

প্রকাশ্য দিবালোকে পশু কাটার মতো করে জলজ্যান্ত একটা মানুষকে চোখের পলকে কুপিয়ে হত্যা করা হলো। প্রকাশ্যে রাস্তায় চলতে থাকা একটা মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করছে অস্ত্রধারী দুই যুবক। নির্বোধের মতো কিছু মানুষ আবার হা করে তাকিয়ে থেকে তা দেখছে। যেন কারো কিছু করার নেই। এরই মাঝে স্বামী নামক ওই মানুষটিকে একাই বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন এক নারী।
একজন মানুষকে দুজন মানুষ কোপাচ্ছে। চেয়ে দেখছে শতজন। এর মাঝে একজন কিভাবে দুজন অস্ত্রধারীকে সামলাবে? তাও একজন নারী হয়ে! সম্ভব হয়ে ওঠেনি। নৃশংসভাবে স্ত্রীর সামনে স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুই মানুষ নামের অমানুষ। নিজের চোখের সামনে স্বামীর মৃত্যু দেখলো একজন তরুণি স্ত্রী। ঘটনাটি ঘটেছে বরগুনায় গতকাল বুধবার সকালে।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে রিফাত নেওয়াজ শরীফ (২২) নামের ওই যুবককে কুপিয়ে জখম করে স্ত্রী আয়শা আক্তার মিন্নির সাবেক স্বামী দাবিকারী নয়ন বন্ড ও তার সহযোগীরা। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় রিফাতকে প্রথমে বরগুনা সদর হাসপাতাল ও পরে বরিশাল শেরে-ই বাংলা মেডিকেল (শেবাচিম) কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকেল ৪টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
এই পুরো ঘটনাটি কোনো একজন ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো চেয়ে চেয়ে দেখেছে শুধু। তাদেরকে ভিতু-কাপুরুষ বলে আখ্যায়িত করা যাবে খুব সহজেই। ভিতুই আখ্যায়িত করলাম তাদের। কারণ তারা কিছুই করেনি চোখের সামনে একটি মানুষ খুন হচ্ছে দেখেও। কিন্তু আড়ালের যে লোকটি ঘটনাটির ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছে তাকে সাহসী বলতে হবে। খুনিদের সামনে গিয়ে প্রতিবাদ না করলেও সাহস করে অপরাধকাণ্ডের প্রমাণ সংরক্ষণ করেছেন। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ওই লোকগুলোর ব্যাপারে প্রশ্ন উঠে তারা কি নিরুপায় আর ভিতুই ছিলো নাকি তারাও এই হত্যাকাণ্ডের কুশিলব সহযোগী ছিলো?
এত্তোগুলো মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলো তাদের কি কিছুই করার ছিলো না? ভিডিওতে দেখায় প্রথম দিকে এক যুবক অস্ত্রধারীদের নিবৃত করার চেষ্টা করছিলো। তার হাতেও দাঁড়ালো দা এর কোপ লাগে। আহত হয়ে সে প্রতিবাদ হতে পিছু হটে। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো সম্মিলিতভাবে এগিয়ে এলে নিশ্চয়ই অস্ত্রধারীরাই পিছু হটতে বাধ্য হতো। এর আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীতে এরকম ভয়ংকর নৃশংস যৌথ হামলায় হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছিলো দেশবাসী। সেই ঘটনায় আদালত প্রথমে ৮জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও পরবর্তীতে মাত্র দুইজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুজন সহ চারজনকে খালাস দেয়া হয় আপিলের রায়ে। মামলায় প্রথমিকভাবে সাজাপ্রাপ্ত ২১ আসামীর মধ্যে গ্রেফতার হয়েছিলো মাত্র ৮ জন। এরমধ্যে চারজন খালাস পাওয়ায় মাত্র চারজন কারাগাড়ে আছে। বাকীরা সবাই পলাতক।
বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেশ-বিদেশে তুমুল সমালোচিত হওয়ার পরও আসামীরা অধিকাংশ খালাস পেয়ে গেলো। পলাতকরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেলো। এই যে একটা বিচারহীনতার সংস্কৃতি দিন দিন পোক্ত হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। সরকারী ছত্রছাঁয়ায় কিংবা প্রভাবশালীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি যে এই ধরণের নৃশংস কাণ্ড ঘটাতে উৎসাহ দিচ্ছে না তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। প্রতিনিয়ত দেশের কোথাও না কোথাও হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ কিংবা নিপিড়নমূলক কর্মকাণ্ড ঘটে চলছে। রিফাত হত্যার ২৪ ঘন্টা পেরুনোর আগে বুধবার রাতেই সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আলতাফ হোসেন মুকুল (৪৫) ও তার বৃদ্ধ মা রিজিয়া খাতুনকে (৯৫) গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বত্তরা
সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণ আর আগুনে পুড়িয়ে হত্যা যেন নিয়মিত হয়ে পড়েছে। ফেনীর নুসরাত কাণ্ডের তিন সপ্তাহের ব্যবধানে চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও সাভারে গৃহবধূকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। এমনকি মাত্র ১ সপ্তাহের ব্যবধানে ১১ এপ্রিল সোনাগাজীতেই এক যুবককে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার ঘটনা ঘটে এবং ১২ এপ্রিল মাদারীপুরে পুড়িয়ে মারা হয় ইট ভাটা শ্রমিককে। রাজবাড়ীতে স্কুল ছাত্রীর অশালীন ছবি তুলে চাঁদা দাবি করে না পেয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টা হয়। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে যৌতুকের দাবিতে স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি মিলে এক গৃহবধূর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এই সবগুলো ঘটনা একটার পরে আরেকটা ধারাবাহিকভাবে ঘটেছে। কেবলমাত্র নুসরাত হত্যাকাণ্ডের পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনার আলোকে আসামীদের দ্রুত গ্রেফতার করা হয়। তদন্ত সংস্থা পিবিআই দ্রুত সময়ে আদালতে ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করে। কিন্তু থেমে নেই হত্যা কিংবা ধর্ষণ ও নারী নিপিড়িনমূলক ঘটনা।
‘কিন্তু প্রশ্ন হলো সারাদেশের প্রত্যেকটি ঘটনায় কি প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হবে? অন্যথায় অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে? কিংবা অপরাধীরা সরকার দলীয় সমর্থক হলে বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ডের মতো রেহাই পেয়ে যাবে?’ এভাবে চলতে থাকা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য অশনি সংকেত। বিচারহীনতার এ প্রভাব সামাজিকভাবে অপরাধীদের প্রবলভাবে উৎসাহিত করে। ফলে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলে সমাজের অন্যান্য মানুষ। গায়ে পড়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজের গায়ে বিপদের খড়গ টেনে আনতে চায় না কোনো মানুষ। রিফাত হত্যাকারীদের গ্রেফতারে ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। নিহতের স্বজনসহ এলাকাবাসী ও দেশবাসীর প্রত্যাশা দ্রুত সময়ের মধ্যে অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন ও বিচার কার্যক্রম শুরু ও শেষ হবে।
সেই সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট বিনীত আবেদন থাকবে শুধুমাত্র নুসরাত কিংবা রিফাত অথাবা আলোচিত কোনো জঘন্যকাণ্ডে নয় আপনি বরং প্রত্যেক ঘটিত অপরাধ কাণ্ডের ব্যাপারে সারাদেশে আমভাবে কঠোর নির্দেশনা দিন। প্রশাসনের কর্তাদের অভয় এবং নির্দেশনা দিন তারা যেন স্থানীয় কোনো প্রভাবশালীর প্রভাবে কোনো ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রভাহিত না করে কিংবা অপরাধীদের সহায়ক ভুমিবা পালন না করে। এই ঘোষণা দিন যেন, কোনো অপরাধীকেই প্রশাসন ছাড় না দেয়।