

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। প্রতি বছর রমজান জুড়ে অর্থাৎ ঈদের আগ থেকেই নজরুল ইসলামের কালজয়ী এই গানটি আমাদেরকে ঈদুল ফিতরের আগমনী বার্তা শুনিয়ে যায়। মর্মে মর্মে বেজে উঠে ঈদের আগমনী শুভেচ্ছা। গানটির সুর, ছন্দ ও সহজবোধ্যতা মানুষকে এতোটাই আকর্ষণ করেছে যে, ঈদের দিনে গানটি না গাইলে মনে হয় ঈদের আনন্দই পূর্ণতা পায় না।
কবিতা পাঠকের মনকে নাড়া দেয়। কবিতার সুর ও ছন্দ শ্রোতার হৃদয় উদ্ধেলিত করে। একটি কবিতা বা গান যখনই বাস্তবমুখি এবং সহজবোধ্য হয় তখনই পাঠক-শ্রোতার হৃদয়ে জায়গা জুড়ে নেয়। নজরুল ইসলামের বিখ্যাত এই গীতি কবিতার পরতে পরতে মানুষের মনের কথাগুলো সাজানো হয়েছে। যার জন্য প্রতিবছর পুরনো গানটিই নতুন করে শ্রোতার হৃদয় জুড়ে আনন্দের ঝড় তোলার জন্য ফিরে আসে।
বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রায় সব শিল্পীদের কন্ঠেই কালজয়ী এই গানটি শোনা যায়। বাঙালির মন ও মননে নজরুলের এ গানটি চিরায়ত হয়ে আবেদন রাখছে, রাখুক এবং রাখবে যুগ যুগান্তরে। লেখা বড় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আপাতত ছোট্র পরিসরে গানের প্রথম দুটি লাইন নিয়েই কথা বলবো আমরা।
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খশির ঈদ’ ‘আপনাকে আজ বিলিয়ে দে তুই আসমানী তাগিদ’। এ গান শুধু গান নয়। এটি একটি কালজয়ী আহ্বান। এই গানে নজরুল শুধু খুশির খবরই শুনাননি। গানের ভিতর দিয়ে করে গেছেন মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হওয়ার আ্হ্বান। করেছেন মানবতার আহ্বান, মনুষত্বের আহ্বান।
ঈদের খুশির খবর জানান দেয়ার পরপরই গানটিতে বলা হয়েছে, ‘আপনাকে আজ বিলিয়ে দে তুই আসমানী তাগিদ’। আপনাকে মানে নিজেকে বিলিযে দেওয়ার আহ্বান। অর্থাৎ বিলিয়ে দাও নিজেকে মানুষের মাঝে। মানবতার মাঝে। মিটিয়ে দাও নিজের আমিত্বকে।
আপনার ভিতর থাকা আমিত্ব, অহংকার, হিংসা, বিদ্ধেষ, পরনিন্দা, চোগলখুরি সব কিছু ছেড়ে দাও। অন্তরে লুকিয়ে থাকা আমিত্বকে বিলীন করে দিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দাও মানুষের তরে, মানবতার তরে। আপন করে নাও মানুষকে।
কেন এসব করবে? কেন নিজেকে মিটিয়ে দিবে? কেন নিজেকে অপরের মাঝে বিলিয়ে দিবে? কারণ এটা আসমানী তাগিদ। আসমানের মালিকের শিক্ষা এমনই। এটা তার আহ্বান। আসমানের মালিক তোমাকে এই আহ্বান করেছেন। আসমানের মালিক তোমাকে-আমাকে বলেছেন, নিজেকে বিলিয়ে দাও মানুষে মাঝে। আপন করে নাও মানুষকে। গাও মানবতার জয়গান।
- কেননা ঈদের এই আনন্দের সাথে প্রচ্ছন্নভাবে জড়িয়ে আছে দীর্ঘ এক মাসের উপবাসের স্মৃতি। রোজার শেষে ঈদ এসেছে কথার দ্বারা এ কথার দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রোজার শেষে এই আনন্দ যদি সবার মাঝে ভাগাভাগি করে নেয়া না যায় তাহলে এই দীর্ঘ উপবাস একদমই বৃথা।
আনন্দের দিনে কেউ এক মাসের উপবাস মুক্তির আনন্দ উদযাপনে উদরপুর্তি করে খাবে আর অন্যদিকে কেউ সারা বছর উপবাস থাকবে এটা প্রভুর শিক্ষা নয়। সুতরাং খোঁজ নাও তোমার আশেপাশে কে আছে উপবাসকারী। নিজেকে বিলিয়ে দাও উপবাসবকারীর মাঝে।
রোজার দিনে আমরা যেমন সারাদিনের উপবাসের পর ইফতারিতে চেনা-অচেনা পথচারী দেখলেও নিজেকে খাবারে ভাগ দেই, নিজের জায়গা ছেড়ে বসতে দেই, খেতে দেই সহমর্মীতা দেখাই এসবই করতে হবে রোজার শেষে ঈদের দিন থেকে নিয়ে সারা বছর। এক মাসে যেসব উত্তম গুনাবলির শিক্ষা এবং চর্চা আমরা করলাম তা অব্যহত রাখতে হবে সারাবছর। তবে রমজানের শিক্ষার পূর্ণতা পাবে।
সেই শিক্ষাই দেওয়া হয়েছে এই গানের ভিতর দিয়ে। আপোনার আমিত্বকে বিলীন করে মানুষের সাথে মিশে যাও। এটাই প্রভুর শিক্ষা, এটাই আসমানী তাগিদ। আমরা যেন নজরুলের এই কালজয়ী গান থেকে এমন শিক্ষাই নিতে পারি।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক