কওমী মাদরাসার কেন্দ্রীয় পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস ; কী ভাবছে কওমী তরুণরা

প্রকাশিত: ১:৪০ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১৩, ২০১৯
কওমী মাদরাসার কেন্দ্রীয় পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস ; কী ভাবছে কওমী তরুণরা

বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’ ও কওমী মাদরাসা শিক্ষার সম্মিলিত শিক্ষাবোর্ড “আল হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়ার” কেন্দ্রীয় পরীক্ষা চলছে সারাদেশব্যাপী। কওমী শিক্ষা সনদের সরকারী স্বীকৃতি হওয়ার পর এটাই প্রথম পরীক্ষা চলছে মাদরাসাগুলোতে।

কওমী মাদরাসার পরীক্ষাব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে কিছু ভিন্ন ঐতিহ্য ধারণ করে আসছে। বিশেষ করে নকল ও প্রশ্নফাঁসমুক্ত পরীক্ষা হিসেবে কওমী মাদরাসার পরীক্ষার সুনাম রয়েছে ব্যাপক আকারে। কখনওই শোনা যায়নি কওমী মাদরাসার পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়েছে বা কোন নকল করেছে কোন পরীক্ষার্থী।

কিন্তু হঠাৎ করে ২০১৯ সালের এ কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় ব্যাপকহারে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিটি পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র চলে আসছে ফেসবুকে। কয়েকটি বিষয়ের প্রশ্ন পাবলিক ভয়েসের হাতেও এসেছে যেগুলো পরের দিন পরীক্ষার প্রশ্নের সাথে মিলিয়ে দেখা গেছে হুবহু মিলে যাচ্ছে। যা অনেকটাই উদ্বেগ হিসেবে দেখছেন সচেতনমহল।

এসব নিয়ে বেফাক ও হাইয়াতুল উলয়ার কয়েকজন উধ্বর্তন দায়িত্বশীলের সাথে যোগাযোগ করলে তারা এ বিষয়ে আপাতত কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি তবে শনিবার (১৩ এপ্রিল) বেফাক ও হাইয়াতুল উলয়ার জরুরী বৈঠক বসার কথা রয়েছে এবং কয়েকটি সূত্র থেকে জানা গেছে বৈঠকে এ বিষয়ে জরুরী আলোচনা হতে পারে।

শনিবার হাইয়াতুল উলইয়ার জরুরি বৈঠক : আলোচনা হতে পারে প্রশ্নপত্র ফাঁস বিষয়ে

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কওমী তরুণরা এ বিষয়ে পক্ষে বিপক্ষে বেশ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন।

পরিচিত লেখক ও কথাসাহিত্যিক, কওমী মাদরাসার ছাত্র সালাহউদ্দিন জাহাঙ্গীর লিখেছেন,

মনের মধ্যে অনেকদিন ধরে কথাটা ঘুর ঘুর করছিল, বলার ইচ্ছা হচ্ছিল না। আজকে ভাবলাম, কথাটা বলেই ফেলি—
কোনো মাদরাসার প্রিন্সিপ্যাল হয়ে বা দায়িত্বশীল শিক্ষক হয়ে সেই একই ব্যক্তি কীভাবে একটি শিক্ষাবোর্ডের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তা হন—এই জিনিসটা আমার বুঝে আসে না। একজন দুজন হলে সেটা অলংকারিক পদ হিসেবে থাকতে পারে, কিন্তু প্রশাসনিক প্রায় সকল পদে বিভিন্ন মাদরাসার দায়িত্বশীল শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি একটা হাস্যকর এবং অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। কেন? সেটা আপনারা ইতোমধ্যে নিশ্চয় অবগত হয়েছেন।

বলছি বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাক আর হাইয়ার কথা। বেফাকের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার বরাতে বিগত বছরখানেক আগে বেফাকের ভেতরে দুর্নীতির যে ধারার কথা শুনেছিলাম, মুরব্বিদের সম্ভ্রমের ভয়ে এবং আকাবিরের সম্মানহানির লজ্জায় সেগুলো কারো কাছে বলতেও পারিনি।
আজ দেখেন, সেই বিষবৃক্ষের ফল সারা দুনিয়ার সামনে চলে এসেছে। দুনিয়ার মানুষ কথা বলছে বেফাক আর হাইয়ার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে।

আমাদের যেসব ‘মুত্তাকি’ ভাই মাদরাসা সংশ্লিষ্ট এসব অনাচার বাইরের দুনিয়াকে জানাতে নাপছন্দ করেন, দেখেন তার ফল আজ কীভাবে প্রকাশ হলো সবার সামনে! কিছু বিষয়ে কখনো আপোস চলে না। যদি সব বিষয়ে আপোস করতে শুরু করেন তবে তৈরি থাকেন, একদিন আফসোস করতে হবে।

ধর্মীয় শিক্ষার এই মহান কেন্দ্রে যদি সততা, স্বচ্ছতা, আমানতদারিতা, পেশাদারিত্ব এবং সময়োপযোগিতা না থাকে, তাহলে মানুষ এসব শিখতে আর কোথায় যাবে? সকল মানবিক গুণের আধার আমাদের মাদরাসাগুলো। কতিপয় সুযোগসন্ধানী এবং দুর্নীতিপরায়ণ মানুষের লোভের কাছে এই মহান শিক্ষাধারা কলুষিত হোক—আমরা সেটা কখনোই চাই না।
সিলেবাস সংস্কারের আগে বেফাক-হাইয়া সংস্কার করুন!

কওমী মাদরাসায় অধ্যয়ণ করা ও বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মঈনুল ইসলাম তুহিন তার ফেসবুক প্রোফাইলে লিখেছেন,

বেফাক তথা আল হাইয়াতুল উলইয়া তথা কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠছে, দেখলাম। অভিযোগটি গুরুতর। আসুন, অভিযোগটিরে পড়া যাক।

আমি বলছিলাম, রাষ্ট্র ও ক্ষমতাকাঠামোর আওতায় আইসা মাদ্রাসাগুলিতে পলিটিকাল করাপশনের ঘটনা ঘটতেছে। স্টেট স্পন্সরড অপরাধ ও করাপশনগুলি মাদ্রাসা শিক্ষায় অনুপ্রবেশ করতেছে। যার সর্বসাম্প্রতিক ও একদম নয়া উদাহরণ এই প্রশ্নফাঁস।

বেফাক পরীক্ষা আমিও দিছি। এর আগে, কখনোই আমরা বেফাক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোন অভিযোগ শুনি নাই। মাদ্রাসায় থাকাকালীন আমি অনেকগুলি পরীক্ষাই দিছি, আরো অনেকে দিছেন নিশ্চয়ই, কখনোই আমরা প্রশ্নফাঁসজাতীয় কোন আলাপ শুনি নাই। কিন্তু এবারের হাইয়াতুল উলইয়া পরীক্ষাটিতে এই প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটলো। এটি কীভাবে পড়তে চান?

প্রশ্নফাঁস মাদ্রাসা শিক্ষারই ফল—এই বলে কি মাদ্রাসাগুলি বন্ধ কইরা দিতে চান? সেটি করতে যথেষ্ট পরিমাণে অন্ধ হওয়ার হিম্মত লাগবে, যা আশা করি কারুরই প্রায় নাই। মাদ্রাসার ছাত্রদের কাছে বেফাকের এই পরীক্ষাটি এতদিন যে মূল্য ও তাৎপর্য বহন করতো, সেটি এখন পাল্টায়ে গেছে। এতদিন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিত সার্টিফিকেটের ভ্যালুর তোয়াক্কা না কইরাই, শুধুমাত্র নিজের শিক্ষাজীবনরে পূর্ণতাদানের স্বার্থে। কিন্তু ‘হাইয়া’র এই নয়া সার্টিফিকেটটি স্টেটের সাথে তার নানাবিধ রিশতা তৈয়ার করতেছে, জ্ঞানলাভ ও যোগ্যতা যাচাইয়ের বাইরেও, এই সার্টিফিকেটটি তার জ্ঞানের ‘মার্কেটভ্যালু’ তৈরি করতেছে, তার ক্যারিয়ার তৈরি করতেছে। ফলে, এটির তাৎপর্য বদলে গেছে রাতারাতি, এটি ‘ফাঁসযোগ্য’ ও ‘ফাঁসকাম্য’ হয়ে উঠতেছে।

প্রশ্নফাঁস আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কী হালত করছে, তা আমাদের চোখের সামনেই আছে। প্রশ্নফাঁসের জন্য কোন শিক্ষাব্যবস্থারে দায়ী করা সঙ্গত না। নৈতিকতার প্রশ্ন তোলা যায়, কিন্তু স্টেটের আওতায় চর্চিত নৈতিকতা আসলে কেমন ‘নৈতিকতা’, সেই আলাপটিই গুরুতরভাবে আবারও উঠে আসতেছে এই প্রশ্নফাঁসের ইস্যুতে।

এখন, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব, তারা কী করবেন? কীভাবে দেখবেন এই প্রশ্নফাঁসের ঘটনারে? সেক্যুলারদের বকাবাদ্যির ভয়ে বা সেক্যুলারদের বোকামিপ্রসূত প্রশ্নের উপর অভিমান কইরা, তারা কি এই প্রশ্নফাঁসের অভিযোগটির বিরুদ্ধেও চুপ থাকবেন? নাকি এটিরে স্টেট ও পাওয়ারের সাথে মাদ্রাসাগুলির ভুল রিশতার ভুল ও মর্মান্তিক প্রভাব হিশাবে পড়তে পাইরা, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন?

আমি জানি না, তারা কী করবেন। কিন্তু সময় এখনই। নাইলে সেইদিন বেশি দূরে না, যখন প্রশ্নফাঁসের কারণে মাদ্রাসাশিক্ষার হালতও হবে ভয়াবহ। তখন অনশনেও হয়ত কাজ হবে না, ভার্সিটিছাত্রের অনশনে ক্ষমতা যেমনে লড়েচড়ে, মাদ্রাসাছাত্রের অনশনে তা কী হবে? কে তারে আশা দেবে, কে তারে ভরসা দেবে, কে তার পক্ষে শাহবাগে দাঁড়াবে? শিক্ষাব্যবস্থা আপনার, দায়িত্বও আপনার। অন্যের উপরে অভিমান কইরা সেই দায়িত্ব এড়াইলে, আপনার এতদিনের শিক্ষারে প্রশ্নবিদ্ধ করার চোরাই সুযোগ যে আরো বেড়ে যায়, সেটি কবে বুঝবেন—পাঞ্জেরি?

কওমী তরুণদের মধ্যে অনলাইনে পরিচিত ও কওমী মাদরাসা ছাত্রদের সম্মিলিত ফেসবুকগ্রুপ আসহাবে কাহাফের অ্যাডমিন সাকিব মুস্তানসির বিষয়টিকে দেখছেন অন্যভাবে। তিনি লিখেছেন,

নিজের নৈতিকতা হারানোর দায় হাইয়া বা বেফাকের উপর চাপাবেন কেন? মাদ্রাসার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সরাসরি বেফাক বা হাইয়া থেকে প্রশ্ন হওয়ার অভিযোগ কেউ করতে পারেনি। দুই একজন হালকা আওয়াজ করার চেষ্টা করলেও সামান্যতম প্রমাণ উপস্থিত করতে পারেনি বরং বেফাক নিয়ে যাঁদের অতিতের চুলকানি ছিল তারাই বেফাককে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বারবার অভিযোগ উত্থাপন করেছে। প্রশ্নফাসের প্রতিটা জোরালো প্রশ্ন উত্থাপন হয়েছে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে। তার মানে ধরেই নেয়া যায় যদি কিছু ঘটে থাকে তবে তা ঘটেছে কেন্দ্রের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক , পরীক্ষক, কর্মচারীদের হাত হয়ে। বেড়ায় ক্ষেত খেলে মালিকের বাপের সাধ্যি নেই ক্ষেত বাচানোর।

প্রশ্নফাঁস হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। প্রশ্নফাস হলেই হায় হায়, গেলো গেলো চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করার দরকার নেই। প্রতিটা সমাজেই কিছু কুলাঙ্গার থাকে তারা অনৈতিক কাজ করবে তাই বলে তাদের জন্য ভালো সব শেষ হয়ে যাবে এটা বাস্তবে হয় না বরং তারাই শেষ হয়ে যায়। চোরের দশ দিন আর গৃহস্থের একদিন। এরা দুনিয়াতে লাঞ্চিত হবে নিশ্চই এবং আখেরাতেও লাঞ্চিত হবে ইনশাআল্লাহ। গেল গেল ডাকপাড়া পাখিদেরও চিনে রাখুন। এরা নিজেরা কিছু করতে না পারার ঝাল মিটাচ্ছে বেফাক ও হাইয়ার উপর।

সনদের ফলেই প্রশ্নফাঁস হচ্ছে এটা শতভাগ ভুল ধারণা। যারা প্রশ্নঁফাস করার তারা আগেও করতেন। এখনো করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। এরা খারাপ। চরিত্রহীন। দুষ্কৃতকারী। খেয়ানতকারী। এরা আলেম নয়। লেবাসধারী। তবে সনদে মান বৃদ্ধি, প্রতিষ্ঠানের সুনামবৃদ্ধি, ভালো রেজাল্ট দেখিয়ে হাইয়ায় প্রভাব বিস্তার ইত্যাদি নিয়ামক যোগ হয়ে প্রশ্নফাস, ভালো ছাত্রদের দিয়ে অন্যের জায়গায় পরীক্ষা দেয়ানো, লোজ কাগজ নিয়ে পরের দিনের উত্তর লিখে এনে যুক্ত করে দেয়া ইত্যাদি ঘটনা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বেফাক আর হাইয়াকে কওমি মাদারাসার অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত ছাত্রদের থেকে যে পরিমাণ বাধাবিঘ্ন পার হয়ে চলতে হচ্ছে তা রীতিমত বিস্ময়কর! যে বোর্ডকে কওমি মাদ্রাসা বিরোধীদের হাজারো কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে পা শক্ত করে দাঁড়াতে বিষম খেতে হচ্ছে বারবার সেই বোর্ডের পা টেনে হিচড়ে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে সমানতালে তার সার্টিফিকেট ভোগী লোকজনই!! পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির পাওয়া দুষ্কর। এতোটা বেয়াকুফ জাতি আর আছে যারা রোগ হলে রোগের প্রতিকার না করে প্রতিষ্ঠানের মাথাকেটে দিয়ে হত্যা করে ফেলতে চায়? আমরা চাই

আত্মসমালোচনা ভালো। খারাপকে খারাপ বলা নৈতিক দায়িত্ব তবে লিমিট অতিক্রম করা উচিত নয়। ইনসাফের দাবী যতটুকু ততটুকুই করুণ। একচুল বেশি করবেন তো সেটুকুর জবাব দেয়ার জন্য তৈরি থাকুন।

এভাবে আরো অনেকেই বিষয়টি নিয়ে নিজ নিজ মতামত দিয়েছেন। ফেসবুকে চলছে চুলচেঁড়া বিশ্লেষণ। অনেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে কওমী মাদরাসার পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস নিয়ে অনুসন্ধান চালানোর ঘোষণাও দিয়েছেন। তবে এসব বিষয়ে সার্বিক একটি অবস্থা ও সিদ্ধান্ত জানা যাবে শনিবারে বেফাক ও হাইয়াতুল উলয়ার বৈঠকের পর।

এইচআরআর/পাবলিক ভয়েস

আরও পড়ুন ঃ

কওমি মাদরাসা ছাত্রদের অপব্যবহার

মন্তব্য করুন