
তাওহীদুল ইসলাম
কায়রো, মিশর থেকে
খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দের শুরুর দিকে ৯০৯ সালে আফ্রিকার ভূমধ্যসাগরের উপকূলীয় অঞ্চল তিউনিসিয়াকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে শিয়া ইসমাঈলি মতবাদ ধারণকারী ফাতেমি খেলাফত। অর্ধ শতাব্দেরও অধিক সময়কাল ধরে উক্ত অঞ্চলেই থাকে খেলাফতের কেন্দ্রবিন্দু।ভৌগলিক অবস্থানের দিক দিয়ে মিসর পৃথিবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। তাই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সুবিধার্থে লোহিত সাগরের পূর্ব এলাকা মিসরকে খেলাফতের কেন্দ্রবিন্দু বানানোর পরিকল্পনা নিয়ে ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে শিয়া ইসমাঈলি ইমাম ও চতুর্থ ফাতেমি খলিফা আলমুঈজ লিদিনিল্লিাহ-এর নির্দেশে সেনাপতি জাওহার সিকিল্লি আব্বাসি শাসকদের পরাজয় করে মিসর দখল করেন। তিনি নীল নদের ব-দ্বীপ এলাকার শীর্ষভাগে তৃতীয় ফাতেমি খলিফা মনসুর বিল্লাহ আবু তাহের ইসমাঈল-এর নামানুসারে মানসুরা নামে নতুন একটি শহরের ভিত্তিস্থাপন করেন। ২৪ জুমাদাল উলা ৩৫৯ হিজরি মোতাবেক ৭ মে ৯৭১ খ্রিস্টাব্দে জামিউল আজহার নির্মাণকাজ শুরু হয়।
দু’বছর পর খলিফা আলমুঈজ লিদিনিল্লিাহ নতুন বিজিত দেশ মিসরে আগমন করেন। তিনি নতুন শহর ‘মানসুরা’-র নাম পরিবর্তন করে ‘কাহেরা’ রাখেন। আর কাহেরাকে ফাতেমি খেলাফতের রাজধানী ঘোষণা করেন।
তিনি ৩৬১ হিজরিতে জামিউল আজহারে প্রথম জুমার নামাজ আদায় করে জামিউল আজহারকে ফাতেমি খেলাফতের নতুন রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় মসজিদ ও শিয়া ইমামিয়্যাহ ইসমাঈলিদের শিক্ষাদীক্ষার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেন।
শিয়া ইসমাঈলি ফিকহের প্রতিষ্ঠাতা আলমুঈজ লিদিনিল্লিাহ-র শিয়া কাজী আবু হানিফা ইবনে মুহাম্মদ আল কায়রাওয়ানি জামিউল আজহারে সর্বপ্রথম শিক্ষাপ্রদান শুরু করেন। তার পরে তার সন্তান ও অন্যান্য শিয়া উলামাগণ জামিউল আজহারে শিক্ষাদীক্ষার দায়িত্ব পালন করেন।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই জামিউল আজহারে শিয়া আকিদা, ফিকহ ও অন্যান্য দীনি শাস্ত্রের পাশাপাশি আরবি ভাষা, ইলমুল কিরাআত, মানতেক, জ্যোতির্বিদ্যার শিক্ষাদান করা হতো।
পাঠ্যপুস্তকে সর্বাধিক গুরুত্ব পেতো শিয়াদের রচিত গ্রন্থাবলি। প্রতিষ্ঠার স্বল্প সময়ের মধ্যে জামিউল আজহার শিয়া ইসমাঈলিদের আকিদা-বিশ্বাসের প্রচার-প্রসার এবং শিক্ষাদীক্ষা বিস্তারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পরিণত হয় শিয়া উলামাগণের দীনি জ্ঞান চর্চার সর্বশ্রেষ্ঠ মারকাজ।
মিসরে জামিউল আজহারের পূর্বে আরও দুটি মসজিদ স্থাপিত হয়েছিলো। জামিউ আমর ইবনুল আস ও জামিউ আহমদ ইবনে তুলুন। প্রাচীন এই দুই মসজিদকেও দেওয়া হয়েছিলো শিক্ষাকেন্দ্রের রূপ। এ ছাড়া রাষ্টীয়ভাবে আরও অনেক শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলো।
এসবগুলোই পরিচালিত হতো শিয়াদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে। মিসরে শিয়া শাসন ও রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশব্যাপী শিয়া শিক্ষাদীক্ষার পৃষ্ঠপোষকতার ফলে সুন্নি উলামায়ে কেরাম মিসর থেকে হিজরত করে বিভিন্ন এলাকায় হিজরত করে চলে যায়। শিয়া শাসন ও রাষ্ট্রীয়ভাবে শিয়া শিক্ষাদীক্ষা,সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারের দরুণ স্বল্প সময়েই গোটা মিসরের সর্বত্র শিয়াদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হয়ে যায়।
মসজিদের দেয়াল, রাস্তাঘাট ও অলিগলিতে লিখে দেওয়া হয়েছিলো সাহাবায়ে কেরামের গালিগালাজে ভরপুর বিভিন্ন বাক্য। সমস্ত মসজিদের আজানকে পরিবর্তন করে শিয়াদের আজান প্রবর্তন করা হয়েছিলো। আজানের মধ্যে ‘হাইয়া আলাস সালাহ’-এর পরিবর্তে ‘হাইয়া আলাল খাইরিল আমাল’ বলা হতো।
রাষ্ট্রীয়ভাবে আল আজহার মসজিদে আশুরার দিন মাতম করা, জুলুস বের করাসহ সবধরনের শিয়াদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করা হতো। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত পরিণত হয়েছিলো সংখ্যালঘু গোষ্ঠিতে ।
ফাতেমি শাসনের পতন
৩৬১ থেকে ৫৬৭ হিজরি (৯৭১ থেকে ১১৭১ খ্রিস্টাব্দ) এগারোজন ফাতেমি শাসক দুুই শতাব্দ ধরে মিসর শাসন করেন। মিসরে প্রথম ফাতেমি শাসক ছিলেন আলমুঈজ লিদিনিল্লিাহ, আর সর্বশেষ খলিফা ছিলেন আদিদ লি-দিনিল্লাহ। ৫৬৭ হিজরিতে সুলতান সালাহুদ্দিন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব (মৃত ৫৮৯ হিজরি)-এর হাতে ফাতেমি শাসনের পতন হয়। পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলীন হয়ে যায় ফাতেমি শাসনব্যবস্থা।
সুলতান সালাহুদ্দিন ইউসুফ ইবনে আইয়ুবি মিসরকে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত আব্বাসি খেলাফতের সঙ্গে যুক্ত করেন। আব্বাসি খলিফার পক্ষ থেকে তিনি সুলতান উপাধিতে ভূষিত হন৷
সালাহুদ্দিন আইয়ুবি মিসরের ক্ষমতা দখল করে অতি দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে মিসরকে শিয়ামুক্ত করেন। মিসর থেকে শিয়া শাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থা উৎখাত করে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মতাদর্শে মিসরকে পুনরায় ঢেলে সাজান। প্রতিষ্ঠা করেন একটি সুন্নি রাষ্ট্র।
সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি মিসরকে শিয়ামুক্ত করতে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন—
১. মিসরের সকল মসজিদ থেকে আশুরার মাতম, ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনসহ শিয়াদের ধর্মীয় সকল অনুষ্ঠান পালন বন্ধ ঘোষণা করেন এবং সমস্ত মসজিদ থেকে শিয়াদের প্রবর্তিত আজান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আহলে মক্কার মতো আজান দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন।
২. তিনি ছিলেন শাফিঈ মাজহাবের অনুসারী। তাই শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী কাজীদের বরখাস্ত করে শাফেঈ মাজহাবের বিচারকদের নিয়োগ দেন। ফকিহ আবদুল মালেক ইবনে দিরবাস শাফেঈকে মিসরের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব প্রদান করেন।
৩. মুসলিম বিশ্বের বিখ্যাত বিখ্যাত উলামায়ে কেরামকে মিসরে নিয়ে আসেন। তাদেরকে বিচারকের পদসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োগ দেন।
৪. চার মাজহাবের উচ্চতর লেখাপড়ার জন্য প্রায় পঁচিশটি উচ্চস্তরের মাদরাসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ এগুলোকে বর্তমান পরিভাষার ‘জামিআ’ বলে উল্লেখ করেছেন। এসব মাদরাসার অধিকাংশ ছিলো মসজিদভিত্তিক। পববর্তীতে আইয়ুবির শাসকরা চার মাজহাবের উচ্চতর আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। যে সকল প্রতিষ্ঠান থেকে ফিকহ, হাদিস, তাফসির, কিরাআত, জ্যামিতি, গণিত, মানতিক, ইত্যাদি শাস্ত্রের উচ্চস্তরের শিক্ষাদীক্ষা প্রদান করা হতো।
৫. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বুজুর্গানে দীন ও আউলিয়ায়ে কেরামের জন্য বিভিন্ন খানকা গড়ে তোলেন।
৬. শাফিঈ মাজহাবকে রাষ্ট্রীয় মাজহাব ঘোষণা করেন।
৭. যেহেতু জামিউল আজহার ছিলো ফাতেমি খেলাফতের রাষ্টীয় মসজিদ ও শিয়াদের প্রধান ও সর্বোচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র এবং তাদের সর্বাধিক মর্যাদাশীল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও চেতনার বাতিঘর; তাই মিসর থেকে শিয়া মতাদশের্র প্রভাব নিশ্চিহ্ন ও উৎখাত এবং তাদের রীতিনীতিগুলো মিসর থেকে নির্মূল করতে তখনকার জামিউল আজহার থেকে মিসরবাসীদের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য (সাময়িকভাবে) জামিউল আজহারকে বন্ধ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত ছিলো সালাহুদ্দিন আইয়ুবির যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ও বিচক্ষণতার পরিচয়।
শাফেঈ মাজহাবের আলোকে মিসরের প্রধান বিচারপতির ফকিহ আবদুল মালেক ইবনে দিরবাস ফতোয়া দিলেন এক শহরে একাধিক জুমা বৈধ নয়৷ তখন জামিউল আজহারে জুমার নামাজ বন্ধ করে জামিউ হাকিম বিআমরিল্লাহতে জুমার নামাজ চালু করা হয়।
জামিউল আজহারের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার ফলে যে লাভ হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো— আজহার ও মিসরের শিক্ষাব্যবস্থা শিয়াপন্থী হওয়ার ফলে মিসর থেকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মতাদর্শের যেসব উলামায়ে কেরাম বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিলেন, তারা পুনরায় মিসরে ফিরতে শুরু করেন।
সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবির এই পদক্ষেপের ফলে মিসর বিশ্ববিখ্যাত উলামায়ে কেরাম ও জ্ঞানপিপাসু তালিবে ইলম, বুজুর্গানে দীন ও আউলিয়ায়ে কেরামের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। মিসর থেকে সালাহুদ্দিন আইয়ুবি শিয়া মতাদর্শের মূলোৎপাটন করতে গিয়ে দুটি বড়ো বড়ো বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তার প্রথমটা ছিলো অনেক ভয়াবহ। শিয়া সম্প্রদায় মিসরের বাইরের শিয়া ও ক্রুসেডার থেকে সাহায্য নিয়েছিলো৷ কিন্তু তারা উভয়বার পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে মিসর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
৫৬৭ থেকে ৬৪৮ হিজরি (১১৭১—১২৫০ খ্রিস্টাব্দ) মোট একাশি বছরে আটজন আইয়ুবি শাসক মিসর শাসন করেন।
মিসরে আইয়ুবি শাসনের প্রথম শাসক ছিলেন সুলতান সালাহুদ্দিন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব (মৃত ২৭ সফর ৫৮৯ হিজরি/ ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দ ) এবং সর্বশেষ শাসক ছিলেন তুরান শাহ। তার মৃত্যুর পর অস্তমিত হয় আইয়ুবি শাসন।
আইয়ুবি শাসনামলের পর মিসরের ক্ষমতায় আসে মামলুক সালতানাত । আইয়ুবি শাসনামলের পুরো সময়টাই জামিউল আজহারে জুমার নামাজ বন্ধ থাকে। মামলুক সালতানাতের সতেরো বছর পর চতুর্থ মামলুক শাসক সুলতান জাহির রুকনুদ্দিন বেইবার্স বুন্দুকদারি ৬৬৫ হিজরিতে (১২৬৭ খ্রিস্টাব্দে) আটানব্বই বছর পর পুনরায় জামিউল আজহারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মতাদর্শের জুমার নামাজ ও শিক্ষাকার্যক্রম চালু করেন। শুরু হয় জামিউল আজহারের নতুন পথযাত্রা। ফিরে পায় আজহার তার হারিয়ে যাওয়া কেন্দ্রীয় অবস্থান ও মর্যাদা।
আজহার সেই সপ্তম শতাব্দ হতে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ইলমি মারকাজ। আজহার মুসলিমউম্মাহর অমূল্য সম্পদ। আজহার মুসলিমউম্মাহর গৌরবগাঁথা ঐতিহ্য। আজহারের এই ইলমি ঐতিহ্যের পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন মুসলিম বীরসেনানী সুলতান গাজি সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.)৷ যিনি উদ্ধার করেছিলেন মিসরকে ও আজহারকে দুস্কৃতিকারী শিয়া সম্প্রদায়ের ভয়াল থাবা থেকে।
উল্লেখ্য, মুসলিম অকুতোভয় সেনানায়ক ক্রুসেডারদের আতংক সুলতান গাজি সালাহুদ্দিন আইয়ুবি ১১৯৩ সালের ৪ মার্চ দামেস্কে অসুস্থাবস্থায় ইন্তেকাল করেন। উমাইয়া মসজিদের পশ্চিমকোণে তাকে সমাহিত করা হয়। সেখানেই আজও তার মাজার রয়েছে।
জামিউল আজহার আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে তার মুহসিন সুলতান গাজি সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.)-কে। রাব্বে কারিম তাকে মুসলিমউম্মাহর পক্ষ হতে উত্তম প্রতিদান দান করুন৷ আমিন৷
লেখক :শিক্ষার্থী, আল আজহার ইউনিভার্সিটি, মিশর
মন্তব্য করুন