

সামছ্ আল ইসলাম ভূঁইয়া
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে দেশের প্রশাসনের নির্লজ্জ ভূমিকা, বিরোধী রাজনৈতিক মতের সব ধরনের অধিকার হরণ আর রাতেই ভোট ডাকাতি মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে গঠিত হয়েছে নতুন সরকার।
জনগণ আশা করেছিলো ঐক্যফ্রন্ট আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের অচলাবস্থার অবসন ঘটাবে। কিন্তু হয়নি। নির্বাচনের পরে ঐক্যফ্রন্ট কোনো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামেনি। নামার চেষ্টা করতেও দেখা যায়নি। বরং ধানের শীষ প্রতীকে ঐক্যফ্রন্টের জনবিচ্ছিন্ন সংগঠন ড. কামাল হোসেন এর গণফোরামের ২ এমপিই সংসদ সদস্যের শপথ নিয়েছেন। পরে বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়ে শপথ নিয়েছে একজন। শেষ মুহূর্তে মহাসচিব বাদে বাকীরাও শপথ নিয়েছেন। পাঠিয়েছেন সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্যও। বিএনপি ২০দলীয় জোট ছেড়ে ঐক্যফ্রন্ট করার মাশুল ইতিমধ্যেই গুণতে শুরু করেছে।
অপরদিকে বর্তমান সময়ের আলোচিত ইসলামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তাদের বিভিন্ন দাবী গুলো ঐক্যফ্রন্টের অনেক দাবীর সাথেই মিলে যাচ্ছিল। একথাটি একটি টকশোতে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা, ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্নাও বলেছেন, “চরমোনাই পীরের দাবীগুলো আমাদের দাবীর সাথে মিল আছে”। অবশ্য এবিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনুস আহমদ বলেছেন, “যেহেতু আমরা উভয়েই সরকারের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কথা বলছি সেহেতু দাবীতে মিল থাকতে পারে। কিন্তু আদর্শিক ভাবে দূরত্ব থাকায় কোন জোট হবে না”।
জোট না হলেও জাতীয় নির্বাচনের পর ঐক্যফ্রন্টের মত ইসলামী আন্দোলনও ফলাফল প্রত্যাখান করেছে। এবং এই সরকারের অধিনে আর কোন নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে।
নির্বাচন কমিশন ফেব্রুয়ারীর শেষে ঢাকা উত্তরের সিটি নির্বাচন এবং মার্চ মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ৪ধাপে উপজেলা নির্বাচনের আয়োজন করে। এবং ১৮জুন সমাপ্ত হয় ৫ম ধাপও।
৪৯২টি উপজেলা পরিষদের মধ্যে ৫ ধাপে ৪৮০টিতে নির্বাচন করার প্রাথমিক পরিকল্পনা নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। তখন দলীয় সরকারের অধিনে আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাড়িয়েছে বিএনপি। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ঘোষণাও অনেকটা তাই ছিল।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে নিয়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ঘটনাগুলোতে ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপির সাথে ইসলামী আন্দোলনের রাজনৈতিক কৌশল ও সিদ্ধান্ত গুলো কাকতালীয় ভাবে মিলে যাওয়া নাকি অনুসরণ তা এখনো স্পষ্ট নয়। আদর্শিকভাবে যেমন;
দেশের ইসলামপন্থী রাজনীতি এবং বিএনপি আওয়ামীলীগের রাজনীতির ধারা এক রকম নয় তেমনই কৌশলে ও অনুকরণেও ভিন্নতা থাকা দরকার ছিল।
ইসলামী আন্দোলনের স্বতন্ত্রতা, দক্ষতা ও যোগ্যতা এখন পর্যন্ত জনগণের কাছে শতভাগ প্রমাণিত নয়। ইসলামী আন্দোলন যদি বড় বিরোধী দল হিসাবে বিএনপিকে অনুসরণ করে রাজনীতি করতে চায় তবে জনগণের কাছে তাদের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা অপ্রমাণিতই থেকে যাবে।
যে সমস্ত ইসলামপন্থী দলগুলো দীর্ঘ দিন বিএনপির সাথে জোটর রাজনীতি করেছে তাদের তো অনুসরণের বিকল্প নেই। কিন্তু একাদশ জাতীয় নির্বাচনে একক ভাবে অংশগ্রহণ করে ইসলামী আন্দোলন যে পরিচিতি লাভ করেছে, নেতাকর্মীরা গণমুখী রাজনীতির চর্চা করছে, তা ধরে রাখতে হলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হবে। পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে।
স্থানীয় নির্বাচন দলীয় সরকারে অধিনেই হয়ে থাকে, এবং হবে। এটা বিএনপি আসলেও এই সিস্টেমেই চলবে। ঐক্যফ্রন্টের মত যদি ইসলামী আন্দোলন উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে না দাঁড়াতো তাহলে সরকার কোথাও সুষ্ঠ নির্বাচনের নজির দেখাতে পারতো না।
যেখানেই দেখাতো সেখান ইসলামী আন্দোলন কেই মানুষ ভোট দিতো। নৌকা প্রতিকের প্রতি সাধারণ মানুষের এলার্জি হয়ে গেছে। ৭০% ভোটারই ভোট কেন্দ্রে যায়নি। যারা গিয়েছেন তারা স্বতন্ত্র প্রার্থীকেই ভোট দিয়েছেন। যেখানেই নৌকার প্রার্থী জিতেছে সেখানেই অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে।
শুধু ৪র্থ ধাপের নির্বাচনেই স্বতন্ত্র হিসেবে জয়ী হয়েছেন ৩২ জন চেয়ারম্যান। সরাইল উপজেলা নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী ৪র্থ হয়েছে। আমতলী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মাত্র ৩ হাজার ৬১২ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম দেলোয়ার হোসেন। নৌকায় জাল ভোট দিয়ে জেলেও ডুকেছেন অনেকেই।
উপজেলার সাথে জাতীয় নির্বাচনের কোনোই মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মাঠে থাকলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মত উপজেলা নির্বাচনেও সে চিত্রই ফুটে ওঠতো।
দলকে তৃণমূল থেকে শক্তিশালী এবং নির্বাচনের জন্য যোগ্যমানের নেতাকর্মী তৈরী করতে হলে ইউনিয়ন পরিষদ বা স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচন বর্জন কোনো ভাবেই সুফল দেবে না। দলীয় সরকারের অধিনে বা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধিনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না ধরে নিয়েই ইসলামী আন্দোলনকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিৎ। বিএনপির সাথে যদি ইসলামী আন্দোলনও ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি নির্বাচন বর্জন করে তবে আওয়ামী লীগকে ওয়াকওভার দেয়া হবে। যেমন দেয়া হয়েছিল দশম জাতীয় নির্বাচন। ওই সময়ে আওয়ামীলীগ কে ওয়াকওভার করে খুব বেশি লাভ হয়নি।
একাদশ জাতীয় নির্বাচন যেমনই হোক- ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা এ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই গণমুখি জাতীয় রাজনীতি শুরু করেছে। নেতাকর্মীদের মধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রাম ইউনিয়ন পর্যায়ে সাংগঠনিক কাঠামো তৈরী হয়েছে। এখন ইসলামী আন্দোলন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালে নেতাকর্মীরা আগের মতোই বেকার হয়ে পড়বে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সারাদেশে যে পরিচিতি পেয়েছে তা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। গণমুখী রাজনীতি থেকে নেতাকর্মীরা আস্তে আস্তে দুরে সরে যেতে পারে। জনকল্যাণমূলক রাজনীতির বিপরীতে জনবিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হবে। তাছাড়া দেশের রাজনীতিতে এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি যে সরকার বিরোধী আন্দোলন করে ইসলামী আন্দোলন সামনে এগিয়ে যেতে পারবে। সহসা এমন কোনো সম্ভবনাও দেখছেন না রাজনীতি সচেতন মানুষরা। সুতরাং গণমুখী সমাজকল্যাণমূলক রাজনীতির সাথে মিশে থাকতে পারলেই গণমানুষের আস্থা অর্জন করা সহজ হবে।
সরকার নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন করবে, তাদের কথা-কাজে মিল থাকবে না, নির্বাচন কমিশন সরকারের তাবেদারি কবে, এমন চিন্তাভাবনা গুলো মাথায় রেখেই রাজনৈতিক কৌশল গ্রহন করতে হবে। রাজনৈতিক দল হিসাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা এবং সরকারের অগণতান্ত্রিক মনোভাবের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করাই এখন ইসলামী আন্দোলনের রাজনৈতিক কর্মকৌশল হওয়া উচিত।
দশম জাতীয় নির্বাচনের মতো একাদশ জাতীয় নির্বাচনও যদি বিরোধী দলগুলো বর্জন করতো তবে কোনো ভাবেই প্রমান করা সম্ভব হতো না সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কতোটা অগণতান্ত্রিক হতে পারে। সুতরাং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কে ব্যর্থ ঐক্যফ্রন্টের থেকে বিপরীত মুখী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
নির্বাচন বর্জন না করে সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেই বার বার প্রমান করতে হবে দলীয় সরকারের অধিনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। গণবিপ্লব সৃষ্টির জন্য আপাতত এটাই সঠিক পথ।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক