সংস্কারপন্থী কওমী প্রজন্ম

প্রকাশিত: ৭:৫৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৩, ২০১৯

ইবনে মুসা

উপমহাদেশে প্রধান দীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম কওমী মাদরাসা। রাসূল স. এর স্বপ্নে আঁকা বৃত্তেই গড়ে ওঠে দারুল উলূম দেওবন্দ। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বে দেওয়া ওলামায়ে দেওবন্দের পরিশ্রম, মুজাহাদা আর কোরবানীর ফল কওমী শিক্ষাধারা। পৃথিবীতে একদল খাঁটি দীনের খাদেম তৈরী করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দারুল উলূম দেওবন্দ। দীনি খেদমতের পাশাপাশি রাষ্ট্র ও জনকল্যাণে অ্যাকাডেমিক্যাল ও প্র্যাক্টিক্যাল শিক্ষা দেওয়া হয় কওমী মাদরাসায়।

দীন জাতি ও রাষ্ট্র কল্যাণে কওমী প্রজন্মের বিকল্প নেই। একটা সময় ছিল, কওমী শিক্ষার্থী কিংবা কওমী শিক্ষায় উত্তীর্ণ ব্যক্তি মানেই গণমানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের বটগাছ। তারা অন্যায় করেন না, তাঁদের মাঝে পার্থিব লোভ-লালসা থাকবে না, তাঁরা শুধু দীন ও জাতির কল্যাণেই নিবেদিত থাকবেন। অবশ্য এখনও মাঝে মাঝে এমন কিছু কওমী সন্তান লক্ষ্য করা যায়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কওমীর সেই পুরোনো ঐতিহ্য ও স্পিরিট এখন বিলুপ্ত প্রায়।

মূলধারার বাইরে কওমীতে তিন ধরণের সংস্কারপন্থী লক্ষ্য করা যায়। ১. সরকারী সনদে কওমী শিক্ষার মান দাবীদার। ২. কওমী শিক্ষাকে ভিন্ন প্রবাহে প্রবাহিত করা। ৩. মূলধারার সঙ্গে নতুন সংযোজন।

‘কওমীর মূলধারার বিশ্বাস ও নীতি হলো, সরকারী সার্টিফিকেট বা পার্থিব কোনো স্বীকৃতির জন্য কওমী ছাত্ররা লেখাপড়া করবে না। তাদের লেখাপড়ার উদ্দেশ্য হবে একমাত্র আল্লাহকে রাজিখুশি করা। সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণে রাসূল স.এর পথ ও পন্থায় জীবনযাপন করা। দেশ ও জাতির কল্যাণে সর্বস্ব দিয়ে নিজেকে নিয়োজিত রাখা।’

১ নং সংস্কারপন্থীরা কওমীর সেই মূল নীতিমালা ভঙ্গ করলেও তেমন কোনো সমস্যার সৃষ্টি করেনি। যদিও সরকারী সনদ একসময় অভিশাপ হয়ে দাড়াবার আশঙ্কা আছে কওমীদের ওপর। কিছু কিছু কুফল ইতোমধ্যেই সামনে চলে এসেছে। তারা সরকারী সনদে রাষ্ট্রীয় শিক্ষা-স্বীকৃতি ও রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা ভোগের জন্য এই দাবী করেছেন। তবে এটা আদৌ সম্ভব কী না তা সবারই কমবেশী জানা আছে।

২ নং সংস্কারপন্থীরা চাচ্ছেন কওমী শিক্ষার্থীরা স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের মতো জীবনযাপন করুক। তাদের পরিবেশের মতোই হয়ে উঠুক কওমী শিক্ষার পরিবেশ। মাদরাসায় দাঁড়ি ও পোশাকসহ সুন্নতের ওপর যে কঠোরতা আছে, সেটা শিথিল হোক। বরং মাদরাসার পক্ষ থেকে সুন্নতের ওপর গুরাত্বারোপকে বাড়াবাড়িই মনে করে তারা! ফলে এইপন্থী কওমী শিক্ষার্থীদের অন্যরকমভাবে চলাফেরা করতে দেখা যায় বেশিরভাগ সময়। পোশাক, কথাবার্তা, চলাফেরা, আড্ডা কিংবা মেলামেশায় অতিরিক্ত উদার তারা। এদের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই নিয়মিত টুপি ব্যবহার করে না। ইদানীং কাউকে কাউকে তো তাসলিমা নাসরিনের প্রশংসাও করতে দেখা গেছে! কওমীর জন্য এরা সবচেয়ে বড় খতরনাক হয়ে উঠেছে। এদের অনেকে গত কয়দিন কওমীর বিরুদ্ধে বেশ প্রোপাগান্ডাও ছড়িয়েছে। তবে হ্যাঁ, এটাও অস্বীকার করার সুযোগ নাই যে, বর্তমানে কওমীর বহু শিক্ষক/শিক্ষার্থী অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে মহিলা মাদরাসাগুলোর অবস্থা বেশ ভয়াবহ। অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এর সংখ্যা ও ব্যাপকতা আরও বেশি হলেও কওমীর দিকেই মানুষের নজর ও ঘৃণাটা বেশী। এর যৌক্তিক কারণও ঐ যে বিশ্বাস আ আস্থার বটগাছ! আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটা নড়বড় হলে সেটা একটু চোখে বেশীই লাগার কথা। এসব বিষয় নিয়ে আরেকদিন লিখব ইনশাআল্লাহ।

৩ নং সংস্কারপন্থীরা চাচ্ছেন, মূলধারার সঙ্গে নুতন করে কিছু সংযোজন করা। পরীক্ষা পদ্ধতি, কারিকুলামে কিছু সংযোজন বিয়োজন, উর্দু-ফার্সি বিষয়ে নতুন করে ভাবা, ভর্তি ও শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা, কালেকশন বিষয়ে আত্মমর্যাদামূলক সংস্করণ ইত্যাদি। যুগের চাহিদা ও কওমীদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে মাদরাসার পাশাপাশি কওমী শিক্ষাধারায় স্কুল শাখাও চালু করা। এরা মূলত কওমী শিক্ষার মূলধারাটাকে আরও বেগবান করতে চাচ্ছেন। কিন্তু জগদ্দল পাথরের মতো একদল বড় সাহেবরা কওমীর লাগাম নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। তারা না পারছেন ২ নং কে নিয়ন্ত্রণ করতে, না পারছেন ৩ নং এর বাস্তব রুপ দিতে। তারা তাদের মতো করে গদী দখল করে বসে আছেন। ফলে কওমীর হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসা তো দূরের কথা, দিন দিন তা হারিয়েই যাচ্ছে। বর্তমান কওমী শিক্ষার্থী বা শিক্ষকদের যে পদস্খলন, তার জন্য এই বড় সাহেবদের দিকে আঙুল তুললেও ভুল হবে না। কওমী মাদরাসার সংস্কার দরকার, তবে তা ৩ নং সংস্কার। পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে এখনই কওমী প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে।

আরও পড়ুন :

বাংলাদেশে ‘কওমী মহিলা মাদরাসা’র প্রাসঙ্গিকতা ও প্রস্তাবনা

যৌনশিক্ষা ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, প্রেক্ষিত : কওমী মাদরাসা

মন্তব্য করুন