

কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড “আল হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের” কেন্দ্রীয় দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা শেষ হয়েছে আজ। এ বছরের প্রথমবারের পরীক্ষা বাতিল হওয়ার পর ২৩ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় ফের পরীক্ষা শুরু হয়ে মাঝখানের দুটি পরীক্ষা বাতিল করে শেষ পর্যন্ত আজ (৩ এপ্রিল) এ বছরের পরীক্ষা কার্যক্রম শেষ হলো। বাতল হওয়া পরীক্ষা নতুন রুটিনে নেওয়া হয়েছে। দু দফা প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ আসার সাথে সাথেই তরিৎ ব্যবস্থায় পরীক্ষা বাতিল করে হাইয়াতুল উলইয়া কর্তৃপক্ষ প্রশংসিত হলেও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিলো পরীক্ষা বিষয়ে। কিন্তু হাইয়াতুল উলয়ার কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলদের মধ্যে তারুণ্যদীপ্ত নেতাদের কিছু যুগোপযোগী কার্যক্রমের কারণে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা বিষয়ে ভিন্ন নজির স্থাপন করে প্রশংসিত হয়েছেন তারা।
এর মধ্যে প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে প্রযুক্তি ব্যবহার করে কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষার কেন্দ্রগুলোতে প্রশ্নপত্র দেওয়ার বিষয়টি প্রশংসিত হয়েছে সর্বমহলে। শুরুতে অনেকেই কিছুটা নেতিবাচক অবস্থানে থাকলেও শেষ পর্যন্ত এটাকেই সবাই সুন্দর ব্যাবস্থাপনা হিসরবে মেনে নিয়েছে। পরীক্ষা শুরু হওয়া আগে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ‘হোয়াটসঅ্যাপে’ প্রশ্নপত্রের কপি পাঠিয়ে তা সাথে সাথে প্রিন্ট করে পরীক্ষার্থীদের মাঝে দেওয়ার মাধ্যমে প্রশ্নফাঁসের সকল পথ-পন্থাই আটকে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রশ্নপত্র বিতরণের প্রক্রিয়াটি ছিলো;
“পরীক্ষার দিন সকালে একজন প্রশ্ন তৈরির কাজ শুরু করেন। কাজ শেষ করে ৮ টা ১৫ মিনিটে অন্য একজনকে প্রশ্নটি কম্পোজ করার জন্য সংরক্ষিত রুমের ভেতরে প্রবেশ করেন। সে হিসেবে ৮ টা ১৫ মিনিটের আগ পর্যন্ত প্রশ্নের বিষয়ে একজন ব্যক্তিই জানেন আর তার পর ৯ টা পর্যন্ত মাত্র দুজন ব্যক্তি প্রশ্ন সম্পর্কে জেনে থাকেন। এরপর ৯ টার সময় ওই দুজনের দায়িত্ব সদ্য কম্পোজ করা প্রশ্নটি মাওলানা উসামা আমিন কর্তৃক কম্পিউটার থেকে ফোনে নিয়ে সাথে সাথে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পোস্ট করে সারাদেশে সবার কাছে পৌছে দেওয়া হয়। এভাবে সব প্রক্রিয়ায় সকাল ৯ টার আগ পর্যন্ত মাত্র দুজন জন ব্যক্তি এই কাজে সংশ্লিষ্ট থাকেন এবং মোট চার জনে কাজ করেন। সবমিলিয়ে প্রশ্নপত্রের বিষয়ে এই চারজনই সবকিছু জানতেন তাও পরীক্ষা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে। অপরদিকে সেই গ্রুপ থেকে প্রশ্নপত্র নিয়ে হলেই প্রিন্ট করে পরীক্ষার্থীদের দেওয়া হয় এবং ১০ টায় পরীক্ষা আরম্ভ হলে ৯ টার পর কোনো ছাত্র ‘হলে’ প্রবেশ নিষেধ করা হয়ে থাকে”
পরীক্ষার সার্বিক বিষয়ে পাবলিক ভয়েসের সাথে কথা হয়েছে হাইয়াতুল উলইয়ার প্রতিনিধি সদস্য ও প্রশ্নফাঁস বিষয়ে তদন্ত কমিটির দায়িত্বে থাকা মাওলানা উসামা আমীনের সাথে। তিনি হাইয়াতুল উলইয়ার পরীক্ষা বিষয়ে বলেন, “আমরা কোনোরুপ ঝামেলা বা কোনো মাদরাসায় সমস্যা ছাড়াই হাইয়াতুল উলইয়ার কেন্দ্রীয় পরীক্ষা শেষ করতে পেরে শোকরিয়া আদায় করছি এবং আমাদের সার্বিক কার্যক্রম সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি”
‘দু দফা প্রশ্নফাঁসের অভিযোগের পর হাইয়াতুল উলয়ার ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে কী না’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছুটা চাঁপে তো আমরা পড়েছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা সে সমস্যা কাঁটিয়ে উঠতে পেরেছি। প্রযুক্তি ব্যবহার করে সম্পূর্ণ ভিন্ন নিয়মে নতুনভাবে পরীক্ষা নিয়ে আমরা আরও বেশি প্রশংসা অর্জন করতে পেরেছি এবং ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও মুরুব্বীদের সার্বিক আস্থা অর্জন করতে পেরেছি বলেই মনে করছি”।
‘সারাদেশে কোনো মাদরাসা বা হাইয়াতুল উলয়ার সঙ্গে থাকা কোনো বোর্ড পরীক্ষা বিষয়ে হাইয়ার বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না” জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত সারাদেশে কোনো বোর্ড, কোন মাদরাসা হাইয়াতুল উলইয়ার সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যায়নি বরং সবাই হাইয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ম শৃঙ্খলার সাথে পরীক্ষা কার্যক্রমে সমৃক্ত হয়েছে, বড় বড় মাদরানাগুলো তো বটেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের মাদরাসাগুলোও স্বতস্ফূর্তভাবে প্রযুক্তির ব্যবহারে পরীক্ষা নিয়েছে”।
“প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠা ও প্রশ্নফাঁস বিষয়ে সার্বিক তদন্তের অগ্রগতি কতটুকু” জানতে চাইলে মাওলানা উসামা বলেন, “আমরা সর্বোচ্চ তদন্ত করছি এবং তদন্তের অগ্রগতিও অনেকটাই সন্তোষজনক, খুব শীগ্রই আমরা প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত সবাইকে বের করে এ বিষয়ে কঠোর থেকে কঠোর সিদ্ধান্ত নেবো”। তাছাড়া প্রশ্নফাঁস বিষয়ে হাইয়াতুল উলয়ার সকল নেতৃবৃন্দই একমত এবং কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। বিশেষ করে হাইয়াতুল উলয়ার চেয়ারম্যান আল্লামা আহমদ শফীও এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। প্রশ্নফাঁসকারী যে-ই হোক না কেন তাকে বের করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে বলেই সবাই একমত রয়েছেন। কওমী মাদরাসায় প্রশ্নফাঁসের কলঙ্ক নেই তাই যারা এ বছর এমন গর্হিত কাজ করেছে তাদেরকে শাস্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন কর্ হবে বলেও হাইয়াতুল উলয়ার পক্ষ থেকে মতামত দিয়েছেন তিনি।
“আগামী বছরগুলোতে কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড হাইয়াতুল উলয়ার পরীক্ষা হবে সারাদেশব্যাপী মডেল পরীক্ষা এবং আমরা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারবো” যোগ করে তিনি বলেন, “কওমী মাদরাসা শিক্ষা সনদের সরকারী স্বীকৃতি সংসদে পাশ হওয়ার পর এবারই প্রথম হাইয়াতুল উলয়ার পরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু এর আগেও হাইয়াতুল উলয়ার দুটি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের সামনে আগামী বছরের পরীক্ষা বিষয়ে লম্বা সময় রয়েছে। আমরা সেভাবেই প্রস্তুতি নেবো এবং বিশৃঙ্খলা ও প্রশ্নফাঁসমুক্ত পরীক্ষা সম্পন্ন করার জন্য সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। এ বছর প্রাথমিকভাবে কিছুটা হোচট খেলেও শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা আমরা ভালোভাবেই সম্পন্ন করতে পেরেছি এবং আগামী বছরগুলোতে হাইয়াতুল উলয়ার পরীক্ষা হবে সারাদেশব্যাপী মডেল শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা। এবং তেমন প্রস্তুতি আমরা নিতে চাচ্ছি।
প্রসঙ্গত : কওমী মাদরাসা শিক্ষার সর্বোচ্চস্থর দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি দেওয়ার পর কওমী মাদরাসার দাওরায়ে হাদীসের সকল বোর্ডগুলো একত্রিত করে আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমীয়া নামে বোর্ড গঠন করা হয়। যে বোর্ডের অধিনে এ বছরই প্রথমবারের মতো দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমবার পরীক্ষা চলাচালিন চারটি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর প্রশ্নফাঁসের সংবাদ প্রকাশ হয় এবং সকল পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তখন কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের ফযিলত বিভাগেরও প্রশ্নফাঁস হয় এবং পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা করা হয়। এরপর ২৩ এপ্রিল নতুন করে উভয় বোর্ডেরই পরীক্ষা শুরু হওয়ার দুইদিন পর আবারও দাওরায়ে হাদিসের প্রশ্নফাঁসের ঘটনা প্রকাশ হয় এবং ২৫ এপ্রিলের পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা করা হয়। শেষ পর্যন্ত নতুন রুটিনে ওই ধারাবাহিকতায় কিছুটা পরিবর্তন করে পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় এবং আজ ৩ এপ্রিল পরীক্ষা শেষ করা হয়।
উল্লেখ্য, কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের প্রথমবারের পরীক্ষা ৮ এপ্রিল শুরু হয়েছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৮ এপ্রিল। পরবর্তিতে নতুন রুটিনে ২৩ এপ্রিল থেকে পরীক্ষা শুরু হয়ে ৩ মে পর্যন্ত পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ করা হয়। আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীনে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ৬টি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে মোট ২৬ হাজার ৭২১ জন শিক্ষার্থী এ বছর পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন।
হাইয়াতুল উলইয়ার অধীনে ৬টি শিক্ষা বোর্ড হলো- বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া গওহরডাঙ্গা বাংলাদেশ, আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ, আজাদ দ্বীনি এদারায়ে তালিম বাংলাদেশ, তানজিমুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়া বাংলাদেশ এবং জাতীয় দ্বীনি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড।
এর আগে জাতীয় সংসদের ২২তম অধিবেশনে ১৯ সেপ্টেম্বর ‘কওমি মাদরাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিস (তাকমিল)-এর সনদকে আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর অধীনে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান বিল ২০১৮’ পাস হয়।
©এইচআরআর/পাবলিক ভয়েস