনো এই সব বলছেনা?কারন দুইটা। ১-কেও লজ্জায় বলেনা। বাঙালিরা স্বচক্ষে না দেখলে কোন কিছু বিশ্বাস করে?২-যদি এইসব ভয়ঙ্কর যন্ত্রনার কথা শুনায় তাহলে আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব বলবে সে ইউরোপে গিয়ে বড় হচ্ছে। আমরা বড় হয়ে যাবো বলে কাহীনি শুনাচ্ছে।


প্রিয় বন্ধুগন! কোন দালালের খপ্পরে পড়ে এই মরনপথে পাড়ি দিবেন না। কোন মায়ের বোক খালি করোনা। দেশে মাটি কেটে খাও।তবুও বাঁচো। মা বাবা ভাই বোন আত্মীয় স্বজনদের জন্য এটাই সুখ। এই পথে যারা এসেছে পথে পথে লাশ বা কঙ্কাল দেখেনি এমন লোক কম হবে।কোন অবস্তাতেই যেন কারো ভাই বান্ধব আত্মীয় স্বজন বা কোন প্রতিবেশি এপথে পাড়ি না দেয়।


ইউরোপ আমরিকা হোক আর যেকোন দেশই হোক। ভোর ৫ টা থেকে সন্ধা ৬/৭ টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। আট দশ বার ঘন্টা।এই শ্রম দেশে দিলে দেশে থেকেই সমৃদ্ধ হওয়া যাবে। আমরা দেশে কাজ করিনা, কিন্ত বিদেশে ঠিকই কাজ করি।বিদেশে হাত শুকাইলে ভাত নেই।

মন্তব্য করুন