

শাইখ মাহমূদ হাসান
ফকির আশরাফ। দু’টি শব্দের একটি নাম। একটি গল্পের সূচনা। এক মৃত ব্যক্তির জীবন্ত ইতিহাস। আমাদের গ্রামে নিভে যাওয়া এক উজ্জল নক্ষত্র। নেত্রকোণা বারহাট্টার অহংকার। ফকিরের বাজার চল্লিশ কাহনীয়ার কৃতিসন্তান ও গৌরব। যার জীবন ইতিহাস সম্পর্কে নেত্রকোণা জেলার প্রত্যেক বিদ্বান ও সচেতন নাগরিক সম্মুখ অবগত। যার মুসাফির জিন্দেগীর প্রারম্ভিকতা আমার দৃশ্যায়ন না হলেও তাঁর শেষ বিদায় চিত্র পড়ন্ত বিকালে স্বচোখে প্রত্যক্ষ করেছি। আর সেদিন অনুধাবন করেছি তিনি কেমন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার মৃত্যুর দিন অনুধাবন করেছি আম জনতা তাঁকে কতোটা ভালোবাসে। তাই আজ পাঠকের সামনে প্রকৃত নেতা ও সমাজ সেবকের জীবন কাহিনী পেশ করছি। যিনি আমাদের নেত্রকোণা জেলার কৃতিসন্তান। যিনি আমাদের হৃদয়ে মরহুম ফকির আশরাফ। যার জন্ম নেত্রকোণা বারহাট্টার ফকিরের বাজারে।
জনাব ফকির আশরাফ নেত্রকোণা জেলার বারহাট্রা থানাধীন ৭ নং রায়পুর ইউনিয়নে ফকিরের বাজার চলিশ কাহনিয়া উত্তর পাড়া এলাকায় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ২০ অক্টোবর ১৯৪১ ঈসায়ী সনে জন্মগ্রহণ করেছেন। পিতার নাম পীর মুহা. মাগরিব আলী ফকির। মাতার নাম তাহাজ্জাতেন নেসা।
মরহুম ফকির আশরাফ ১১ জন ভাই ও এক বোনের মাঝে চতুর্থ ছিলেন। তিনি জেনারেল শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত একজন গ্রাম বাংলার প্রিয় মানুষ ছিলেন। তার পড়া-লেখার সূচনা গ্রামে হলেও রাজধানী ঢাকা শহরে শেষ হয়েছে। তিনি ছোট বেলা থেকেই মেধা ও স্মৃতি শক্তিতে ছিলেন অসাধারণ ও অতুলনীয় । স্থানীয় বাউসী এসিআই হাই স্কুল থেকে ১৯৫৭ ঈসায়ী সনে মাধ্যমিক, কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ থেকে ১৯৫৯ ঈসায়ী সনে উচ্চ মাধ্যমিক এবং সবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ডিগ্রী অর্জন করেছেন।
মরহুম ফকির আশরাফ প্রতিষ্ঠিত কলেজ
ছাত্র জীবন থেকেই তাকে নিয়ে এলাকার লোকজন সমাজ ও দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছে। ফলে তিনিও গরীব দুঃখী মানুষের মুখপত্র হিসাবে বিদ্যার্জন শেষে ১৯৬৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাক, পয়গাম ও আযাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করত দৈনিক সকালের বাণী, দৈনিক জনতা পত্রিকায় সম্পাদক হিসাবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। এমনকি ফকির আশরাফ ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের কাস্টমস কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রিয় মরহুম বাংলা সাহিত্যে অনেক গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলী হলো সোনা ডলার টাকা, নহ বধূ নহ প্রেয়সী, কত কথা কত স্মৃতি ও তাসলিমার লজ্জা নাই। একসময় তার রচনায় বিটিভিতে প্রকাশিত ধারাবাহিক নাটক “তথাপি” ছিল জনপ্রিয় সিরিয়াল। তিনি লায়ন গভর্নর, ঢাকাস্থ বৃহত্তর ময়মনসিংহ সমিতির মহাসচিব ও সভাপতি , নেত্রকোনা জেলা সমিতি, বারহাট্টা উপজেলা সমিতির সভাপতি ছিলেন। তিনি ড. দীনেশ চন্দ্র স্বর্ণপদক, অতীশ দিপঙ্কর স্বর্ণপদকসহ সাহিত্য ও সমাজসেবায় অনেক পুরস্কার লাভ করেন।
তার প্রতিষ্ঠিত মসজিদ
জনাব ফকির আশরাফ ছাত্র থাকা অবস্থাতেই জাতি ও দেশের জন্য কিছু করার লক্ষ্যে তৎকালিন শক্তিশালী মজবুত রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন। এবং রাজ পথের লড়াকু সৈনিক হিসাবে এক পর্যায়ে তিনি জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন। তিনি দীর্ঘদিন রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে নিষ্ঠার সাথে নিজ দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি মুসাফির জিন্দেগীতে নিজ এলাকার মাটি ও মানুষের জন্য অনেক কিছু করেছেন। তিনি ফকিরের বাজার সংলগ্ন নিজ বাড়ির পাশে ফকির আশরাফ ডিগ্রী কলেজ নামে উচ্চতর এক জেনারেল বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করেছেন। নির্মাণ করেছেন বাড়ির সামনে বুখারী মসজিদ নামে সুবিশাল ও সুন্দর এক মসজিদ ও ঈদগাহ। তাছাড়া প্রতিষ্ঠা করেছেন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন।
নেত্রকোণার কৃতিসন্তান জনাব ফকির আশরাফ পৃথীবির দীর্ঘ দিন লিভার ক্যান্সারে ভুগে আমেরিকায় চিকিৎসা গ্রহণ করলেও ঈদুল ফিতরের পূর্বদিন ১৭ জুলাই ২০১৫ সালে ঢাকার উত্তরা লুবানা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এবং তাকে তার নির্মিত মসজিদের পাশেই দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বৎসর। তিনি মৃত্যুর পরবর্তি সময়ে উত্তরসূরী হিসাবে দুনিয়ায় রেখে যান তার সম্মানিত স্ত্রী বাণী আশরাফ। যিনি বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৯১-১৯৯৫ সালে জাতীয় সংসদের নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ আসনের সংরক্ষিত মহিলা এমপি ছিলেন। প্রিয় মরহুম ফকির আশরাফ এক পুত্র ও দুই কন্যার পিতা। বর্তমানে তাঁর ছেলে বিপ্লব আশরাফ আমেরিকার সিটিজেন এবং মেয়ে আলিতা আশরাফ কানাডিয়ান সিটিজেন।
হে প্রিয় আশরাফ :
তুমি মরে গেলেও আজীবন বেঁচে থাকবে আমাদের মাঝে। তুমি আছো তোমার বন্ধু, তোমার সাথি ও ভক্তবৃন্দের মাঝে। আছো তুমি তোমার স্মৃতিময় কথা ও কাজে। সময় অসময়ে তোমায় নিয়ে বড়দের স্মৃতিচারনে। থাকবে তুমি তোমার কলেজ, মসজিদ নির্মাণে আমরন স্মৃতির ভাষ্কর হয়ে। তুমি বোধহয় সফল। মনে হয় তুমি জান্নাতি। জীবন খেলাঘরে পরাজিত হয়েও তুমি আমাদের কাছে বিজয়ী। তুমি আমাদের এক ঘুমন্ত নাবিক। তুমি আমার গ্রামের সাহসী বীর সেনা। তোমাকে আমরা আজীবন মনে রাখবো। ভুলবো না তোমায় কখনো কোনদিন। স্মৃতির পাতায় তোমার নাম আজীবন লিখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। আর তোমার কল্যাণার্থে জীবনের প্রতিটা মুনাজাতে খোদার কাছে ফরিয়াদ জানিয়ে বলব হে আল্লাহ, তুমি আমাদের আশরাফকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করো। সে যেমন তোমার ইবাদাতের জন্য দুনিয়াতে তোমার ঘর মসজিদ নির্মাণ করেছে তুমিও তেমন তার জন্য আখেরাতে জান্নাতের একটি ঘর বানিয়ে দিয়ো। আমিন, ইয়া রাব্বাল আলামিন।
লেখক: মুফতি ও নাযেমে দারুল ইকামা