

সামছ্ আল ইসলাম ভূঁইয়া
আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’র দাওরায়ে হাদিসের প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে বোর্ডের আলেমরা বিস্ময় প্রকাশ করেন। এবং দায় স্বীকার করে নৈতিকতা ও সত্যমানসিকতার পরিচয়ও দিয়েছেন। যা শিক্ষা মন্ত্রনালয় দেখাতে পারেনি কখনো।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। যে জাতির মেরুদণ্ডের ভিত যত বেশি মজবুত, সে জাতি ততো বেশি উন্নত। শিক্ষা মানুষের নৈতিক ও আত্মিক শক্তি জোগায়। শিক্ষা মানুষকে নৈতিক, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক হওয়ার শিক্ষা দেয়।
শিক্ষিত মানুষই দেশ-জাতির নেতৃত্ব দেয়। অথচ শিক্ষার মতো একটি মৌলিক বিষয় এখন বাংলাদেশে বিপর্যস্ত। প্রশ্নফাঁসের সমস্যায় জর্জরিত আমাদের পরীক্ষাব্যবস্থা। আকাশ-সংস্কৃতির কল্যাণে (!) পরীক্ষার প্রশ্ন আজ ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, যা আমাদের জাতীয় জীবনে গভীর অন্ধকার বয়ে আনছে। এটা বাংলাদেশের জন্য এক অশানিসংকেত।
পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নপত্রের সমাধান করে পরীক্ষা দেয়া- এ কেমন সংস্কৃতি শুরু হল দেশে? মন্ত্রী-এমপি-দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাই প্রশ্ন ফাঁস সম্পর্কে অবগত আছেন। কিন্তু অস্বীকার করে আসছেন বিষয়টি। তার সাথে এবার যোগ হলো কওমি মাদরাসাগুলোর সরকারি বোর্ড “আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়ার” প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা।
প্রশ্নফাঁস হওয়ায় গত ১২ এপ্রিল শনিবার এক জরুরি বৈঠক করে কওমি মাদরাসাগুলোর সরকারি বোর্ড আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষা বাতিল করেছিল। তখন বলা হয়েছিল দাওরায়ে হাদিসের (মাস্টার্স সমমান) বিগত কয়েকটি পরীক্ষায় ফরিদাবাদ মাদরাসাসহ দেশে কয়েকটি স্থানে প্রশ্ন ফাঁসের খবর পাওয়া যায়। এর পরই জরুরি সভা করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই বৈঠকে বেফাকের মেশকাতের (ফজিলত) কেন্দ্রীয় পরীক্ষাও বাতিল করা হয়েছে। ২৩ এপ্রিল থেকে আবার পরীক্ষা শুরু করার সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
দ্বিতীয় দফা পরিক্ষায়ও দাওরায়ে হাদিসের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে ২৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার আবু দাউদ শরিফের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’র দাওরায়ে হাদিসের প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে বোর্ডের আলেমরা বিস্ময় প্রকাশ করেন। এবং দায় স্বীকার করে নৈতিকতা ও সত্যমানসিকতার পরিচয়ও দিয়েছেন। যা শিক্ষা মন্ত্রনালয় দেখাতে পারেনি কখনও।
আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ পরবর্তীতে তা প্রতিরোধ করতে নতুন করে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। একইসঙ্গে প্রশ্নপত্র পরিবহন, কেন্দ্রে কেন্দ্রে নেয়া, বিশেষ তালার ব্যবস্থা করা, তালার চাবি সুনির্দিষ্ট এক থেকে দুজনের কাছে রাখার বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেন বোর্ডের কর্তা আলেমরা। অনুসন্ধানের মাধ্যমে খুঁজে বের করেন প্রশ্ন ফাঁসের সূত্র ও জড়িতদের। এই সবগুলোই ছিল প্রশংসার দাবিদার।
আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীনে দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষায় ছয়টি শিক্ষাবোর্ডের ২৬ হাজার ৭২১ জন পরিক্ষার্থী আশার আলো দেখেছিলেন। নৈতিকতা ও আত্মিক বিপর্যয় থেকে উত্তরণের পথ পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় বারের পরিক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় তারা আশাহত ও বিভ্রান্ত হয়েছেন। সনদের সরকারি স্বীকৃতি পাওয়ার পর প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হওয়া পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দুই বার ফাঁস হওয়ায় বড় ধরনের হোঁচট খেল প্রতিষ্ঠানটি।
২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমি শিক্ষা সনদের মান ঘোষণা করার পর হাইআতুল উলইয়া অধীনে ৬ বোর্ডের সম্মিলিত দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা ইতোপূর্বে দুই বার (১৬-১৭ ও ১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ) অনুষ্ঠিত হয়েছে। কওমি মাদরাসাগুলোর সরকারি বোর্ডের নানা উদ্যোগের পরও ঠেকানো যাচ্ছে না প্রশ্ন ফাঁস। এক্ষেত্রে অপরিকল্পিত ভাবে ৬টি বোর্ডের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গড়ে তুলাই দায়ী।
কওমি মাদরাসাগুলোর সরকারি বোর্ড আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে সরকারি সুযোগ সুবিধা ছাড়াই। কওমি মাদ্রাসার সরকারি বোর্ডের দায়িত্বে রয়েছে ৬টি বোর্ডের আলেমরা। নেই কোনো অভিজ্ঞ কর্মকর্তা কর্মচারী। যেখানে সরকারি অন্যান্য বোর্ডের প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী, ছাপার কাজে যুক্ত, প্রশ্নের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এবং বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবহন ও বিতরণের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১০ হাজার মানুষ জড়িত রয়েছেন। নিজেস্ব প্রেস ও পরিবহন রয়েছে। সেখানে কওমি মাদ্রাসার সরকারি বোর্ডের নেই কিছু।
অন্যান্য সরকারি বোর্ডে যারা কাজ করেন তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে রাখা হয়। আবার বোর্ড থেকে বেরিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারে। আর কওমি মাদ্রাসার সরকারি বোর্ডের সবাই বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের দায়িত্বে আছেন। যারা পরিক্ষার তদারকি করেন তারা তো আছেই। এতো সতর্কতা অবলম্বন করার পরেও যেখানে অন্যান্য সরকারি বোর্ডের প্রশ্নফাঁস নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না সেখানে এতো সমস্যা নিয়ে কওমি বোর্ড কিভাবে পারবে? প্রথমবারের প্রশ্ন ফাঁসে যিনি জড়িত ছিলেন তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছিলেন।
পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে ধারা শুরু হয়েছে তা বন্ধ করতে হবে। প্রশ্ন প্রণয়নকারি যারা থাকবেন তারা যেনো অবশ্যই কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত না থাকেন এবং প্রশ্ন সম্পর্কে বোর্ডের পরিক্ষা নিয়ন্ত্রক ও মহাসচিব ছাড়া আর কেউ যেন না দেখেন সে ব্যবস্থা করতে হবে। (১) নিজস্ব প্রেসেই প্রশ্ন কম্পোজ, এডিট, প্রিন্ট ও প্যাকেজিং সম্পন্ন করা। (২) প্রেসের কর্মকর্তা-কর্মচারী যাতে প্রশ্ন সংরক্ষণ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা। (৩) প্রেস থেকে প্রশ্ন গ্রহণ করে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছানোর জন্য নিজেদের লোকজন সহ পরিবহন প্রেরণ করা। এসব বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। (৪) কেন্দ্রে কর্মকর্তারা যথাযথ ভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। ফলে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা থাকেই। তাই প্রতিটি পরিক্ষা কেন্দ্রে একজন করে বোর্ডের কর্মকর্তা থাকা। যার মাধ্যমে প্রশ্ন বন্টন হবে। (৫) পরিক্ষা কেন্দ্রে ৩০ মিনিটের পূর্বে কোনওমতে প্রশ্নপত্র না খোলা। (৬) এরপরও যদি কেউ প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত থাকে তাকে বোর্ড ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করার আইন করতে হবে।
এজাতীয় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে অন্তত প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করা দরকার। দেশের মানুষ ইতিমধ্যেই দেশের শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে হতাশ। তার সাথে কওমি মাদ্রাসার সরকারি বোর্ডের প্রশ্ন ফাঁসে মানুষ আশাহত মর্মাহত। এ ধারা চলতে থাকলে মানুষের আস্থা আর ভালবাসা হারাবেন জাতির সেরেতাজ আলেম সমাজ।
-লেখকঃ গবেষক ও রাজনৈতিক কর্মী