

ইবনে মুসা
আজ দ্বিতীয় রোযা। প্রথম রোযাটি প্রায় ১৫ ঘন্টাব্যাপী ছিল। গরমও প্রচণ্ড। আসর অবধি গরম ছিল মধ্যপ্রাচ্যের গরমের ন্যায়। গত ক’দিন যাবত বাংলাদেশে অসহ্যনীয় গরম পড়েছে। ঘুর্ণিঝড় ‘ফণী’র পর সেই দাবদাহ আবার শুরু। গরমে হাঁপিয়ে উঠেছে মানুষ। দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে জনজীবন। এর মাঝে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি আর খাদ্যে ভেজাল, সব মিলিয়ে একজন রোযাদারের জন্য স্বস্তির কোনো সংবাদ নেই। তবুও পরকালে পুরষ্কারের আশায় হাজার প্রতিকূলতা পায়ে ঠেলে রমযান মাসকে আপন করে নিয়েছে মুসলমানেরা।
প্রথম রোযায় বাদ যোহর মাদরাসার যাবার নিয়তে বাসা থেকে বের হই। প্রচণ্ড রোদ৷ গরমটাও সহ্য করার মতো ছিল না। মনে হয়েছিল রোদের তাপ শরীরের সমস্ত পানি চুষে নিয়েছে। মহাসড়কের পাশে দাঁড়ালাম একটা রিকশার আশায়। দুমিনিট দাঁড়াতেই ঘামে যবুথবু হওয়ার অবস্থা।
একটা রিকশা এসে সামনে দাঁড়ালো। রিকশায় ওঠতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ালাম। ডান পা রিকশায় আর বাম পা মাটিতে। রিকশাওয়ালার দিকে তাকাতেই ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ৭০-৮০ বছরের বৃদ্ধ। গায়ে হুশিয়ারীর পাতলা একটি গেঞ্জি। ঘামে শরীরের সঙ্গে লেগে আছে। চেহারাটা রোদে পুড়ে গেছে। ললাটে হতাশার ছাঁপ।
— কীরে বাজান যাবেন না? আমায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
— বাবাজি আপনি রোযা রেখেছেন?
— জ্বি বাজান
— আপনার এই অবস্থায় কীভাবে রিকশায় উঠি! এটা সম্ভব না বাবাজি
— বাজান ওঠেন! নইলে ইফতার করমু কেমনে?
ততোক্ষণে রিকশা থেকে পা নামিয়ে নিয়েছি। কিন্তু ভাবলাম— আমরা মুরব্বী দেখে যদি তাদের রিকশায় না উঠি, তাহলে বেচারা চলবেন কী করে? প্রয়োজনে ভাড়া কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবো। তাঁদের মতো মানুষ কম দুঃখে রিকশা নিয়ে নামেননি।
এবার রিকশায় চড়ে বসলাম।
— বাবাজি আপনি এই বয়সে রিকশা চালাচ্ছেন কেন? বড় ছেলে-পেলে নাই?
— যদি বলি নাই তাহলে আল্লাহ রাগ করবেন; আছে, তবে না থাকার মতো।
— কী বলেন? তারা জানে আপনি এই বয়সে রিকশা চালান?
— শুধু জানে না, দেখেও। কিন্তু কোনো খবর নেয় না। এই বলে রিকশার প্যাডেল মারা বন্ধ করে, কোমরের গামছা খুলে চেহারা মুছে নিলেন তিনি, সঙ্গে চোখও। অনুভব করলাম তিনি কাঁদছেন।
গন্তব্যের আগেই নেমে গেলাম। বৃদ্ধের কষ্টটা নিতে পারছিলাম না। রিকশা থেকে নেমে আমার সাধ্য অনুযায়ী ভাড়া থেকে বাড়িয়ে দিলাম। এবার তিনি সজোরেই কেঁদে ফেললেন!
— বাজান আপনাকে আমি চিনি না, আপনি ইট্টু মাইনসেরে কইবেন, তারা যেন মা-বাপের খোঁজখবর নেয়। আর বড়লোকেরা যেনো গরীবগো খবর নেয়। এই রমযানে আমাগো ভাড়া-টারা ইট্টু বাড়াইয়া দেয়। চোখের সামনে দিয়া শত শত টাকার ইফতার কিন্না নিয়া যায়, কিন্তু আমাগো ভাড়া দেওয়ার সময় যুদ্ধ শুরু কইরা দেয়। মাঝে মাঝে তাদের ইফতারী আর অপচয়ের দিকে তাকাইয়া কান্দি আমরা।
একটু জিরিয়ে আবার বলতে শুরু করেন তিনি— বড়লোকেরা আমাগো জিগায় না। তারা যদি আমাগো ইট্টু খোঁজখবর নিত, তাইলে আমাগো আর কোনো কষ্ট থাকত না। অনেক পেসেঞ্জার আছে, যারা টানতে পারি না দেইখা আমার মতো বুড়ার রিকশায় ওঠে না। আচ্ছা বাজান, এইভাবে আমাদের অবহেলা করলে কই যামু কন? ছেলেরা খবর লয় না, রিকশা লইয়া নামছি, এখন পেসেঞ্জারও পাশ কাইটা যায়। আমাগো কী উপায় হইবে? তরুতরকারীর যেই দাম, তাতে সারাদিন রিকশা চালাইয়া জমা দিয়া ভালোমন্দ খাওয়ার মতো টাকা থাকে না। সবাই যদি অন্তত এই রমযানে আমাগো ভাড়াটা বাড়াইয়া দেয়, তাহলে এত কষ্ট থাকবে না।
আসুন! রমযানে গরীব, দিনমজুর ও মেহনতী মানুষের পাশে দাঁড়াই। নিজের আনন্দ ভাগাভাগি করি তাদের সঙ্গে। তারাও আমাদের ভাই, বাবা কিংবা প্রতিবেশী।