হেফাজতের লংমার্চ : চট্টগ্রাম ও ঢাকায় থাকা দু’জন প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে

প্রকাশিত: ৭:৪৩ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ৬, ২০১৯

আজ ৬-ই এপ্রিল। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ঐতিহাসিক লংমার্চের দিন। ২০১৩ সালের এই দিনে কওমী মাদরাসাভিত্তিক একটি সংগঠন ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ নবীপ্রেমের প্রমান দিতে এগিয়ে এসেছিলো ঢাকা অভিমূখে। তৈরি করেছিলো এক ঐতিহাসিক লংমার্চের ইতিহাসগাঁথা।

সেই লংমার্চ ও সামান্য কিছু স্মৃতি নিয়ে দুজনের মতামত প্রকাশ করা হলো পাবলিক ভয়েসে। সঙ্গত কারণে তাদের নাম প্রকাশ করা হলো না।

এ আন্দোলনের সূতিকাগার চট্টগ্রামে বা বীর চট্টলায়। দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ্ আহমদ শফীর আহবানে সারাদেশের মুসলমান জনতা প্রবল বিক্রমে সিনা পেতে দাড়িয়েছিলো এদেশের ইসলামবিদ্ধেষী কিছু নাস্তিকদের বিরুদ্ধে।

আল্লামা আহমদ শফীর ইখলাস ও তার প্রতি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ এ আন্দোলনের প্রতি মানুষকে পঙ্গপালের মত টেনে এনেছিল। ২০১৩ সালের পুরো মার্চ মাস জুড়ে সারাদেশের মানুষ জেনেছে হেফাজতের কথা_নাস্তিকবিরোধী আন্দোলনের কথা।

এ আন্দোলনের প্রথম প্রস্ফুটিত পুস্প ছিলো ৬-এপ্রিল ২০১৩ সালের ঢাকা অভিমূখে বৃহত লংমার্চ।

আমি তখন হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্র। আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া উস্তাদদেরও বেশ কাছাকাছি। বিশেষ করে আন্দোলনের সে সময়টাতে অনলাইনে সরব উপস্থিতি আমার। খুব প্রচার প্রচারণা, খবর নেয়া, সবকিছু খুটিয়ে খুটিয়ে জানা এ যেন রুটিন ডিউটিতে পরিণত হয়েছিল। ৫ এপ্রিল রাতে পুরো হাটহাজারী মাদরাসায় গমগমে রব উঠেছে। কাল সকালেই ঢাকা অভিমূখে লংমার্চ হবে। সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাথে আমিও।

পরের দিন সকাল। হাটহাজারী মাদরাসা থেকে বের হয়ে চট্টগ্রাম জমিয়তুল ফালাহ ওয়াসা চত্বর পর্যন্ত আসা গেলো। এরপর আর ঢাকা যাওয়া যায়নি। ওয়াসা চত্বরেই আটকে দিলো আমাদেরকে। এরপর “ইসলাম চত্বর” ঘোষণা দিয়ে ঢাকার সাথে এবাত্বতা জানিয়ে এখানেই চললো আন্দোলন।

স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন সাথে সাথে যারা এখানে অবস্থান করছে তাদের নিরাপত্তাসহ সার্বিক কিছু দায় দায়িত্ব নিয়ে এখানেই হলো আমাদের অবস্থান। আমার দায়িত্ব ছিলো জিএসসি মোড়ের এদিকে। হাতে একটি লাঠি, মাথায় হেলমেট। একটি সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে অবস্থান করা আমাদের। সেদিন সন্ধ্যার একটু আগে জিএসসি মোড় হয়ে দুটি আওয়ামী মিছিল আসছিলো এদিকে। আমাদের দিকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আর আসেনি।

৬ তারিখ সারাদিন সেখানে রইলাম আমরা। রাতেও ছিলাম। পরেরদিন হাটহাজারী মাদরাসায় ফিরেছি। ওদিকে ঢাকায় চলেছে তখন বিশাল ইতিহাস রচনা। পুরো ঢাকা অবরোধ করে দিয়ে স্বরণকালের সর্ববৃহত লংমার্চ সফল করে তৌহিদি জনতা ফিরেছিল তাদের এলাকায়।

একটু ফিরি ঢাকার পর্বে। লংমার্চে ঢাকায় উপস্থিত থাকা হিফজুর রহমানের ছোট্ট স্মৃতিচারণ সংযুক্ত করি। তিনি একটু সূচনা থেকেই শুরু করেছেন;

আজ থেকে ৬ বছর আগে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, তখন ৫ই ফেব্রুয়ারী ২০১৬ আদালত থেকে রায় আসলো জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদন্ড। এ রায় মেনে নেয়নি ‘অনলাইন ব্লগার এন্ড এক্টিভিটিস নামে একটি গ্রুপ’ তারা রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক শাহবাগ মোড় অবরোধ করে আন্দোলন করতে শুরু করলো। তাদের “এক দফা এক দাবি, কাদের মোল্লার ফাঁসি দিবি”। এরপর তাদের দাবি-দাওয়া বেড়ে গেলো_হুট করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করাসহ তারা শাহবাগে ইসলামের বিরুদ্ধে, রাসূলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকমের শ্লোগান এবং বিভিন্ন ব্লগে ইসলামবিরোধী লেখালেখি শুরু করলো। নিজেরা ধর্মের বিরুদ্ধে সরাসরি কথাবার্তাও বলছিলো তখন। যেমন: শাহবাগে তখন কাদের মোল্লার প্রতিকি ছবি বানিয়ে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে লিখে দেয়া হয়েছিল “কোথায় তোর আল্লাহ, এই তোকে ফাঁসি দিচ্ছি পারলে তোর আল্লাকে এসে বাঁচাতে বল( নাউযুবিল্লাহ)” ইমরান এইচ সরকার সরাসরি ঘোষিত নাস্তিকদের পক্ষে কথা বলা শুরু করলো। আরও অনেক উক্তি ও কাজ এমন ছিলো যাতে বুঝা যাচ্ছিলো “ইসলামকে প্রতিপক্ষ বানিয়েই তারা কাজ করছে”

শাহবাগে এমন ইসলামবিদ্ধেষী কর্মকান্ড দেখে দেশের আলেম ওলামারা প্রতিবাদ করা শুরু করলো। এর মধ্যে একজন আলেম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চে গিয়ে সমর্থন জানিয়ে আসলো। শুরু হলো তুমুল বিতর্ক।

তখন হেফজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ্ আহমদ শফীর পক্ষ থেকে দেশবাসী তৌহিদী জনতা এবং আলেম ওলামাদের প্রতি ইনকিলাব ও আমার দেশ পত্রিকায় একটি খোলা চিঠি দেওয়া হলো।

… এরপর ধারাবাহিক আন্দোলন শুরু। সর্বপ্রথম ২৫-শে ফেব্রুয়ারী হাটহাজারীতে হেফাজতের ডাকে বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সমাবেশ থেকে হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ঘোষনা দিলেন খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইসলামবিদ্ধেষী কর্ম-কান্ড বন্ধ করা হোক।তা না হলে আমরা তৌহিদি জনতাকে নিয়ে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করবো।

শুরু হলো আন্দোলন মিছিল, মিটিং, সমাবেশ, গ্রামে গঞ্জে, পাড়ায় সর্বত্র ইসলামবিদ্ধেষী গণজাগরন মঞ্চের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধের প্রস্তুতি ।

দাবি আদায়ের জন্যে হোফাজতের আমীর আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী ৯-ই মার্চ তারিখ দিয়ে সারা বাংলাদেশের বড় বড় আলেম উলামা পীর মাশায়েখ এবং সমস্ত ইসলামী দলের নেতাদের নিয়ে হাটহাজারী মাদ্রাসায় জাতীয় উলামা-মাশায়েখ সম্মেলনের ডাক দিলেন। উপস্থিত হলেন সবাই। সারাদিন আলোচনা হলো। কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনাও ঘটলো।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলোচনা শেষে হেফাজতের ঐতিহাসিক ১৩ দফার ঘোষণা এলো। ৫ ই এপ্রিলের আগে ১৩ দফা দাবি মানা না হলে ৬ই এপ্রিল ঢাকা অভিমূখে হেফাজতের লংমার্চচে ঘোষণা দেয়া হলো। দেশের পত্রিকাগুলো হেডলাইন করলো এ ঘোষণা।

ঘোষনার পর বাংলাদেশে আরও কঠোর জাগরণ শুরু হলো। আন্দোলনে নামলেন সাধারণ জনতা। সবার মুখে মুখে দাবি নাস্তিকদের শাস্তি চাই। মাসব্যাপী চলল এ আন্দোলন।
শেষ পর্যন্ত ৫ ই এপ্রিল চলে এলো।

এদিকে হেফাজতের লংমার্চ বন্ধ করার জন্যে শাহবাগের গনজাগরন মঞ্চ সহ কয়েকটি সংগঠন হরতালের আহবান করলো। কিন্তু হরতালকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হেফাজত সমর্থকরা একদিন আগেই ঢাকায় চলে আসলো। ঢাকার প্রায় প্রতিটি মাদ্রাসা, মসজিদ কানায় কানায় ভরে গেলো জনতায়। অবশেষে ৬ ই এপ্রিল সকাল থেকেই শাপলা চত্বরে জমায়েত হওয়া শুরু করলেন সবাই। সকাল ১০টার মধ্যে শাপলা চত্বর কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো লোকজনের চাঁপ। লক্ষ লক্ষ জনতার জামায়েত হলো।

সারাদিন একের পর এক ভাষণ দিলেন হেফাজত নেতারা। কিছু অনিয়ন্ত্রিত কথাবার্তা এসেছে এবং বিভিন্ন আলোচনা হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন স্পটে হেফাজত কর্মীদের বাধা দেওয়া ও মারধর করার প্রতিবাদে ৮ ই এপ্রিল সকাল-সন্ধ্যা হরতালের কর্মসূচি ঘোষনা করেন হেফাজতের মহা সচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী।

এরপর হেফজতের যুগ্ন মহা সচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ ধারাবাহিক কর্মসূচি ঘোষণা করলেন সেদিনই : ১৩ দফা বাস্তবায়নের আল্টিমেটাম। দেশব্যাপী শানে রেসালত সম্মেলন করা ও ৪-ই মের মধ্যে দাবি না মানলে ৫-ই মে ঢাকায় বৃহত অবরোধের ঘোষণা এলো। দেশব্যাপী একটি আলোড়ন সৃষ্টি হলো।

এভাবেই শেষ হয়েছিলো একটি ঐতিহাসিক লংমার্চ। একটি বিপ্লবের ঝলক।

তবে এ দিনটি কিছুটা কালির দাগও তৈরি করেছিল ঢাকায় লংমার্চ মঞ্চে। লংমার্চে উপস্থিত থাকা একজনের ভাষায় বলি,

…অরাজনৈতিক এ মঞ্চে রাজনৈতিক বাঘা বাঘা নেতারা স্থান পেয়েছিলো। ৬ এপ্রিল লংমার্চ কর্মসূ‌চির দিন বি‌কে‌লে ‌বিএন‌পির কয়েকজন নেতা যারা পান্জা‌বি পাজামা প‌রে এসেছিলেন। সি‌নিয়র‌দের ম‌ধ্যে ডঃ খন্দকার মোশাররফ হো‌সেন ও সা‌দেক হো‌সেন খোকা, ফজলুল হক মিলন সহ আরও অ‌নেক জু‌নিয়র নেতা‌দের‌কে দে‌খে হেফাজত নেতারা সাদ‌রে ম‌ঞ্চে জায়গা ক‌রে দি‌য়ে বক্তৃতা করার সু‌যোগ ক‌রে দিয়েছিলেন। তাঁরা খা‌লেদা জিয়ার দূত হি‌সে‌বে ও দোয়া নি‌তে এখা‌নে এসে‌ছেন এবং আন্দোলনের সা‌থে একাত্মতা জানিয়ে বেগম জিয়ার সালাম দিয়েছিলেন। হেফাজতের স্টেইজে অনেকে সেই সালামের জবাবও নিয়েছেন। রাস্তায় শার্টপরা আল্লামা সাঈদীপূত্র মাসুদ সাঈদী ছিলেন। দেখেছিলাম। সে ম‌ঞ্চের কথাবার্তা ভী‌ড়ের মা‌ঝেও নি‌বিড় ম‌নে শোনার চেষ্টা কর‌ছি‌লেন। এক‌ত্রে আছ‌রের নামাজ পড়লাম আমরা।

এদিন বি‌কে‌লেই প‌শ্চিম‌দিক থে‌কে অর্থাৎ দৈ‌নিক বাংলা থে‌কে একজন‌কে ঘি‌রে মি‌ছিল আস‌ছি‌লো । হ্যাঁ, আমার দেখ‌তে ভুল হয়‌নি তি‌নি ছি‌লেন ইসলামী আন্দোলনের না‌য়ে‌বে আমীর মুফ‌তি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম। তাঁ‌কে মঞ্চ থে‌কে অভ্যর্থনা জানা‌তে কাউ‌কে আগা‌তে দেখলাম না। একপর্যায় তি‌নি ম‌ঞ্চের অদূ‌রে তাঁর সমর্থকদের নি‌য়ে রাস্তায় ব‌সে পড়‌লেন! রাস্তার গা‌লিচা হি‌সে‌বে তাঁর জন্য তাৎক্ষ‌ণিক বরাদ্দ হ‌লো অনুসারী‌দের হা‌তে থাকা প‌ত্রিকার কাগজগু‌লো। বক্তৃতা দেয়ার সু‌যোগ তো দুরস্ত!

এর মধ্য দিয়েই শেষ হয়েছিলো এ ইতিহাসের প্রথম পাতা।

এরপর দেশের প্রতিটি বিভাগে শানে রেসালত সম্মেলন হলো। দেশে অভূতপূর্ব গণজাগরণ। ৫-ই মে’র ইতিহাস। রক্তে রঞ্জিত শাপলা চত্বর। বিশ্বাসের বহুবচন এবং সোহরাওয়ার্দীতে সনদ প্রদান পরবর্তি শোকরানা মাহফিলে শাপলা চত্বরের রক্ত মুছে ফেলা। এভাবেই এক ধরণের অঘোষিত পরিসমাপ্তি হয়েছিলো এই সম্ভাবনাময়ী বিপ্লবের।

কিন্তু হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এদেশের মুসলমানদের মননে, হৃদয়ে যে বিপ্লবের চেতনা প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে, একটি গণবিপ্লবের সম্ভাবনা পরিস্কার করে দিয়েছে সেটা যুগ পেরিয়ে যুগান্তরেও কাজে লাগবে এদেশে মুক্তিকামীদের জন্য_ইসলামপ্রেমীদের জন্য।

এইচআরআর/পাবলিক ভয়েস

মন্তব্য করুন