শাইখ মাহমূদ হাসান
শত বছরের ইতিহাস- ঐতিহ্য নষ্ট করে কওমী অঙ্গনে বেফাক ও হাইয়ার প্রশ্ন ফাঁসের কারণে কওমী মাদরাসার দাওরায়ে হাদীস ( মাস্টার্স) ও মেশকাত জামাতের পরীক্ষা বাদে অন্যান্য সকল ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষা আজ শেষ হচ্ছে। কওমী অঙ্গনে আজকের বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে ১৪৩৯ ও ১৪৪০ হিজরী শিক্ষা বর্ষের সমাপ্তি ঘটেছে। মাদ্রাসাসমূহে প্রায় দু’মাসের ছুটি ঘোষিত হয়েছে বিধায় প্রত্যেক তালিবুল ইলম নিজ নিজ বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। এমনকি অনেকেই হয়তো ইতিমধ্যে রাস্তায় বা বাড়িতেই পৌঁছেছেন।
ছাত্র জীবনে মাদ্রাসা বন্ধের পর বাড়ি যাওয়ার আনন্দ সীমাহীন। স্টুডেন্ট লাইফের রুকসতে পিতা- মাতা ভাই-বোনের সাক্ষাত সময়ের সেরা উপহার। অবসরে বন্ধুদের সাথে দেয়া আড্ডার অনুভূতি সবকিছু থেকে ভিন্ন। বিশেষত প্রিয়দের সাথে বিকেলবেলা মাঠে খেলা করা সবসময়ই আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এই দীর্ঘ ছুটিতে কার কি হবে- তা কেউ জানিনা। জানিনা আবার ছাত্র ও উস্তাদের পরস্পর দেখা হবে কি না। ফলে ভাবনার জগতে অজানা আশঙ্খা বারবার উঁকি দেয়। দোলা দেয় মনে শত আশা-নিরাশা। এমনকি মাঝেমধ্যে মনে হয় যে, মরনও হয়তো আমাদের কারো সঙ্গী হতে পারে! এই ছুটিতে কবরই হয়তো কারো জন্য হবে শেষ ঠিকানা! বছর শেষে মাদরাসা থেকে বিদায় নেওয়া কখনো কারো জীবনে চির বিদায়ে পরিণত হয় বলে প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষা শেষে যখন প্রিয়দের ছেড়ে বাড়ির পথ ধরতে হয় তখন নিজের অজান্তে দু’চোখের অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।
বিদায় মুহূর্তে ভিষন্ন হয় দিল মন। হৃদয়ে জলে তখন তুষের আগুন। কলিজা পুড়ে বিদায় বিচ্ছেদের শোকে। ছাত্রজীবনে বিচ্ছেদের এই কষ্ট যতটা না অনুভব হতো তারচেয়ে বেশি অনুভব হচ্ছে উস্তাদজীবনে। আর ছাত্রজীবনে বিদায় দেওয়া ও নেওয়ার অনুভূতির চেয়ে বর্তমানে বিদায় বিরহের কষ্ট সীমাহীন। নিজের হাতে গড়া প্রিয় ছাত্ররা যখন বাড়ি যেতে বিদায় নিতে আসে তখন উস্তাদদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। ছাত্রদের বিদায় মুহূর্তে আসাতিযাদের অন্তরে দুঃখের বাতাস প্রবাহিত হয়। কারণ, কওমী মাদরাসায় শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্ক হল পিতাপুত্রের সম্পর্কে মত। মাদরাসার সীমানায় গুরু ও শিষ্যের সম্পর্ক হল প্রিয় দুজন বন্ধুর মত। আর দুই তালেবুল ইলমের পরস্পর যোগসূত্র হল সহোদর ভায়ের সম্পর্কের ন্যায়। রক্তের বন্ধন ছেড়ে যাওয়া যেমন কষ্টকর তেমন বেদনাদায়ক ছাত্র- উস্তাদের ক্ষণস্থায়ী বিচ্ছেদ। কওমী মাদরাসার সকল আসাতিযা তাদের ছাত্রদের মোহাব্বত করেন।
প্রত্যেক শিক্ষকই আপন ছাত্রদের অনেক বেশি ভালোবাসেন। আর ছাত্ররাও নিজেদের উস্তাদগণকে পিতার মত সম্মান করে। বিভিন্ন মাদরাসার তুলাবাগণ আপন উস্তাদগণকে নিজেদের সবটুকু দিয়ে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করে। এমনকি অধিকাংশ তুলাবা তো প্রিয় উস্তাদকে নিজের সারা জীবনের জন্য রাহবার হিসাবে গ্রহণ করে। কওমী মাদরাসার অনেক ছাত্র আপন তালিমে মুরুব্বীকে জীবন চলার পথে নিজের শেষ দিশারী মনে করে। এবং নিজের উস্তাদী যামানায় অনুসরণীয় উস্তাদের অনুকরণেই শিক্ষকতার জীবন কাটিয়ে দেয়।
তাই বিদায়ের এই দিনে কওমী অঙ্গনের সকল বিদায়ী প্রিয় ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে,
হে ক্ষণস্থায়ী বিদায়ী!
ও হে জাতীর রাহবার!
হে প্রিয় দ্বিনের দিশারী!
জীবন চলার পথে তুমি তোমার পিতৃতুল্য উস্তাদকে কখনো ভুলে যেয়োনা। যেখানে যেভাবেই তুমি থাকো, জীবনের অবসর সময়ে তুমি তোমার উস্তাদের খোঁজ-খবর নিয়ো। নিজের পিতাকে যেমন কখনো দূরে ঠেলে দেওয়া যায়না ঠিক রূহানী পিতাকেও তোমরা তোমাদের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়োনা। কারণ, তাঁরা তোমাকে ভালোবাসে। আর তুমি তাদেরকে। আমরা পরস্পর অনেক প্রিয় ও আপন। পরকালীন নাজাতের আশায় আল্লাহর ওয়াস্তে দু’জনই একে অপরকে সীমাহীন মোহাব্বত করা হয়।
আছে আমাদের মাঝে প্রকৃত বন্ধুত্ব ও সহোদর ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের নিসবতে আজ পনেরো বছরের আমরা এক কাফেলা। তাই মুসাফির হালতে খোদার দরবারে এই প্রার্থনা যে, তুমি যেখানেই যেভাবে থাকো যেন ভাল থাকো। সুখি হয় যেন তোমার ভবিষ্যত জিন্দেগানী। আর মৃত্যুর পর আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে জান্নাতে আবার মিলিত করেন- এপ্রত্যাশায় মকবুল মোনাজাতে তোমার উস্তাদকে তুমি ভুলোনা।
লেখক-
মুফতি ও নাযেমে দারুল ইকামা, জামিয়া আরাবিয়া শামসুল উলূম খিলাগাঁও ঢাকা।