

…………………………………..
মোহাম্মাদ এনামুল হক এনা
…………………………………..
শিশু ধর্ষণের মহামারীতে আমি ক্রুদ্ধ, বিষন্ন, আতংকিত, এবং লজ্জিত। কিন্তু যে কোন মহামারী শুধু আক্রান্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিগ্রস্থ করে না, আশেপাশের সকলকে কমবেশী প্রভাবিত করে। আজ না হোক কাল, কিংবা অন্য আরেকদিন। এই মহামারী থেকে অবুঝ নিষ্পাপ ফুলের মতো শিশুদের জন্য কিছু না করতে পারার অপরাধবোধ এবং একধরণের অসহায়ত্ব থেকে এই লেখাটি লিখছি। সুস্থ, স্বাভাবিকভাবে পৃথিবীতে থাকার ভান আর করতে পারছি না।
শুধু বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তিপর্যায়ে এবং অবৈধ বানিজ্যিক ক্ষেত্রেই কি শিশু ধর্ষণ হচ্ছে? সামাজিক অনুমোদনে বৈধ প্রক্রিয়ায় কি শিশু ধর্ষণ হচ্ছে না?
ব্যক্তিগত পর্যায়ে পরিবার, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক এবং প্রতিবেশীদের দ্বারা শিশু-ধর্ষণ সংঘটিত হয়। শিশু ধর্ষণ হলো শিশু নিপীড়নের অন্তর্ভুক্ত। বয়সে বড় এবং অধিকতর শক্তিশালী আরেক শিশু, অভিভাবক, নিকটাত্মীয়, দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিভাবক, বা কতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক যেমন স্কুল শিক্ষক, ধর্ম গুরু, থেরাপিস্ট প্রৃভৃতি সম্পর্কের দ্বারা ধর্ষিত হতে পারে। এই ধর্ষণের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় সম্ভব নয়। ‘একুইনটেন্স রেপ’ পরিবারের বাইরে কিন্তু পরিচিত কারোর মাধ্যমে ঘটে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই ড্রাগ ব্যবহারের মাধ্যমে এই ধরণের ধর্ষণের ঘটনা ঘটানো হয়। স্কুল, কলেজের কিশোর, তরুনীরা এই ধরণের ধর্ষণের শিকার হওয়ার অন্যতম একটি দল।
গ্যাং রেপ বা দলগত ধর্ষণে দুই বা ততোধিক পুরুষ একজনকে ধর্ষণ করে থাকে। এগুলি হলো ব্যক্তি পর্যায়ে অননুমোদিত ধর্ষণ। কাস্টোডিয়াল রেইপ বা তত্ত্বাবধায়ক-ধর্ষণ কোন কতৃত্বমূলক সম্পর্কের অধীনে হয়ে থাকে। শিশু ধর্ষণের ক্ষেত্রে এটি সর্বাধিক হয় শিক্ষক, এবং ধর্মীয় গুরুদের মাধ্যমে। ধর্ষণ শুধু নির্যাতনে সীমাবদ্ধ থাকে না। কখনো কখনো শিশুদের প্রাণহানীও ঘটে থাকে। চলতি বছরের প্রথমার্ধে গড়ে মাসে অন্তত ৪৩টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অথচ গত বছর এই হার ছিল এর অর্ধেকের মতো। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, বিচারহীনতা, সামাজিক-পারিবারিক জটিলতা এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে এমন ঘটনা বাড়ছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নিয়মিত মানবাধিকার প্রতিবেদনে শিশু ধর্ষণের এ হিসাব পাওয়া গেছে। নয়টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সংবাদ এবং নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে আসক প্রতি মাসে এমন প্রতিবেদন তৈরি করে। আসকের হিসাবে, ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে মোট ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৬৩০টি। এগুলোর অর্ধেকের মতো ঘটনায় ভুক্তভোগীর বয়স বলা আছে। দেখা যায়, তাদের সিংহভাগেরই বয়স ১৮ বছর বা তার নিচে। আর ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার কারণে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২১টি। ধর্ষণের শিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছে ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুরা।
শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, চলতি বছরের ধারাটি উদ্বেগজনক। সব দিক থেকে প্রতিকার-প্রতিরোধের কাজ হওয়া দরকার। তেমনটা হচ্ছে খুব কম। চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটলে, গণমাধ্যম সোচ্চার হলে প্রশাসন ও নাগরিক সমাজ কয়েক দিন দৌড়ঝাঁপ করে। তারপর সব থিতিয়ে যায়। ঘটনা কিন্তু বেড়ে চলছে। সহিংসতা ও হিংস্রতাও বাড়ছে।
গত শুক্রবার (৫জুলাই) রাজধানীর ওয়ারীর নির্মাণাধীন একটি ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয় সাত বছরের শিশু সামিয়া আফরিন সায়মার লাশ। পুলিশ বলেছে, সায়মাকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। আসামি দ্রুতই গ্রেপ্তার হয়েছে। গত ২৭ জুন ১২ জন শিশুছাত্রীকে ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদরাসার অধ্যক্ষ আল-আমিনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১১। ঘটনাগুলো একের পর এক ঘটে চলেছে।
শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, শিশু নির্যাতন বাড়ার পেছনে বিচারহীনতা ও বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ করেও অপরাধী ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয় না। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হলেও তারা বিচার ও শাস্তি এড়িয়েই চলতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিদিন যেভাবে ধর্ষণের চিত্র ফুটে উঠছে, তাতে শীর্ষ দশে উঠতে হয়তো আর বেশি সময় লাগবে না। দিনদিন ধর্ষিতার তালিকা দীর্ঘই হতে থাকছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, সরকার, প্রশাসন, আইন ও বিচারব্যবস্থার কোনো উদ্যোগই ধর্ষণ থামাতে পারছে না। তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, ধর্ষণের অপ্রতিরোধ্য মিছিল থামাবার শক্তি কি কারোরই নেই?
এসব অপকর্ম তো আমাদের আশপাশের মানুষই করে। আমরাই করি। প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা মানুষ নাকি মানুষরূপী শয়তান? আমি মনে করি, মানুষের বিবেক যখন মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে, তখন তারা এমন ঘটনা ঘটাতে থাকে। যার ফলে ধর্ষিতার স্বপ্নভঙ্গ হয়। থামে না ধর্ষিতার বুকভাঙা হাহাকার। আমৃত্যু অপ্রতিরোধ্য এ গ্লানি সারা জীবন তাকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়। এসব ঘটনা নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয়, সেমিনার-র্যালি হয়, আন্দোলন হয়। কিন্তু তারপর সবাই আগের মতো চুপচাপ। থেমে যায় বিবেকের চিৎকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষেত্রেও একই অভিযোগ। প্রথমে দৌড়ঝাঁপ শুরু হলেও পরে গিয়ে তারা নির্লিপ্ত হয়ে পড়ে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পুলিশও জড়িত থাকে। এ জন্য ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ প্রয়োজন। নারী সংগঠনগুলোর এ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ প্রতিবাদ করা উচিত।
এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের পর্যাপ্ত ভূমিকা রয়েছে। যাতে ধর্ষণের মতো গর্হিত অপরাধ প্রতিরোধে সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে। সর্বোপরি কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটলেই ধর্ষকদের ধরিয়ে দিতে হবে। সবাই একযোগে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া ধর্ষণ প্রতিরোধে নারীদেরও দায়দায়িত্ব রয়েছে। অপরিচিত বা কয়েকদিনের পরিচিত এক বা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কোথাও যাওয়া ঠিক নয়। নারীদের দেখতে হবে সে কার সঙ্গে যাচ্ছে, তার সঙ্গে কত দিনের পরিচয়, ওই ব্যক্তি সম্পর্কে সে কতটুকু জানে, কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে ইত্যাদি বিষয়। হঠাৎ রাস্তায়, ফোনে বা ফেসবুকে পরিচয় এমন কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কোথাও যাওয়া উচিত নয়।
বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় নারী ও শিশুকে ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু সেই আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক সময় দীর্ঘসূত্রতার কারণে ভুক্তভোগীরা বিচারের আশা ছেড়ে দেয়। অথবা রাজনৈতিক ভয়ভীতি প্রদর্শন ও অর্থের বিনিময়ে সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যার ফলে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।
আমি মনে করি, দেশে ধর্ষণবিরোধী বিদ্যমান যে আইন রয়েছে তা সংস্কার, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, পুলিশের আলাদা তদন্ত ইউনিট গঠন, অভিযুক্তদের জামিন প্রদানে কঠোরতা, ধর্ষকদের শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং দোষীদের বিরুদ্ধে দেওয়া রায় গণমাধ্যমে ব্যাপক হারে প্রচার করা উচিত। যাতে করে সমাজে বসবাসকারী দুষ্ট প্রকৃতির লোক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নিরুৎসাহিত হয়। একই সঙ্গে ধর্ষণ প্রতিরোধে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গীকার থাকতে হবে। সম্মিলিত প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শুধু নারী নয় এসব ক্ষেত্রে পুরুষদেরও অংশ নিতে হবে। আদর্শের বাংলাদেশ গড়তে হলে ধর্ষণ নামক এই ব্যাধি এখনই থামাতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক