আইএস নেতা আবু বকর আল বাগদাদি ; কেমন আছে, কোথায় আছে

প্রকাশিত: ৮:২৬ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৭, ২০১৯

সামছ্ আল ইসলাম ভূঁইয়া :

আবু বকর আল বাগদাদি। একজন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ব্যক্তি। আমেরিকার জেল হতে মুক্ত পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ইরাকে সশস্ত্র কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছেন , তারপর থেকেই দিনে দিনে হয়ে উঠলেন আইএস’র খলিফা। তার আসল নাম ‘ইব্রাহিম আওয়াদ ইব্রাহিম আল বাদরি আল কোরেশি আল সামারায়ি’। ১৯৭১ সালে সামেরায় জন্মগ্রহণ করেছে। তার উপনাম আবু বকর, আবু বকর আল বাগদাদি নামেই দুনিয়া জুড়ে প্রসিদ্ধতা লাভ করেছেন। আবু বকর বাগদাদি ইরাকের বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইসলামিক বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক ডিগ্রি গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে তিকরিত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। আমেরিকার আক্রমণের পূর্বে বাগদাদ, ফাল্লুজা ও সামারা’র বেশ কয়েকটি মসজিদের ইমাম হিসেবে নিয়োজিত ছিল। ২০০৩ সালে ‘জয়শ আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত’ নামক একটি ছোট সামরিক দল নির্মাণ করেন। ২০০৪ সালে আমেরিকান সৈন্যরা তাকে গ্রেফতার করে ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলীয় ‘বুকা’ কারাগারে স্থানান্তর করে। বুকা কারাগারে আল কায়দার অনেক নেতা এবং সাদ্দামের সামরিক বাহিনীর সৈন্যরা বন্দি ছিল। কারাগারে যাওয়া পর আল বাগদাদি আল কায়দার নেতাদের এবং সাদ্দামের সামরিক বাহিনীর সৈন্যদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেন। সেখান থেকে বাগদাদি ২০০৬ সালে মুক্তি পায়।

আল বাগদাদি ২০০৬ সালে ‘ইরাকের ইসলামিক সরকারের সাথে যোগদান করে এবং বিভিন্ন সময়ে আল আনবারের ধর্মীয় আমির, সামারার ধর্মীয় আমির, ফাল্লুজার গভর্নর, দিয়ালার গভর্নর, ওলাতার গভর্নর এবং বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছে। এছাড়াও আবু বকর বাগদাদি, আবু ওমর আল বাগদাদির ডান হাত এবং সংস্থার নেতা ছিল। ২০১০ সালে আবু ওমর আল বাগদাদি মারা যাওয়ার পর সংস্থার প্রধানের দায়িত্ব পালন করে।

২০১১ সালে আমেরিকা অফিসিয়াল ভাবে সন্ত্রাসীদের তালিকায় আল বাগদাদির নাম যোগ করে এবং মোস্ট ওয়ান্টেডের অন্তর্ভুক্ত করে। সে সময় আবু বকর আল বাগদাদিকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে। যা দিনে দিনে বেড়ে ২৫ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। কিন্তু বাগদাদি মিলেনি এখনও।

আল বাগদাদি ২০১৩ সালে আইএসের প্রধান হিসেবে মসুল শহরের বিখ্যাত আল-নুরি মসজিদে খোতবা দিয়ে তার ভাষায় খেলাফতের ঘোষণা দেন। ইরাকের মসুল শহরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ‘ইরাক ও শামে আইএস তাদের ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে ঘোষণা দেয়। বাগদাদি ২০১৪ সালে যখন ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়, তখন তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল ৩৪ হাজার বর্গমাইল এলাকা। পশ্চিম সিরিয়া থেকে পূর্ব ইরাক পর্যন্ত বিশাল এক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের ভীতির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল তারা। ইরাকের মসুলকে রাজধানী ঘোষণা করে পরিচালিত সেই খেলাফতে প্রায় ৮০ লাখ স্থানীয় মানুষকে রাতারাতি বাগদাদিকে খলিফা মানতে হয়।

ইসলামিক স্টেট ঘোষণার পর আইএস সম্রাজ্য খতমের নামে ইরাক সিরিয়ায় হামলে পড়ে বিশ্ব মোড়লরা। ইতিমধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার চার বছর পেরিয়ে গেছে এবং ইরাক ও সিরিয়ায় প্রায় ৩২ হাজার দফায় বিমান আক্রমণ হয়েছে। বহু শহর ও জনপদ ধ্বংস হয়েছে আইএস তাড়ানোর নামে। আইএস’র ‘খেলাফত’ -এর শেষ ঠিকানাও মুছে যেতে বসেছে এই সপ্তাহে। গত প্রায় ছয় মাসে আইএসের সাম্রাজ্য ছোট হতে হতে বাগহুজে এসে থেমেছে। এই সপ্তাহে সেই বাগহুজও ভেঙে পড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ইরাক সীমান্তের লাগোয়া সিরিয়ার বাগহুজ শহরে শেষ প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করেছে আইএস যোদ্ধারা। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে সিরিয়ার আসাদবিরোধী ‘এসডিএফ’এই শহর দখলের মধ্য দিয়ে দুনিয়াজুড়ে বহুল আলোচিত আইএস’র খেলাফতের অবসান ঘটাতে চলেছে শিগগির। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশের টিভি চ্যানেলগুলোয় ‘বাগহুজ’ অভিযানের লাইভ কাভারেজ দেখাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ আইএস যোদ্ধা পরিবারসহ আত্মসমর্পণ বা মৃত্যুর অপেক্ষায় আছে সেখানে। তবে সন্ধান মেলেনি ৪৬ বছর বয়সী আইএস’র খেলাফতের কথিত ‘আমির’ আল-বাগদাদির। নিখোঁজ বাগদাদির ছবি ছাড়া এসডিএফ বা মধ্যপ্রাচ্যের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কেউই সঠিকভাবে হদিস দিতে পারছেন না বাগদাদি এখন কোথায়?

ধারণা করা হয়, মসুলের পতনের পর বাগদাদি এসে আশ্রয় নেন সিরিয়ার দেইর-আল-জউর শহরে। ইরাকের গোয়েন্দা মহলে এরূপ কথা প্রচলিত রয়েছে যে বাগদাদি কখনো এক স্থানে এক দিনের বেশি থাকেন না। অল্প কয়েকজন সহযোগীসহ চলাফেরা করেন তিনি, যারা কখনোই নজরদারিযোগ্য ইলেকট্রনিক কোনো ডিভাইস ব্যবহার করে না। ১৮র জুলাইয়ে হোমস শহরে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর ছোড়া রুশ মিসাইলে বাগদাদির ছেলে মারা যায়। রুশরা ঐসময় বাগদাদিকে হত্যারও দাবি করেছিল। তারপর আগস্টে বাগদাদি’র ৫৫ মিনিটের এক ভিডিও ভাষণ প্রচারিত হওয়ার পর এ দাবির অসারতা প্রমাণিত হয়। যুদ্ধের শেষ লগ্নেও মিলেনি বাগদাদি।

এখন বড় প্রশ্ন হলো খলিফা’ বাগদাদি কোথায়?

নানান প্রতিকূলতা সামলেও বাগদাদি এখনো মুক্ত। ধারণা করা হচ্ছে, ইরাক-সিরিয়া সীমান্তে ইফ্রেতিস নদীর তীর ঘেঁষে সর্বশেষ বেঁচে থাকা সহযোদ্ধাদের মধ্যেই আছেন তিনি। বাগহুজে আইএস’র সবচেয়ে নেতৃস্থানীয় এসব সংগঠকের সামনে এখন আত্মসমর্পণ বা মৃত্যু অপেক্ষা করছে। এদের মধ্যেই বাগদাদির থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু যুদ্ধের শেষ লগ্নেও বাগদাদিকে না পাওয়ায় তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে রহস্য বাড়ছে ক্রমে। বাগহুজ সীমান্ত অঞ্চল হওয়ায় বাগদাদির পক্ষে ইরাকে ঢুকে পড়াও সম্ভব। আবার ইরানের জাহিদান শহরের ভেতর দিয়ে আফগানিস্তানের চলে আসাও অসম্ভব নয়। আফগানিস্তান তো নিশ্চিতভাবেই যোদ্ধাদের লুকিয়ে থাকার জন্য একটা ভালো জায়গা। গত বছর বাগদাদি আলজেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্বের তামানরাসেতে পৌঁছেছেন বলেও একটা সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছিল। তাঁর আহত নিহত হওয়ারও বহু সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়। এসবই হয়তো আইএস যোদ্ধাদের মনোবলে চিড় ধরাতে প্রচারণাযুদ্ধের কৌশল ছিল।

কুর্দি গোয়েন্দা প্রধান লাহুর তালাবানির অনুমান হলো, বাগদাদি জীবিত। কিন্তু কেউই জানে না তিনি এখন দেখতে কী অবস্থায় আছেন, কোথায় আছেন। ২০১৬ সালে প্রধান সহযোগী মোহাম্মদ আল-আদনানিকে হারানোর পর বাগদাদি নিজেকে আরও বেশি গোপনীয়তায় মুড়িয়ে নিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক জবি উরিকের নেতৃত্বে ওয়াশিংটন পোস্টের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যায়, খেলাফতের পতন অনিবার্য জেনে বাগদাদি গত বছর থেকে পুরো সংগঠনে কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে আসতে শুরু করেন। আইএস গেরিলাদের বিরুদ্ধে অভিযানে পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যে মতদ্বৈধতা এবং ধীরগতির সুযোগে শারীরিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে আইএসকে ক্রমে একটি গোপন ভাবাদর্শিক ও গেরিলা সংগঠনে পরিণত করার কাজ সম্পন্ন হয়। কৌশলগত এই পরিবর্তনের লক্ষ্য ছিল ‘খেলাফতের পতন’ শেষেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পরবর্তী প্রজন্মের ওপর প্রভাব ধরে রাখা। এই কৌশলের অংশ হিসেবে বাগদাদি প্রচারমাধ্যমে কম হাজির হতে থাকেন। সংগঠনটিকে ঘিরে রহস্যের কালো মেঘ আর গাঢ় হয় মাত্র। বাগহুজের পর কী বাগহুজের পতনকে পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের বড় এক সামরিক সফলতা হিসেবে দেখাবে?

সম্প্রতি আফগান যুদ্ধেকে সফলতা ধরা হলেও বাস্তবে আমেরিকার পরাজয়ই হয়েছে। তালেবানের মত আইএস’র যোদ্ধা গ্রেপ্তার বা নিহত হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশেই আইএস’র অনেক সেল ‘অক্ষত’ ও ‘ঘুমন্ত’ অবস্থায় রাখা আছে। খেলাফতের কাঠামোগত পতন হলেও এই যোদ্ধারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে কাজ করে চলবে। বাগদাদি অধরা থাকা পর্যন্ত তাদের মনোবলেও চিড় ধরার সম্ভাবনা কম। সিরিয়ায় কুর্দিদের হাতে স্ত্রী-পরিজনসহ ইতিমধ্যে আটক শত বিদেশি দায়েশ যোদ্ধার আটক প্রমাণ করছে, বাগদাদির বিশ্ব নেটওয়ার্ক অনেক বড় ও ব্যাপক। আল–কায়েদা দুর্বল হওয়ার মাঝেই ইরাকে তাদের ভেতর থেকে গড়ে উঠেছিল আইএস। হয়তো বাগহুজের পতন আইএস’র অভ্যন্তর থেকেই নতুন কোনো নেতার মাধ্যমে নতুন ধারার সংগঠনের জন্ম দিতে পারে। আইএস’র যোদ্ধাদের একাংশ ধীরে ধীরে পুরোনো সংগঠন আল-কায়েদায়ও শামিল হতে পারে। বাগহুজের পতনের পর শিগগির কিছু হামলার মাধ্যমে নিশ্চিতভাবেই তারা উপস্থিতির কথাও জানাবে। ফলে, বাগহুজের পতন এবং বাগদাদিকে না পাওয়ার মধ্য দিয়ে আইএস বিরোধী অভিযান শেষ হওয়ার পরিবর্তে আরও জটিল ও বিপজ্জনক এক অধ্যায়ে ঢুকল মাত্র আমেরিকা সহ বিশ্ব মোড়লরা। মোল্লা ওমরের আফগানিস্তানে এক পা রেখে যে বিপদে পড়েছে বাগদাদির ইসলামিক স্টেটে অন্য পা ফেলে তারচেয়ে ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

-লেখকঃ রাজনৈতিক কর্মী

মন্তব্য করুন