

আলেমসমাজ আজ পর্যন্ত এমন কোনো আন্দোলন বা প্রচেষ্টার সাথে তাঁরা শরিক হননি যা রাষ্ট্রবিরোধী বলে বিবেচিত হতে পারে। তাই আইনগতভাবে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।
সাঈদ হোসাইন
মুক্তিযুদ্ধে এদেশের আলেমসমাজ ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছেন। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তাঁদের অবস্থান চারটি ধারায় বিভক্ত।
প্রথমত, আলেমসমাজের বিরাট একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন।
দ্বিতীয়ত, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না করলেও অন্যকে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
তৃতীয়ত, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি, আবার বিরোধিতাও করেননি; বরং নীরব থেকেছেন।
চতুর্থত, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন না, বরং বিরোধিতা করেছেন। বিশেষ করে নেজামে ইসলাম পার্টির সাথে সম্পৃক্ত আলেমরা। কিন্তু তাঁরা কোন ধরনের হত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণ ও অন্যান্য অন্যায় কাজে লিপ্ত ছিলেন না।
বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আলেমসমাজের এ অংশটি কেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, সে নিয়ে কিঞ্চৎ বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পাব।
১.
নেজামে ইসলাম পার্টির সাথে সম্পৃক্ত আলেমরা ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে তাদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করার দাবি জানান। এ সম্পর্কে নেজামে ইসলাম পার্টির নেতা খতিবে আজম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ রহ. এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করিলে তাঁহার হস্তে ক্ষমতা অর্পণ করার দাবী জানাই। (খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ জীবন ও কর্মসাধনা- ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, প্রকাশক: মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, দ্বিতীয় সংস্করণ: জুন ২০১৪, পৃ. ৭২)
আওয়ামী লীগ একক রাজনৈতিক দল হিসেবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এ নির্বাচনে বিজয়ী হয়। ৩টি আসন ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের সবক’টি আসন তারা লাভ করে। নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে আশা করা হচ্ছিল যে, পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায় থেকে রাজধানী রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায়সঙ্গত অধিকার লাভের পথ সুগম হবে। আর এটি নির্বাচনের প্রাক্কালে একমাত্র নেজামে ইসলাম পার্টি অন্যতম দাবি ছিল। ২মে তারিখে অনুষ্ঠিত জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টির কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবে এ দাবির সমর্থন রয়েছে। ঐ কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবসমূহের মধ্যে অন্যতম এ প্রস্তাবে বলা হয় যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজধানী পূর্বপাকিস্তানে স্থানান্তরিত করা হোক। প্রস্তাবটির হুবহু বর্ণনা নিম্নরূপ:
পূর্বপাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টির কাউন্সিল অধিবেশন মনে করে যে, দেশের দু’অংশের মধ্যে পাহাড়সম অসমতা দূরীকরণার্থে পাকিস্তানের রাজধানীর গুরুত্ব সর্বাধিক। এজন্যই পূর্ব পাকিস্তানে অতিসত্বর রাজধানী স্থানান্তর করার জন্য এ কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পেশ করছে।
জাতি তো উপরোক্ত আশাই পোষণ করেছিল, কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খানের একগুঁয়েমি এবং চাপিয়ে দেয়া নীতির দরুন জাতির আশা ধুলিসাৎ হয়ে যায়। ইয়াহিয়া-ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান দ্বিখন্ডিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে। (হায়াতে আতহার (বাংলা), মাওলানা শফিকুর রহমান জালালাবাদী, প্রকাশক: আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ার প্রকাশনা বিভাগের পক্ষে (মাও) আনোয়ার শাহ প্রকাশকাল: ৩ মে ২০০৪; পৃ. ১২৬)
আলেমদের এ দাবি যথার্থ ও যৌক্তিক ছিল। আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব তাদের হাতেই অর্পিত হত। তখন পরিস্থিতি পাল্টে যেত। আওয়ামী লীগের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে এদেশের ইতিহাস আজ অন্যভাবে লেখা হত। যদিও পশ্চিম পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি রাজনৈতিক সমস্যা দেখা দিত। কিন্তু একাত্তরে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হল সেটা থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পার্লামেন্টের মাধ্যমেই হয়তো একসময় দেশ ভাগ হবার প্রয়োজন দেখা দিত। কিন্তু তখন ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্যের প্রয়োজন পড়ত না।
২.
মুক্তিযুদ্ধকালীন নেজামে ইসলাম পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত আলেমদের ভূমিকা কী ছিল, সে নিয়ে কিছু আলোকপাত করি। ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বরের পর নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মাওলানা আতহার আলী রহ.কে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ দুই বছর ধরে জেলখানায় নানাবিধ কষ্টের শিকার হওয়ার পর অবশেষে ১৯৭৩ এর ডিসেম্বরে নির্দোষ প্রমাণিত হলে তিনি মোমেনশাহী কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাঁর ভূমিকা কী ছিল সেটা তার জীবনী থেকে উদ্ধৃত করছি-
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাওলানা আতহার আলী রহ. তাঁর উপরোক্ত মতাদর্শের (পাকিস্তানের অখন্ডতা এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ সংরক্ষণ) উপর অটল ও অবিচল থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সব ধরনের জুলুম ও অত্যাচার থেকে বিরত থাকার জন্য সতর্ক করতে থাকেন। সেনা অফিসারদেরকে সাধারণ সৈনিকদের অত্যাচার ও উৎপীড়নের বিষয় অবহিত করে তিনি জাতির মুক্তি এবং তাদের মান-মর্যাদার হেফাজতের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। অবশেষে নির্যাতিত জনগণের আর্তনাদের ফলে অত্যাচারী সেনাবাহিনীর উপর খোদায়ী গজব নেমে আসে, অনিবার্য হয়ে ওঠে পাক হানাদার বাহিনীর পরাজয়। তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। তবে স্বাধীনতা উত্তরকালে জাতির এ অসাধারণ শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিত্বের সাথে চরমভাবে যে অসদাচরণ করা হয় তা অত্যন্ত পীড়াদায়ক ও হৃদয়বিদারক… (প্রাগুক্ত)
নেজামে ইসলাম পার্টির অন্যতম নেতা খতিবে আজম ছিদ্দিক আহমদ রহ. এর ভূমিকা তাঁর জীবনী থেকেই উদ্ধৃত করছি-
২৫ মার্চ যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিরীহ বাঙ্গালীদের উপর ঝাঁপাইয়া পড়ে তখন তিনি উপলব্ধি করিতে পারেন যে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি বোধ হয় আর রক্ষা করা যাইবে না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস তিনি প্রায় সময় নিজের গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করেন। রাজাকার, আল-বদর, আশশামস এর মতো স্বেচ্চাসেবী প্যারা মিলিটারী গঠনে তাঁহার কোন মুখ্য ভূমিকা ছিল না। পাক সেনা বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ, লুণ্ঠনকে তিনি ঘৃণার চক্ষে দেখেন এবং ইহার পরিণতি ভয়াবহ হইবে আঁচ করিতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বহু হিন্দু পরিবারকে তিনি তাঁহার বাড়ীতে আশ্রয় ও খাবার প্রদান করেন। খতীবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.)-এর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কোন ধরনের অভিযোগ কোন থানায় নথিবদ্ধ হয় নাই। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর নিরাপত্তার খাতিরে তাঁহাকে ২২ মাস কারাগারে রাখা হয় কিন্তু তাঁহার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না থাকায় তিনি নির্দোষ মুক্তি পান। (খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ জীবন ও কর্মসাধনা- ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, প্রকাশক: মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, দ্বিতীয় সংস্করণ: জুন ২০১৪, পৃ. ৭৭-৭৮)
১৮ অক্টোবর ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত দৈনিক বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে খতীবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ রহ. মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর অবস্থান ও অনুভূতি খোলামেলাভাবে আলোচনা করেন। পাঠকের জন্য এর চুম্বকাংশ তুলে ধরা হল।
’৭১ সালের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সময় তাঁহার দলের অনুসারীরা কি ভূমিকা লইয়াছিল জানিতে চাহিলে তিনি বলেন, এ সময় তিনি গ্রামে ছিলেন। এখানে কি হইয়াছে তাহা তিনি তখন জানিতে পারেন নাই। তিনি বলেন, অস্ত্রের মুখোমুখি হইয়া আমরা তৃতীয় মতাবলম্বীরা প্রস্তুতি লওয়ার আগেই কাটাকাটি মারামারি শুরু হইয়া যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাক বাহিনী, রাজাকার, আল-বদর, আলশামসের নির্বিচার গণহত্যা ও নারী ধর্ষণকালে দখলদার সরকারের দুইজন মন্ত্রী যাহারা বর্তমানে ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগের নেতা তাহারা কি ভূমিকা রাখিয়াছিলেন এই প্রশ্নের জবাবে মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.) বলেন, তাঁহারা তখন সিভিল এডমিনিস্ট্রেশন লইয়া ব্যস্ত ছিলেন। হত্যার জন্য তাঁহাদের দায়ী করা যায় না এবং তাঁহারা নিজেরা অস্ত্র ব্যবহার জানিতেন না। শান্তি-শৃ়ঙ্খলা রক্ষায় তাঁহাদের ভূমিকা ছিল ইতিবাচক। …
প্রশ্ন: স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য কে দায়ী?
মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.) : উভয় পক্ষেরই বাড়াবাড়ি হইয়াছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ’৭০-এর নির্বাচনে জনগণ ৬ দফার পক্ষে রায় দিয়াছিল। স্বাধীনতার কোন কথা তাহাতে ছিল না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে স্বায়ত্বশাসন লইতে কোন বাধা ছিল না বলিয়া আমরা মনে করি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইয়াহিয়া-ভুট্টোর অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের তিনি তীব্র নিন্দা করেন।
প্রশ্ন: স্বাধীনতা যুদ্ধে আপনাদের কি ভূমিকা ছিল?
মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.) : আমাদের কোন ভূমিকা ছিল না। আমরা তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িয়াছিলাম। কোন পথে যাইব তাহা ঠিক করিতে পারি নাই। …
প্রশ্ন: আপনাদের দল রাজাকার, আল-বদর, আশ-শামস বা তথাকথিত শান্তি কমিটির সদস্য লইয়া গঠিত কিনা?
মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.): আল-বদর, আশ-শামস, রাজাকার প্রভৃতি বাহিনী কোন রাজনৈতিক বাহিনী ছিল না। পাঞ্জাবী মিলিটারীরা এইসব বাহিনী গঠন করিয়াছিল। তদানীন্তন সরকার ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার-চেয়ারম্যানদের লইয়া শান্তি কমিটি গঠন করেন। (প্রাগুক্ত পৃ.৭২-৭৩)
৩.
যে কয়েকটি কারণে নেজামে ইসলাম পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত আলেমরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন, সে বিষয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো। প্রথমত আদর্শগত কারণে এসব আলেম মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। আওয়ামী লীগ ছিল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্রের ধারক ও বাহক। মুক্তিযুদ্ধকালীন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক মীজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, বিশ্বে একটি মাত্র ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র আছে। তা হলো ভারত। আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোও তাই। আমরা ইতোমধ্যেই মুক্ত এলাকায় ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজবাদ কায়েমের কাজ শুরু করে দিয়েছি। (জয় বাংলা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র, ১ম বর্ষ, ২৮ সংখ্যা, শুক্রবার, ২৬ শে নভেম্বর, ১৯৭১, পৃষ্ঠা ১০)
আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও সমাজতন্ত্রী চেহারা দেখে আদর্শগত কারণেই আলেমসমাজের এই অংশের পক্ষে তাদের সহযোগী হওয়া সম্ভব ছিল না। ইসলামের নামে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়া সত্ত্বেও যখন ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতে পারল না তখন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও সমাজতন্ত্রীরা যদি কোন রাষ্ট্র কায়েম করে তাহলে সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের বিজয় অসম্ভব হবে বলে তাঁরা মনে করেছিলেন।
দ্বিতীয়ত পাকিস্তানের প্রতি ভারতের অতীত আচরণের কারণে নেজামে ইসলাম পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত আলেমদের পক্ষে ইন্দিরা গান্ধীকে এদেশের এবং মুসলিম জনগণের বন্ধু মনে করাও কঠিন ছিল। তাই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের স্বতঃস্ফুর্ত সহযোগিতাকে তাঁরা সন্দেহের চোখে দেখেন। ইতঃপূর্বে ইন্দিরা গান্ধীর পিতা জওয়াহের লাল নেহেরু কাশ্মীর, জুনাগড়, মানভাদার, হায়দ্রাবাদ, কুচবিহার যেই কৌশলে অঙ্গিভূত করেন, হতে পারে বাংলাদেশকে সেই কৌশলে অঙ্গিভূত করে ফেলবে, এমন একটি আশংকা হয়তো তাঁরা পোষণ করতেন।
এই প্রসঙ্গটি খতিবে আজম ছিদ্দিক আহমদ রহ. এর এক সাক্ষাৎকারে ওঠে আসে-
স্বাধীনতা সংগ্রামকে তাঁহারা বিরোধিতা করিয়াছিলেন। কারণ স্বাধীনতাকে তাঁহারা সম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদীদের চক্রান্ত বলিয়া মনে করিয়াছিলেন। তিনি বলেন, বিদেশের হস্তক্ষেপ ছিল বলিয়া আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করিয়াছিলাম। বিদেশের চক্রান্তে এদেশের মানুষ ছুটিয়া চলিয়াছিল।… আমরা স্বাধীনতা চাহিয়াছিলাম। কিন্তু তাহা বিদেশের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে নয়। (খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ জীবন ও কর্মসাধনা- ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, প্রকাশক: মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, দ্বিতীয় সংস্করণ: জুন ২০১৪, পৃ.৭২) আরেক জায়গায় তিনি বলেন, আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে সম্প্রসারণবাদী ভারতের হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করিয়াছি। স্বাধীনতার পর গঠনমূলক কাজে আমরা আত্মনিয়োগ করিয়াছি। (প্রাগুক্ত, পৃ.৭১)
তৃতীয়ত তাঁরা বিশ্বাস করতেন সম্প্রসারণবাদী ভারতের বাড়াবাড়ি থেকে বাঁচতে হলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের এক রাষ্ট্রভুক্ত থাকাই লাভজনক। বিভক্ত হয়ে গেলে ভারতের আধিপত্য রোধ করা পূর্ব পাকিস্তানের একার পক্ষে অসম্ভব। মুসলিমবিশ্ব থেকে ভৌগলিক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ভারত দ্বারা বেষ্টিত অবস্থায় এ অঞ্চলের নিরাপত্তার প্রশ্নটিই এদের নিকট চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয় ছিল।
চতুর্থত সেক্যুলার মহল মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে খাড়া করিয়েছে। সেসময় স্বাধীনতার নামে প্রদত্ত তাদের স্লোগানগুলোর ধরন দেখে আলেমরা মুসলিম জাতীয়তাবোধ নিয়ে বেঁচে থাকার ব্যাপারে আতঙ্কিত হতে বাধ্য হলেন।
এসব আশঙ্কাই নেজামে ইসলাম পার্টির সাথে সম্পৃক্ত আলেমদেরকে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু তাঁরা কোন ধরনের হত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণ ও অন্যান্য অন্যায় কাজে লিপ্ত ছিলেন- এরকম কোনো প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাই তাঁদেরকে দেশের দুশমন মনে করা রাজনৈতিক হিংসারই পরিচায়ক। রাজনীতিতে ভিন্নমত থাকতেই পারে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বরের পর থেকে বাংলাদেশকে একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র বলে মেনে নিয়েছেন তাঁরা। বর্তমান পাকিস্তান যদি ভৌগলিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ হত তাহলে এ সন্দেহ করার সম্ভাবনা ছিল যে, তাঁরা হয়তো আবার বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার ষড়যন্ত্র করতে পারে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এমন কোনো আন্দোলন বা প্রচেষ্টার সাথে তাঁরা শরিক হননি যা রাষ্ট্রবিরোধী বলে বিবেচিত হতে পারে। তাই আইনগতভাবে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।