নুসরাত যা পেলো ; আমরা যা চাই

প্রকাশিত: ৮:৩৬ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ২১, ২০১৯
  • মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নুসরাত এক অমরত্ব পেয়েছে। জানিয়েছে এ জাতির অধঃপতনের মাত্রা
  • আমরা চাই বিচার হোক নুসরাত হত্যাকারীদের। কেবল বিচার নয়_বিচারের প্রয়োগ হোক

মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষের এক জীবনের ইতি টানে। যারা এখানে বেঁচে থাকে, তারা তার স্মৃতি আওড়ায়। কিছু মৃত্যু আছে যা সহজে কেউ ভুলে না। মানুষটা সবার আপন হয়ে উঠে। এমনি একজন ছিলেন নুসরাত জাহান রাফি। মাত্র ১৮ বৎসরের একটি মেয়ে। আলিম (ইন্টারমিডিয়েট) পরীক্ষার্থী। আর সবার মতো সেও গিয়েছিল কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করতে। সহপাঠীরা পরীক্ষা দিচ্ছে। তাঁর আসনটি ফাঁকা। কেউ বসে নাই।

আমি একটি প্রাইভেট কারে থাকা সিগারেট ধরায় এমন ডিভাইসে কৌতুহলবশত হাত দিয়েছিলাম, গরমটা পরীক্ষা করার জন্য। আঙুল পুড়ে সাথে সাথে চামড়ায় ফোস্কা। কয়েকদিন যন্ত্রণা ভোগ করেছি। আর পুরো শরীরটা এমনভাবে পুড়ে দগ্ধ হলো, এতে যে কি পরিমান কষ্ট-যন্ত্রণা পেল মেয়েটি! উফ্ ভাবা যায়! ময়না তদন্তের সময় পাশে থাকা এক কাজিন সিস্টার ঢাবি ছাত্রী ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, তা যে পড়বে সে কাঁদবে। মেয়েটার মুখের সামনের অংশ, মাথা আর পায়ের কয়েকটা আঙ্গুল ছিল বিনা পোড়ায়। শরীরের সব অংশই ছিল দগ্ধ।

একফোঁটা পানির জন্য কত আকুতি! বাবাকে বলছিলো, ডাক্তারকে না জানিয়ে চুরি করে দু ফোঁটা পানি জিহ্বায় দিতে!

তাঁকে যারা এমনটা করেছে তারাও মানুষ! কিন্তু কতটা নৃশংস! ঐ অধ্যক্ষ একটা যৌন বিকৃতকামী। কিসের আলেম সে? সে একটা রেপিস্ট ও দাগী চোর। যা এখন সবাই জানছে। আগে দু মাদ্রাসায়ও সে যৌন কেলেঙ্কারির নায়ক। অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তো ডালভাত। এখানেও সে এ কাজ করেছে। কয়েকবার জেলও খেটেছে।

তাঁর রুমে একজনের অধিক ছাত্রীর প্রবেশাধিকার ছিল না। এখানেই ছিল তাঁর শয়তানি। এ ধরনের নিয়ম চালুর পর তা সবাই মেনে নিয়েছিলো। মেয়েরা তো লজ্জাশীলা। অধ্যক্ষের লুচ্চামির জন্য তাকে ঘৃণা করতো, কিন্তু মুখ ফুটে বলতো না। নুসরাত বলেছে। প্রতিবাদ করে বসে ছিল না। মামলা ঠুকে দিয়েছে। নিজের ইজ্জত আব্রু নিজেকেই রক্ষা করতে হবে। তাই কারো হুমকি ধমকির পরোয়া করে নাই। নুসরাতের এ অনমনীয় মনোভাব তাদের সহ্য হয়নি।

আসলে সে তো জেলখানা ফেরত অপরাধী। এরা ডেঞ্জারাস হয়। কারণ, যে একবার জেলখানায় যায়, তাঁর কিন্তু লজ্জা থাকে না। বরং ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। খুনী সিরাজও তাই। পোষাক পরতে হয় তাই পাঞ্জাবি টুপি পরে। সুন্নাত হিসেবে নয়। নিজ মেয়ের বয়সি ছাত্রীদের গায়ে যে হাত দেয় সে তো একটা বিরাট চরিত্রহীন। অমানুষ। এমন চরিত্রহীনকে যারা আস্কারা দিয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে তারাই মূলতঃ নুসরতের খুনী।

সোনাগাজীর ঐ মাদ্রাসার অধিকাংশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে খুনের কাজে সহযোগিতা করেছে। বিশেষ করে পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা। যারা ছিল অর্থলোভী। যারা সরকারী দলের স্থানীয় পান্ডা। তাদেরকে সিরাজ টাকা দিতো, তাও মাদ্রাসার ফান্ড থেকে, নিজ থেকে নয়। তাঁদের নেতৃত্বে সিরাজের পক্ষে মিছিল হয়েছে, মানব বন্ধন করেছে।

আগুন লাগিয়ে মারার ব্যাপারটা ছিল প্রি-প্লান। না হলে তার ভাইকে কেন ঢুকতে দেয়নি? নুসরাতের সাথে শ্লীলতাহানির মামলায় আটক হওয়ায় বিক্ষুব্ধ হয়ে সে এ কাজটা করেছিল কোন ভরসায়?

একটা খুন করতে অনেক রিস্ক। হ্যাঁ তার ভরসা ছিল, ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা, প্রশাসন ও আজ্ঞাবহ ছাত্র ক্যাডাররা তাকে রক্ষা করবে। নিজে জেলখানায়, এমতাবস্থায় খুন করার ঝুঁকি তো নিরাপদই- এমনটা ভাবছিলো সিরাজুদ্দৌলা। কত বড় ধূর্ত! ধরা পড়লে ওরা পড়বে, যারা কেরোসিন দিয়ে আগুন দিয়েছিলো। সে আদালতে দেখাতে পারবে তখন তিনি জেলখানায় ছিলেন।

কিন্তু আল্লাহ তাকে রক্ষা করে নাই, বাকীটুকুও করবে না। ইনশাআল্লাহ ফাঁসীতে ঝুলতে হবে। আমরা সে আশাটুকুই করছি।

মেয়েটার জন্য পুরো বাংলাদেশে শোকাবহ অবস্থা। সবার একটি করে বোনের নাম নুসরাত। তাঁর মৃত্যুতে বোন হারানোর মতই সবাই শোকে আচ্ছন্ন। শুধু ফেসবুক নয়, পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলোতেও ভাইরাল।

আমরা তার পরিবারের কান্না দেখেছি। দেখেছি দগ্ধ হওয়া তার লাশ আনতে গিয়ে ভাইদের আকুতি। ফেসবুকে তার ছোট ভাইর আবেগঘন স্টাটাস দেখে কেঁদেছে অনেকেই। আপন ছোট ভাই যখন লিখে “ঘরে ঢুকে আপুর রুম ফাঁকা দেখে কলিজায় আঘাত লাগে” তখন সবার হৃদয়-মন আনচান করে উঠে। তবে দেশবাসীর প্রতিবাদের প্রতি তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায়ও তারা কৃতজ্ঞ হয়েছে। নিজ বোনের আমরত্ব লাভে তারা কিছুটা হলেও স্বাভাবিক থাকতে পেরেছে। তবে তাদেরও চাওয়া কঠোর বিচার। অন্তত নুসরাতের দেহ জ্বালিয়ে আঙ্গার করে দেওয়া কোনো কুলাঙ্গার ছাড়া না পাক বরং ফাঁসির দড়িই হোক তাদের ঠিকানা এটুকু তাদেরও হৃদয় আকুতি। কেবল তাদেরই নয় বরং সবারই।

মেয়েটা যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে, সেটা সবাই পছন্দ করেছেন। প্রতিবাদ করার কারণে সে যে মৃত্যুপথযাত্রী, তাতে মানুষের ভালোবাসা আরো বেড়েছে। আর মারা যাওয়ার পর ভালবাসা ও শ্রদ্ধা বহু বহুগুণে বেড়েছে। ঠিক অনুরূপ পরিমাণ সিরাজ ও দোসরদের প্রতি ঘৃণা জমেছে।

দেশবাসীর এমন ভালবাসা, সম্মান ও দূর্বলতা অন্য কারো প্রতি কখনো হয়েছে কিনা জানি না। তার জানাযায় হাজার হাজার মানুষ যোগ দিয়েছে। তাঁরা কেঁদেছে।

এটাই নুসরাতের প্রাপ্তি। কিন্তু নিজ জীবনটা হায়েনাদের ছোবলে পড়ে বিলিয়ে দিয়ে, নিস্পাপ দেহটা আগুনে গলিয়ে দিয়ে……

লেখক, এক্টিভিস্ট, বিশ্লেষক

মন্তব্য করুন