

জাসিন্ডা আরডার্ন। নিউজিল্যান্ডের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। স্বামীর নাম ক্লার্ক গেফোর্ড। বয়স মাত্র ৩৭। একমাত্র কন্যা সন্তানের মা। যার বয়স এখনো বছর পেরায়নি। বেনজির ভূট্টোর ন্যায় তিনিও প্রধানমন্ত্রীত্ব থাকাকালীন সন্তান জন্ম দেন। তাঁর দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় তিনি অন্য একটি দলের সহযোগিতা নিয়ে সে দেশের সরকার চালাচ্ছেন। তিনি ১৮৫৭ সালের পর নিউজিল্যান্ডের কণিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী। একজন প্রধানমন্ত্রী কতটা কেয়ারিং হতে পারে, তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। গত শুক্রবারের নারকীয় ঘটনার পর সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর পদক্ষেপগুলো বিপুল প্রশংসা কুড়িয়েছে।
নিউজিল্যান্ড। পৃথিবীর সর্ব দক্ষিন পূর্ব এলাকার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। লোকসংখ্যা মাত্র ৫ মিলিয়ন। রাজধানীর নাম ওয়েলিংটন। ক্রাইস্টচার্চে ডিনস এভিনিউর আল নূর মসজিদ ও পার্শ্ববর্তী লিনউড মসজিদে ২৮ বছর বয়সি অষ্ট্রেলিয়ার বংশোদ্ভূত “ব্রেনটন হ্যারিসন” নামে এক কৃশ্চিয়ান খুনী সেমি অটোমেটিক বন্ধুক চালিয়ে জুমার জামাতের সময় ৫০ জন মুসল্লীকে শহীদ ও সম সংখ্যককে আহত করেছে। এ ছাড়া স্ট্রিকল্যান্ড স্টৃটে একটি বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। ইতিহাস নিশ্চয়ই একদিন এ দিনটিকে “থ্রি ফিফটিন ব্লাক ফ্রাইডে” হিসেবে অভিহিত করবে।
এ ঘটনায় দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমবেদনা জানাবেন, খুনীকে ধরে কঠিন সাজা দিবেন, হতাহতদের পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিবেন, নিউজিল্যান্ডের মাটিতে সন্ত্রাসের মূলোৎপাটন করবেন- নগদে এমন ঘোষনা দিবেন, এমন খবরই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু কিউই প্রধানমন্ত্রীর একের পর এক পদক্ষেপে বিশ্বের মুসলমানরা উনাকে খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখতে শুরু করেছেন। ভয়াবহ এ হামলার ঘটনায় তিনি মানসিকভাবে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছেন। নিহতদের পরিবারগুলোর আহাজারিতে তিনি কাতর হয়েছেন। তিনি শোকের জন্য কালো রঙয়ের পোষাক পরছেন। মাথায় একই রঙয়ের হিজাবও লাগিয়েছেন।
আমাদের মত মুসলিম রাষ্ট্রে এমনটা ঘটলে সরকার ততটুকু করতো কিনা সন্দেহ! অথচ প্রাপ্যতা আরো বেশী থাকতো।
একজন প্রধানমন্ত্রী বা সর্বোচ্চ ব্যক্তির আবেগ থাকতে নেই। এ নীতিকে তিনি ধরে রাখতে পারেননি। এমন বিয়োগান্তক ঘটনায় তিনি একাধিকবার কেঁদে চোখের পানি ঝরিয়েছেন। আপনাকে মনে রাখতে হবে, তিনি কিন্তু অমুসলিম। তিনি মাথায় হিজাব পরে এসে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে “আসসালামু আলাইকুম” বলে কথা বলেছেন। এ মর্মান্তিক ঘটনার জন্য তিনি অনুতপ্ত ও দুঃখ প্রকাশ করে অশ্রুসজল হয়েছেন। তিনি বার কয়েক ঘটনাস্থলে পরিদর্শন করেছেন। আসলে নিউজিল্যান্ড অমুসলিম রাষ্ট্র হলেও হিংসা-বিদ্বেষনির্ভর যুদ্ধবাজ দেশ নয়। শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে ওরা প্রকৃতিকে খুব ভালবাসে। তাঁরা শিক্ষিত ও সভ্য জাতি। মানবিক মূল্যবোধকে সম্মান করে। যদিও ওখানে মানুষের চেয়ে ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা কয়েকগুণ বেশী। ভদ্রতা ও সহনশীলতা ওখানকার সংস্কৃতি। এমন সংস্কৃতির জমিনে অমন একটি চরম হিংসাত্মক ঘটনায় সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
অবশ্য সে দেশের জনগনও এ ঘটনায় মুষড়ে পড়েছেন। তাঁদের চিন্তাচেতনাটা এখন মুসলিম ধর্ম ও মসজিদভিত্তিক। তাঁরা মুসলিম সম্প্রদায় ও ইসলাম ধর্মকে পাঠ করছেন। তাঁরা ক্রমশঃ ইসলামের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছেন। ইসলামকে স্টাডি করছেন। আর সহমর্মিতার সব কয়টা ধরণে হাজিরা দিচ্ছেন। প্রতিদিন তাদের কালচার মতে, মসজিদের অকুস্থলে ফুল ও মোমবাতি জ্বালিয়ে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা বের হয়ে মসজিদের অকুস্থলে দাঁড়িয়ে পিণ পতন নীরবতা নিয়ে আজানের সুমধুর ধ্বনি শুনছেন।
বেশ কয়েকটি নিউজ পোর্টালে খবর বেড়িয়েছে, ওখানে অলরেডি কয়েক শত নাগরিক ইসলাম কবুল করেছে। ইসলাম নিউজিল্যান্ডে এখন উর্বর ক্ষেত্র পাচ্ছে। মুসলিম সম্প্রদায়ে আত্মলীন হওয়ার ট্রেন্ড কতদূর গিয়ে ঠেকবে, তা ভবিষ্যতেই বলবে।
শুক্রবারের ঘটনার পর থেকে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিসেস জাসিন্ডার একের পর এক পদক্ষেপে বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় তাঁর ফ্যান হয়ে গেছে। তিনি এখন একজন হিরো। তিনি এখন বিশ্ব নেতৃত্বের আদর্শ হয়ে উঠছেন। পশ্চিমা মিডিয়ারা তাঁকে শান্তির পথে নেতৃত্ব দেয়ার দূত হিসেবে দেখছেন। ইচ্ছে থাকলে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে কিভাবে অন্যদিকে ডাইভার্ট করা যায়, সেটা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। পার্লামেন্ট অধিবেশনে তিনি অভূতপূর্ব কাজ করেছেন। শোক প্রস্তাবের দিন পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে অধিবেশন শুরু করেছেন। পার্লামেন্টে বক্তৃতার সময় তাঁর চোখ ছলছল করে উঠেছে। পার্লামেন্ট ভবনের অভ্যন্তরে তিনি সালাতের ব্যবস্থা করেছেন।
তিনি আরো ঘোষণা দিয়েছেন, শহীদদের যারা নিউজিল্যান্ডের নাগরিক এখনো হন নাই, তাঁর পরিবারকে দ্রুত নাগরিক বানাতে যা করা দরকার তা করবেন। এছাড়া পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পেতে যাচ্ছেন শহীদ পরিবারগুলো। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমেই তা তিনি বাস্তবায়ন করছেন, এজন্য ওয়েলিংটন হাইকোর্টে কোন উকিলকে রীট করতে হয়নি। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে নিহতদের শ্রদ্ধা জানাতে দেশটির রেডিও ও টেলিভিশনে শুক্রবারের জুমার নামার সরাসরি সম্প্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী । ঐদিন দেশের নারীরা মাথায় হিজাব পরে মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি একাত্মতা জানাবেন।
পার্লামেন্টে মিসেস জাসিন্ডা “মিঃ স্পীকার! আসসালামু আলাইকুম” বলে বক্তব্য দেয়া শুরু করায় সারা বিশ্ব ব্যাপারটা কৌতুহলী চোখে দেখছে। তাঁর মন্ত্রীসভা সে দেশের প্রচলিত অস্ত্র আইনে পরিবর্তন আনতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্বমিডিয়া ক্রাইস্টচার্চের নিষ্ঠুর ঘটনাকে যখন ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলছিল না, তখন তিনি অকপটে তাঁর দেশে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ ঘটেছে বলে ঘোষণা করেন। পার্লামেন্টে তাঁর একটি বক্তব্যে অভিবাসী বিশেষ করে মুসলমানরা আগামীর ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন। ইসলামী রেঁনেসা শূরু হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
তিনি বলেছেন, ‘নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় সবাই ছিলেন অভিবাসী। যারা একটু শান্তির জন্য, নিরাপত্তার জন্য এখানে বসবাস করতে এসেছিলেন! যারা নিহত হয়েছেন, অভিবাসী, শরণার্থীসহ হামলার শিকার হওয়া সবাই নিউজিল্যান্ডের অংশ।’
লেখক, এক্টিভিস্ট ও বিশ্লেষক।