

ইকবাল হাসান জাহিদ
প্রথমে কৈফিয়ত দিতে চাই!
আমি কোনো রাজনৈতিক কর্মী বা নেতা নই, কোনোদিন ছিলাম না, এখনও নই। আমি কারও প্রভাবে খুব তাড়াতাড়ি প্রভাবিত হই না। তবে রাসুল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদের জীবনীতে প্রভাবিত হই। সূতরাং আমি কারও পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলি না, শুধু সত্যটা তুলে ধরার চেষ্টা করি।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস বাংলাদেশে মোটামুটি একটি প্রভাববিস্তারকারী রাজনৈতিক সংগঠন। বিভিন্ন সময়ে মূল স্রোতের সাথে রাজনৈতিকভাবে চিন্তাগত ভিন্নতা দেখা দিলেও বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরাম এই দলটিকে সব সময়ই হক্কানী ওলামায়ে কেরামের সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে আসছেন।
কিন্তু শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর ইন্তেকালের পরে প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা হাবিবুর রহমান যখন আমীরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন থেকে একটি বলয়ে ভেতরে ভেভরে আনুগত্যের সামান্যতম হলেও ঘাটতি দেখা দিতে শুরু করে। সমন্বয়হীনতা, আনুগত্যহীনতা এবং চেইন অব কমান্ড ভঙ্গের দায়ে এক সময় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ঢাকা মহানগর কমিটিকে বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুগ্ম মহাসচিব এমনই তথ্য জানিয়েছেন।
মাওলানা মামুনুল হক তখন মহানগরীর আমীর ছিলেন। মামুনুল হক দলীয় নিষ্ক্রীয়তা কাটিয়ে উঠতে তখন গঠন করেন ‘খেলাফত যুব মজলিস’ নামে একটি সংগঠন। কিছুদিনের মধ্যে গঠন করেন ‘খেলাফত ছাত্র মজলিস’। চলতে থাকে তাদের বিপ্লবী কার্যক্রম।
কিছু দিন পর দলের বৃহত্তর স্বার্থে মামুনুল হকের সঙ্গে সকল প্রকার দূরত্ব কাটিয়ে ওঠে দলটি। কাছে ভেড়ানো হয় কালের তুখোড় এই বক্তাকে। কিন্তু খেলাফত যুব মজলিস নামে তাঁর প্রতিষ্ঠা করা দলটির বিলুপ্তি করতে নারাজ তিনি। ধরে বসলেন জেদ। এই দল বিলুপ্ত করা যাবে না। শেষমেষ দলটিকে দেওয়া হয় স্বীকৃতি। তখন স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিসকে। তখন তিনি খেলাফত ছাত্র মজলিসকে ‘যুব মজলিস খ’ নামে পরিচালনা করেন।
ইতোমধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। গাঁও-গ্রাম থেকে শুরু করে মসজিদ মক্তবে চলতে থাকে তার তাফসীর ও ইসলামী বিপ্লবের জাগরণী বক্তব্য। তিনি এক সময় হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরামের অতি পরিচিতজন এবং মাঠের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
এরই ধারাবাহিকতায় গত কয়েক মাস আগে তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেই খেলাফত ছাত্র মজলিসকে মাঠে নিয়ে আসেন। ঘোষণা দেন এই নামেই এখন থেকে ছাত্ররা বিপ্লবী কাজ চালাবে। এখান থেকে তৈরী হবে দেশের বিপ্লবী নেতাকর্মী। তাঁর এই আজগুবি সিদ্ধান্ত ও একরোখা নীতিতে বিপাকে পড়ে খেলাফত মজলিসের হাই কমান্ড। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিসের নেতাকর্মীরা।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর, যুগ্ম মহাসচিব ও একাধিক নির্বাহী সদস্যের কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলে একান্ত আলাপে তারা হতাশা ব্যক্ত করেন। তারা বলেন আমরা কিছুই বলতে পারছি না। তিনি অনেক প্রভাবশালী নেতা। তাঁর বিরুদ্ধে কথা বললে আমাদের দল ভেঙে যেতে পারে।
দল বড় নাকি নেতা বড়? তাদের কাছে এমন প্রশ্ন করলে তাঁরা বলেন এই মুহুর্তে তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলার কারও সাহস নেই। তিনি একরোখা লোক। বেশি কথা বললে যে কোনো সময় দল ভেঙে যেতে পারে। তাঁর বড়ভাই মাওলানা মাহফুজুল হকও কথা বলতে নারাজ তাঁর ব্যাপারে।
-
এখন আমরা জানতে চেষ্ট করবো শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস কী? এবং তাঁরই সন্তান মাওলানা মামুনুল হকের প্রতিষ্ঠিত খেলাফত ছাত্র মজলিসের উদ্দেশ্য কী? এবং দুইটার মাঝে ফারাক কী?
আগে আমরা একটু জেনে নিই বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস কত সালে প্রতিষ্ঠা পায় এবং তার লক্ষ্য কী? উদ্দেশ্যই বা কী ছিলো? এবং তাদের নীতি ও কর্মপন্থায় কি বিপ্লব একেবারেই অসম্ভব?
ছাত্র মজলিসের পরিচয়:
আল্লাহর এই জমিনে সকল প্রকার জুলুম, নির্যাতন এবং জাহেলিয়াতের মূলোচ্ছেদ ঘটিয়ে আল কোরআন ও আল হাদীসের আলোকে জীবনের সার্বিক পুনর্বিন্যাস সাধনের মাধ্যমে একটি সার্থক ইসলামী সমাজ গড়ে তোলা এবং পরকালীন নাজাতের মহান উদ্দেশ্যেই ১৯৯০ সালের ৫ জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস।
ইসলামী ছাত্র মজলিসের প্রতিষ্ঠা জাতির প্রত্যাশারই বাস্তব প্রতিফলন। মানবতার সত্যিকার কল্যাণ ও মুক্তির পথ নির্দেশের জন্যে যে দায়িত্ব মুসলিম মিল্লাতের ওপর অর্পিত হয়েছে, বর্তমান অবস্থার দাবী অনুযায়ী ইসলামী ছাত্র মজলিস সে কর্তব্য পালনের জন্যেই এগিয়ে এসেছে। আম্বিয়ায়ে কেরাম পৃথিবীর মানুষকে যে সত্যের পথে আহ্বান জানিয়েছিলেন, ইসলামী ছাত্র মজলিস সেই একই দাওয়াত নিয়ে ছাত্র সমাজের মাঝে কাজ করছে। ছাত্র মজলিসের সংবিধানে এ সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অত্যন্ত স্পষ্ট করে বলা হয়েছে।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
এ সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে ব্যক্তি জীবনের পরিশুদ্ধি, সমাজ ব্যবস্থার সার্বিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ইহকালীন কল্যাণ লাভ এবং এই প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে আল্লাহর সন্তোষ ও পরকালীন মুক্তি অর্জন।
মৌল কর্মনীতি
সার্বিক বিষয়ে আল-কোরআন, রাসূল সা.-এর সুন্নাহ এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ অনুসরণ।
কর্মসূচী
এক. ছাত্র সমাজের কাছে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরা, তাদের মধ্যে ইসলামী জ্ঞানার্জনে উৎসাহ সৃষ্টি এবং ইসলামের বিধি-বিধান অনুসরণের দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করা।
দুই. যে সব ছাত্র ইসলামী আন্দোলনে অংশ নিতে আগ্রহী তাদেরকে এই সংগঠনে অন্তর্ভূক্ত করা।
তিন. এই সংগঠনের অন্তর্ভূক্ত ছাত্রদেরকে ইসলামী জ্ঞান প্রদান, সে অনুযায়ী চরিত্র গঠন এবং মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ সাধনের মাধ্যমে তাদেরকে ইসলামী সমাজ বিপ্লবের যোগ্য কর্মী হিসেবে গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ।
চার. ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন, ছাত্র সমাজের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা পালন এবং শোষণ, জুলুম, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় থেকে মানবতার মুক্তির জন্য ইসলামী বিপ্লবের লক্ষ্যে জনমত গঠন ও আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো।
মোটকথা, ইসলামী ছাত্র মজলিস চায় বাংলাদেশের এই জমিনে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। একটি পরিপূর্ণ সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমে সকল তাগুতী, খোদাদ্রোহী এবং জাহেলী শক্তিকে উৎখাত করে আল্লাহর খেলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই এর সমস্ত প্রয়াস এবং সাধনা। ইসলামী ছাত্র মজলিস তাই প্রচলিত অর্থে তথাকথিত কোন ছাত্র সংগঠনের নাম নয়। বরং এটি একটি দ্বীনি কাফেলা, একটি দীনি আন্দোলন। ছাত্র মজলিস মনে করে অনৈক্য ও বিভ্রান্তি-ই এদেশে ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান অন্তরায়। ছাত্র মজলিস বিশ্বাস করে আল্লাহর দীনের প্রতি আনুগত্য, বিশ্বস্ততা এবং জাহেলিয়াতের প্রভাবমুক্ত সকল মহলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি ব্যাপকভিত্তিক গণআন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমেই এ জমিনে দীন কায়েমের আন্দোলন সফল হতে পারে।
এখন কথা হলো শ্রদ্ধেয় মাওলানা মামুনুল হক প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস তাঁরই পিতা শায়খুল হাদীসের চেতনায় প্রতিষ্ঠিত ছাত্র মজলিসের চিন্তার সঙ্গে দ্বিমত কোথায়? যদি দ্বিমত না থাকে তাহলে আলাদা ছাত্র সংগঠনের প্রয়োজন কী ছিল? কী দরকার ছিল ভাঙনের সূত্র তৈরী করা?
আর যদি তার বাবার চেতনায় উজ্জীবিত ছাত্র সংগঠনের চিন্তার সঙ্গে দ্বিমত থাকে, তাহলে সে দ্বিমতটাও স্পষ্ট করা উচিৎ। যদি দ্বিমত থেকেই থাকে, তাহলে আমরা বলতে পারি মাওলানা মামুনুল হক তার বাবার বিপ্লবী চেতনায় বিশ্বাসী নয়! আমরা আশা করব, শ্রদ্ধেয় মাওলানা মামুনুল হক এই ব্যপারে জাতিকে একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য দেবেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপর্ণ একটি ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মতৎপরাতার চলমান প্রক্রিয়া যাতে বেঘাত না ঘটে তারই একটি জবাবদিহীমূলক বক্তব্য রাখবেন।