
এম. শামসুদদোহা তালুকদার
মানুষ তার কর্ম ও জীবনাচরণের জন্য সুবিখ্যাত বা ধিকৃত হয়। দূর্দিন এলে বিগত সুখ্যাতি বা কুখ্যাতির কাহিনী ভেসে উঠে। এভাবেই চলে আসছে।
শাপলা চত্বরের নারকীয় হত্যাকান্ড এমনি একটা স্মৃতি, এটা ভুলবে না দেশের আলেম সমাজ। যদিও ইলেকশনের সময় এটা কোন ইস্যুর মধ্যে পড়ে নাই। কারো দূর্দিন ছিলো না হয়তো বা, অথবা ইয়াদ ছিলো না। নির্বাচনের আগে ভিক্টিমদের নেতারা কাত হয়ে গেছে গা!
শাপলা চত্বর আবার মনে পড়েছে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুর সংবাদ জেনে। শাপলা ট্রাজেডির নেপথ্যে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রকাশ্যে। হেফাজতগো বিকাল ৫ টার পূর্বে শাপলা চত্বর থেকে খেদানোর কথা বলেছিলেন তিনি। মাঝরাতে বিভিন্ন বাহিনী যে দেড় লক্ষেরও বেশী বুলেট খরচ করেছে সেটার জন্য যাদেরকে দায়ী করা হয় তন্মধ্যে তিনি একজন। অথচ তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন না। হেফাজত নিয়ে তার কিছু মন্তব্য ছিল অত্যন্ত নির্দয়।
হেফাজতের মঞ্চ থেকেও তাঁর উদ্দেশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছিল। তিনি অনেকদিন ধরে ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। নির্বাচনের পূর্বে তাঁর আর্মি অফিসার (অবঃ) ভাই সৈয়দ শাফায়াতুল ইসলাম বলেছিলেন, জীবণ নিয়ে হয়তো ফেরা হবে না তাঁর। পরিবারের সদস্যরা তাঁর বাঁচা-মরা নিয়ে আল্লাহ-বিল্লাহ করছিলেন। তাঁর প্রার্থীতা নিয়ে নয়।
তিনি এতই অসুস্থ ছিলেন যে, তাঁর দ্বারা মনোনয়নপত্রে সাইন দেয়া সম্ভব ছিলো না। ব্যাংকক থেকে টিপসই করে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাও আইনগত ফর্মালিটিজ ছাড়াই। তবুও নির্বাচন কমিশনের নেক নজরের কারণে তিনি বাদ পড়েননি। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ করা হয়েছিল, তার মনোনয়ন টিকে যাবার পর।
মাশাআল্লাহ! তিনি নির্বাচনে জিতেও গেলেন, কিন্তু মরণের কাছে আজীবনের জন্য হেরে গেলেন। তিনি এতই জনপ্রিয় রাজনীতিক, নির্বাচনে দাঁড়ানোর পূর্ব থেকে বহুদিন হাসপাতালে থাকলেও জেতার নিশ্চয়তা ছিল শতভাগ!
আরেকজন নেতা এইচ এম এরশাদ সিংগাপুরের হাসপাতালে ছিলেন। নির্বাচনের কয়েকদিন পূর্বে দেশেও এলেন, কিন্তু নিজ আসনের দিকে পা মাড়াননি একবারও। তবুও তিনি জিতলেন।
তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। নিজ দলের প্রার্থীদের পক্ষে একবারো ভোট চাইতে বের হননি, তবুও ২৯ আসনে প্রার্থী দিয়ে তাঁর দল থেকে ২২ আসনে জিতলো। মহাজোটের এতই চোট যে, জোটের প্রার্থীদের ক্যাম্পেইনও করা লাগে না।
বিদেশের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্রার্থীদ্বয়ের এতই কারিশমা, অন্যান্য বিজয়ী প্রার্থীদের সমহারে ভোট পেতে কোন অসুবিধা হয়নি। তবে জেলখানায় থাকলে জেতার কোন সম্ভাবণা নাই। জেলখানায় থাকারা কেউই জিততে পারেন নাই। প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও আসেননি।
এটা এমন একটি ইলেকশন, যার ফলাফলের প্রশংসা করতে গেলে পত্রিকাওয়ালারা “ভূমিধ্বস বিজয়” শব্দ ব্যবহার করে। সেটা তারা লিখে, যখন কোন দল বা জোট অপ্রত্যাশিত ফলাফল করে, যেমন টু থার্ড মেজরিটি। অর্থাৎ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আরো অর্থাৎ- সংবিধানের আইন পরিবর্তন, পরিবর্তন ও সংযোজন করার একক ক্ষমতা।
এ বারের বিজয়কে কি বলবেন? ভূমিধ্বস বললে কম হবে। কারণ এমন বিজয় তো বিশ্ব দেখে না যুগে যুগে। রেয়ার কেইস।
এ নির্বাচনকে আপনারা ভূমিধ্বস না, “আসমান ভাংগা বিজয়” বলতে পারেন। জনগন নয়, ফেরেশতারা ভোট দিয়ে গেছে। সাধারণ জনগন বলবে, ফেরেশতা না ছাই! শেষ রাইত্তের বেলা ভোট দিয়ে গেছে ইবলিসের ছানাপোনা শয়তানেরা সীল মেরে ব্যালট বাক্স ভরেছে।
অনেকে এ নির্বাচন কে ৭১ আর ৭৩ এর এর সাথে তুলনা করেন। বাকোয়াস। কিসের সাথে কি? ঐ দুটো নির্বাচন ছিল স্বাধীনতার ঢংকা যখন বেজেছে। স্বাধীনতার পূর্বাপরে। এখন দেশে এ রকম ঢংকা বাজলো কই?
পূর্ব পাকিস্তানে শোষণ, নির্যাতন আর অবহেলার কারণে দেশটার স্বাধীনতা অপরিহার্য ছিল। কিন্তু সে ধরনের শাসন বহাল থাকলেও হালের শাসকগোষ্ঠী ই তো জিতলো! কেমনে কি?
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একজন সৎ মানুষ ছিলেন। তাঁর নামে দূর্নীতির কথা শোনা যায়নি। মন্ত্রীত্বকালীন ঘুম থেকে দেরীতে উঠার একটা অভিযোগ ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের দূর্দিনে বিশেষ করে ওয়ান ইলেভেনের সময় দলকে আগলে রেখেছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
তাঁর বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন। পঁচাত্তরের জেলখানায় নির্মমভাবে নিহত চার জাতীয় নেতার একজন। আওয়ামী লীগ একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হারালো। যদিও আওয়ামী লীগের আসমান ভাঙ্গা বিজয়ে তাঁর প্রত্যক্ষ অবদান নেই। তিনি তখন কোমায় ছিলেন। সুস্থ থাকলেও হয়তো মোবাইলে বাউলা গান শুনেছেন।
তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনে ফেসবুক ওয়ার্ল্ডে মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলছে। তিনি একবার বলেছিলেন, তিনি হিন্দুও নন মুসলিমও নন। আসলে তিনি হতভাগ্য। গত ২৩ শেষ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে তাঁর বৃটিশ ভারতীয় শিক্ষিকা স্ত্রী শীলা ঠাকুর লন্ডনে একই কর্কট রোগ ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন। এ দম্পতির একমাত্র কন্যা রীমা ঠাকুর লন্ডনের এইচএসবিসি ব্যাংকে চাকুরী করছেন।
সরকারের মন্ত্রীত্ব ও দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ। সরকারী স্টাফরাই তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন। তিনি জীবনের শেষ প্রহরে ব্যক্তিগতভাবে সুখী ছিলেন না, বলা যায়। অপার্থিব জীবনে কতটা সুখী থাকবেন তা মহান আল্লাহ ভালো জানেন।
তবে ধর্মীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে হিন্দু নন মুসলিমও নন, এমন সব মানুষের জন্য জান্নাত জাহান্নামের বাইরে কোন “নো ম্যান্স ল্যান্ড” বরাদ্দ হবে কিনা তাও মহান আল্লাহ জানেন এবং তিনি তাঁর জন্য একটা কায়দা করে দিবেন।
বান্দা কাফের হলেও আল্লাহ চাইলে মাফ করে দিতে পারেন। বান্দারা তাঁর গোলাম মাত্র।
লেখকঃ কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।