

সাহাব উদ্দিন ফাহিম:
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় জাতির জন্য আর্শীবাদ। ১৯৭১ সালের ১৬-ই ডিসেম্বর বিজয়ের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতার সোনালী স্বাধ পাই। ৩০ লক্ষ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও ২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এ স্বাধীনতা। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিপ্লবী নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতার উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে প্রাণের বাংলাদেশ অর্জন করি। সেদিন থেকে আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখি, কিন্তু স্বার্থান্বেষী এই দেশের বিপদগামী কিছু সেনা সদস্য ও এক সময়ে বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন হিসাবে পরিচিত ব্যক্তিদের রক্তচক্ষুর আঘাতে নির্মমভাবে স্বপরিবারে তাঁকে হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি সাম্প্রদায়িক ভাবধারায় নবরুপে গড়ে তুলে এই বাংলার পরাজিত শক্তি। যার দরুন ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলার সূর্য সন্তান বীরমুক্তিযোদ্ধারা নানাভাবে অবহেলিত ও বঞ্চিত হতে থাকে। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের পরিচয় গোপন রাখতেও বাধ্য হয়েছিল।
১৯৯৬ সালে যখন শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রদান, তাঁদের পরিবার ও সন্তানদের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মপন্থা হাতে নেন। বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর এই সময়েও ক্ষমতায় আছেন মুক্তিযুদ্ধপ্রেমী দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ নেত্রী শেখ হাসিনা।
এই সময়েও সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে ও তাঁদের পরিবারের জন্য বিভিন্ন কর্মপন্থা অব্যাহত রাখে। যেমন- মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বৃদ্ধি, কোটা প্রদান, মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা গার্ড অফ অনার প্রদান ইত্যাদি।
বর্তমান যুগ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যুগ। তবে দুঃখের বিষয় এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে আমাদের দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী বিভিন্ন অপকর্ম করছে। ক্ষমতাসীন সরকারের অনেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তাঁদের একান্ত আদর্শ হিসাবে রাজনীতি করছে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি সবদলের আদর্শের অংশ হওয়া উচিত ছিলো। ক্ষমতাসীন দলের অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারকে কোনঠাসা করে রাখছে!
আমার নিজবাড়ি মীরসরাই ৪নং ধুম ইউনিয়ন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার, সদ্যসাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী জননেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের এলাকায়। আমার বাবা চাচারা উনার নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের উপজেলা ভিত্তিক সবচেয়ে বেশি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে মীরসরাই এলাকার জনগন। কিন্তু আমরা এখনো অবাক হই, সরকারের এত সুযোগ সুবিধা থাকার পরও আমাদের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও তাঁদের পরিবার বিভিন্নভাবে অবহেলিত ও বঞ্চিত!
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতির সংস্কৃতিতে এখনও আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদেরকে উপস্থাপনের কার্যকর সুযোগ পাচ্ছে না। নেত্রীর ঘোষনা থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাধিকারমূলক অবস্থান দিতে নারাজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতির ধারক ও বাহকরা! এখনো দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম হতে হয়: মুক্তিযোদ্ধাকে কুপিয়ে জখম, মুক্তিযোদ্ধার পরিবার লাঞ্ছিত, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে হত্যা । এছাড়াও আলোচিত বিষয় হচ্ছে: মৃত্যৃর আগে তারামন বিবির গেজেট হয়নি, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের ছেলে রিক্সাচালক, রাস্তাঘাটে দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের ভিক্ষা করতে হচ্ছে এসব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতিতে মুক্তিযোদ্ধারা লাঞ্ছিত হলে চেতনার রাজনীতির দরকার আছে কি?
সাম্প্রতিক সময়ে সাধারণ ছাত্রদের “কোটা সংস্কার চাই” আন্দোলনকে রাজনীতিকরণ করে সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে মুখোমুখি দাড় করিয়েছে। এক্ষেত্রে অনেকটা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীতে পরিনত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার পরিবার। অনেকে অতি উৎসাহী হয়ে প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন ও ব্যানারে নিজেকে রাজাকার হিসাবে উপস্থাপন করেছে, যা জাতির জন্য অভিশাপ! বিশাল জনগোষ্ঠীর ব্যাপক বেকারের স্রোত ঠেকানোর দায়িত্ব রাষ্টের। কোটা যদি সর্বক্ষেত্রে পূরণ না হয় সেটা সংস্কার আনায়নের বিপক্ষে আমি নই তবে সংস্কারের রাজনীতির আঘাতে কোটা বাতিল করে মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সাথে বিমাতাসূলভ আচারণ উচিত হয়েছে কি?
আমাদের বাপ চাচারা কোন উদ্দেশ্যের জন্য যুদ্ধে যায়নি, রাষ্ট্রযন্ত্র যদি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে কিছু প্রদান করতে ইচ্ছুক থাকে সেটা গ্রহণের অধিকার অবশ্যই আমরা রাখি। সেক্ষেত্রে তাদের কোনঠাসা করে ফেলা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা।
পরিশেষে, এইটুকু বলবো মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের উপর নির্মিত বাংলাদেশ যেন জাতির সূর্য সন্তানদের ভুলে না যায়। সকল রাজনৈতিক দলের মৌলিক উদ্দেশ্য যেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকে তাহলেই আমাদের মুক্তিযোদ্ধা বাবার আত্মা শান্তি পাবে। ধন্যবাদ প্রিয় মাতৃভূমির সকল বিবেচক মানুষদের।
লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[মতামত কলামে প্রকাশিত যে কোনো লেখার দায় একান্ত লেখকের নিজের]