ঈদ সামনে রেখে বাজারে জালনোটের ছড়াছড়ি; সতর্ক থাকার আহবান

প্রকাশিত: ১০:৪৩ অপরাহ্ণ, মে ১৫, ২০১৯

ঈদকে সামনে রেখে বাজারে জাল নোট সরবরাহকারীদের দৌরাত্ম বেড়েছে। বিভিন্ন সময়ে অভিযানে তাদের আটক করলেও আইনের ফাঁক গলে তারা বের হয়ে ফের এ কারবারে যুক্ত হচ্ছে। তাদের গ্রেফতার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও হিমশিম খাচ্ছে। জালনোট সরবরাহকারীদের হাত থেকে সবাইকে সতর্ক থাকার আহবান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।


প্রশাসনের তথ্যমতে, এ কারবারে জড়িতদের গ্রেফতার করা হলেও ৮০ শতাংশই জামিনে মুক্তি পেয়ে পরবর্তী সময়ে আবারো নিয়োজিত হচ্ছে জাল নোটের ব্যবসায়। ঈদ এলেই তাদের সিন্ডিকেট সারাদেশে সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিভিন্নভাগে বিভক্ত হয়ে জাল নোটের কারবারী করছে বেশ কিছু অসাধু চক্র।

এরা নগরীর আশপাশ এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে জাল নোট তৈরি করে। ধরা পড়ার ভয়ে তারা এক বাসায় বেশি দিন থাকে না। কয়েক মাস পর পর তারা বাসা বদলে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলে যায়। সেখানেই গড়ে তোলে জাল নোট তৈরির টাকশাল।

এ সিন্ডিকেটে নারী সদস্যও রয়েছে। প্রতিটি স্তরেই ওই সিন্ডিকেটের নারী সদস্য সক্রিয় রয়েছে। কখনো গৃহিণী, কখনো কলেজছাত্রী সেজে জাল টাকা বহন করে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে তারা। আবার তাদের মাধ্যমেই পণ্য কেনাকাটা করে মার্কেটে জাল টাকার বিস্তার ঘটানো হয়। সেজন্য তাদের দেয়া হয় মোটা অঙ্কের কমিশন। ধরা পড়লে তাদের আইনি সহায়তাও দেয় সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

এদিকে জাল নোটের এই অবৈধ কারবারিদের হাত থেকে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে প্রতিবারের মতো এবারো উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের সচেতনতার অংশ হিসেবে দেশের ৫৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংককে আসল নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য-সংবলিত ভিডিওচিত্র প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

জাল টাকা তৈরিকারী চক্রের এক সদস্য জানিয়েছেন, প্রতি একশ পিস ১০০০ টাকার নোট অর্থাৎ ১ লাখ টাকা তৈরি করতে তাদের খরচ পড়ে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা। সেই টাকা তারা আবার ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে।

গত সোমবার বিকেলে ঢাকা মেডিক্যাল এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২ লাখ ৩২ হাজার জাল নোটসহ চারজনকে গ্রেফতর করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (দক্ষিন বিভাগ) পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- হাবিবুর রহমান ওরফে হাবিব মোল্লা, মিন্টু ব্যাপারী, রুবেল ব্যাপারী, দুলাল মিয়া। এ চক্রের দলনেতা হাবিব মোল্লা বলে জানিয়েছে গোয়েন্দারা। এ চক্রটি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় জাল নোটের লেনদেন করতো।

এর আগে গত শুক্রবার রাতে কামরাঙ্গীরচর থানার পূর্ব রসুলপুর এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালায় গোয়েন্দারা। এ সময় ৪৬ লাখ টাকার জাল নোট ও জাল নোট তৈরির সরঞ্জামসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (দক্ষিণ) পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- জীবন ওরফে সবুজ, জামাল উদ্দিন ও বাবুল ওরফে বাবু। পুলিশ বলছে, ঈদকে সামনে রেখে চক্রটি বিপুল পরিমাণ জাল টাকা বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা করেছিল।

জানা গেছে, ঈদ ও কোরবানীসহ বড় উৎসব আসলেই জাল নোট প্রতারকচক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। অধিক লাভের আশায় প্রতারণাকারীরা সাধারণত ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বেশি জাল করে থাকে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত এক হাজার টাকার মূল্যমানের ৬ লাখ ৮২ হাজার টাকার জাল নোট ধরা পড়েছে। একই সময়ে ৫০০ টাকা মূল্যমানের এবং ১০০ টাকা মূল্যমানের ৬২ হাজার ৭০০ টাকার জাল নোট ধরা পড়েছে।

জানা গেছে, উৎপাদকের এক লাখ টাকা তৈরি করতে খরচ হয় সাত থেকে ১০ হাজার টাকা। তারা পাইকারি বিক্রেতার কাছে ১ লাখ টাকা ১৪-১৫ হাজার টাকায় বিক্রয় করে। পাইকারি বিক্রেতা ১ম খুচরা বিক্রেতার নিকট বিক্রয় করে ২০-২৫ হাজার টাকা, ১ম খুচরা বিক্রেতা ২য় খুচরা বিক্রেতার নিকট বিক্রয় করে ৪০-৫০ হাজার টাকায় এবং ২য় খুচরা বিক্রেতা মাঠ পর্যায়ে সেই টাকা আসল এক লাখ টাকায় বিক্রয় করে।

গ্রেফতার জাল নোট কারবারী ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জাল নোট তৈরির জন্য প্রথমে টিস্যু কাগজের এক পার্শ্বে বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি স্ক্রিনের নিচে রেখে গাম দিয়ে ছাপ দিতো। এরপর ১০০০ লেখা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রামের ছাপ দিতো। অতপর অপর একটি টিস্যু পেপার নিয়ে তার সাথে ফয়েল পেপার থেকে টাকার পরিমাপ অনুযায়ী নিরাপত্তা সূতা কেটে তাতে লাগিয়ে সেই টিস্যুটি ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি জলছাপ দেয়া টিস্যু পেপারের সাথে গাম দিয়ে সংযুক্ত করে দিতো।

এভাবে টিস্যু পেপার প্রস্তুত করে বিশেষ ডট কালার প্রিন্টারের মাধ্যমে ল্যাপটপে সেভ করে রাখা টাকার ছাপ অনুযায়ী প্রিন্ট করা হতো। ওই টিস্যু পেপারের উভয় সাইট প্রিন্ট করা হতো এবং প্রতিটি টিস্যু পেপারে মোট ৪টি জাল টাকার নোট প্রিন্ট করা হতো। এরপর প্রিন্টকৃত টিস্যু পেপারগুলো কাটিং গ্লাসের উপরে রেখে নিখুঁতভাবে কাটিং করা হতো। পরবর্তীতে কাটিংকৃত জাল টাকাগুলো বিশেষভাবে বান্ডিল করে এটি চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হতো।

ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, উদ্ধার হওয়া জাল টাকা আগের টাকার চেয়ে অনেক বেশি নিখুঁত উল্লেখ করে তিনি বলেন, উদ্ধার হওয়া জাল টাকায়ও নিরাপত্তা সুতা স্থাপন করা হয়েছে। এসব নিরাপত্তা সুতা তারা কিভাবে যোগাড় করেছে সেই ব্যাপারে গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সাধারণ চোখে বোঝা খুবই কঠিন যে এটা জাল টাকা। তবে অরজিনাল টাকা কিছুটা খসখসে এবং জাল টাকা বেশি মসৃণ বলে তিনি জানান। এক্ষেত্রে টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে সচেতন হওয়ার আহবান জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

মন্তব্য করুন